ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কন্যাসন্তান বোঝা নয়, সৌভাগ্য

ড. মো. আনোয়ার হোসেন
কন্যাসন্তান বোঝা নয়, সৌভাগ্য

ছেলে সন্তানের প্রত্যাশায় যেসব পরিবারে মেয়ে শিশু জন্ম নেয়, সেখানে মেয়েরা মারাত্মক অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এসব অবহেলা ও বৈষম্যজনিত কারণে জন্ম নেওয়ার পর প্রতিবছর ১৭ লাখ মেয়ে শিশুর মৃত্যু হয় বলে ইউএনএফপিএ’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। সংস্থাটির বাংলাদেশে পরিচালিত জরিপের তথ্য বলছে, ১০০ মেয়ে সন্তানের বিপরীতে বর্তমানে ১০৫ জন ছেলে সন্তান জন্ম নিচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো দেশে বা স্থানে তা আরও বেশি। ১১০-১১৩ জনে গিয়ে ঠেকেছে। জরিপের তথ্য থেকে আরও জানা যায়, দেশে ১৮ শতাংশ নারী ছেলে সন্তান চান। ১২ শতাংশ নারী চেয়েছেন মেয়ে সন্তান। ৪০ শতাংশ মানুষ ছেলে না মেয়ে সন্তান হবে, তার আগাম পরীক্ষা করছেন। আর ৬ শতাংশ মানুষ সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে মেয়ে ভ্রুণ নষ্ট করছেন। প্রযুক্তির ব্যবহারে এমনটা হচ্ছে বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

যদিও একটি কন্যা বাবা মায়ের জন্য বেশি সৌভাগ্য বয়ে নিয়ে আসে, উহার কিছু লক্ষণ নি¤েœ উল্লেখ করা হলো : তার মিষ্টি হাসি বাবা-মায়ের কাছে সঙ্গীতের মতো, যা তাদের আনন্দিত করে এবং পুরো পরিবারকে আলোকিত করে। অনেক মেয়ে তাদের পরিশ্রম, নিষ্ঠা এবং প্রতিভার জন্য নিজেদের প্রমাণ করে। তারা পরিবার এবং জীবনের প্রতি দায়িত্বশীল হয়। মেয়েরা তাদের বাবা-মায়ের প্রতি খুব যত্নশীল এবং প্রেমময় হয়। তারা প্রতিটি কাজে তাদের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করে। অধিকাংশ কন্যা শিশু শান্ত স্বভাবের হয় এবং ছোটবেলা থেকেই মানুষকে চিনে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। সর্বোপরি একটি কন্যাসন্তান তার বাবা-মায়ের জন্য নিঃশর্ত ভালোবাসা, গর্ব এবং সুখ নিয়ে আসে, যা তাদের জীবনকে আনন্দময় করে তোলে।

বিশ্বজুড়ে ছেলে সন্তানের আশায় বছরে ১৫ লাখ মেয়ে শিশুর ভ্রুণ নষ্ট করা হয় এবং অবহেলা ও বৈষম্যজনিত কারণে জন্ম নেওয়ার পর আরও ১৭ লাখ মেয়ে শিশুর মৃত্যু হয়। জাতিসংঘের জনসংখ্যাবিষয়ক তহবিলের (ইউএনএফপিএ) পরিসংখ্যানে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। এমন ভয়ংকর তথ্য যেন আইয়ামে জাহেলিয়ার কথাই মনে করিয়ে দেয়।

জাহেলি যুগে কন্যা সন্তানদের যেখানে জীবন্ত দাফন করা হতো। জাহেলি যুগে কারো পরিবারের প্রথম সন্তান যদি মেয়ে হতো, তাকে দুর্ভাগ্য, অকল্যাণ মনে করে জীবন্ত দাফন করা হতো। কখনও জন্মের পর দাফন করা হতো, কখনও একটু বড় হলে। সেই সময়ও সব গোত্রে এমন নিয়ম ছিল না। কয়েকটি গোত্রে এই নিয়ম প্রচলিত। অন্যদিকে, একজন ব্যক্তি ছিলেন যিনি মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে বলতেন- তোমাদের ঘরে মেয়ে সন্তান জন্ম নিলে তোমরা যদি লালন-পালন করতে না পার, তাহলে সেই মেয়েকে আমার কাছে দিয়ে দাও; আমিই তাকে লালন-পালন করব। এভাবে কোনো কোনো কন্যাসন্তানকে তিনি দত্তক নিতেন, কোনো কোনো কন্যাসন্তানকে অন্যদের দত্তক নিতে উৎসাহ দিতেন।

সেই ব্যক্তি প্রায় ১০০ জন কন্যাসন্তানকে রক্ষা করেন। তিনি ছিলেন ইসলামণ্ডপূর্ব আরবের প্রসিদ্ধ হানিফ তথা একেশ্বরবাদী। তার নাম যায়িদ ইবনে আমর ইবনে নুফাইল। এ যুগে এসেও এই ধরনের লোকের বড্ড অভাব হয়েছে। 

আল্লাহ মানুষকে দুই ভাগে সৃষ্টি করেছেন। পুরুষ আর নারী, তবে আল্লাহ কাউকে শুধু কন্যা সন্তানই দান করেন। আবার কাউকে পুত্র সন্তান। কাউকে আবার পুত্র ও কন্যা উভয়ই দান করেন। কাউকে কাউকে আবার কোনো সন্তানই দান করেন না। এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন- তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা তাদের দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা করে দেন বন্ধ্যা। -সূরা শুরা (৪২) : ৪৯-৫০ অর্থাৎ তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা তাদের দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা তাকে করে দেন বন্ধ্যা। তার না পুত্র সন্তান জন্ম হয়, না কন্যা সন্তান। শত চেষ্টা-তদবির করলেও তার সন্তান হয় না। যার জন্য তিনি যা উপযোগী মনে করেন তাকে তা দান করেন।

কন্যাসন্তানও আল্লাহতায়ালার নিআমত। পুত্র সন্তানও আল্লাহতায়ালার নেয়ামত। কন্যাসন্তানেরও প্রয়োজন আছে, পুত্র সন্তানেরও প্রয়োজন আছে। পুরুষ মহিলার মুখাপেক্ষী, মহিলা পুরুষের মুখাপেক্ষী।

যখন আমরা নিজেদের অবস্থার পর্যালোচনা করি, তখন কিছু মানুষকে দেখতে পাই, যখন পুত্র সন্তান জন্মলাভ করে খুব আনন্দ প্রকাশ করেন। উৎসাহের সাথে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও প্রিয় মানুষদের ‘ছেলে হওয়ার’ খবর জানান। খুশিতে মিষ্টি বিতরণ করেন। খুব গুরুত্ব ও জাঁকজমকের সঙ্গে আকীকার আয়োজন করেন। সব জায়গায় ‘ছেলে হওয়ার’ আলোচনা করেন এবং তার লালনপালনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। ছেলে সামান্য অসুস্থ দৌড়ে কখনও ডাক্তারের কাছে যান। কখনও হাসপাতালে কখনও কবিরাজের কাছে। কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণে অসন্তুষ্ট হওয়া অনেক মানুষই কন্যাসন্তান জন্ম নিলে কোনো খুশি প্রকাশ করে না। কারও সঙ্গে ‘মেয়ে হওয়ার’ কথা আলোচনা করা হয় না। আর যদি কেউ জিজ্ঞাসাও করে বসে, তবে কোনো উত্তর দেওয়া হয় না। আর যদি বলেও তবে খুবই নিচু আওয়াজে, একেবারে অসহায় হয়ে বলে- ‘আমার মেয়ে হয়েছে’। অনেক সময় কন্যাসন্তান হওয়ার কারণে স্বামী তার স্ত্রীর উপর অসন্তুষ্ট হয়। স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়।

কিন্তু মানুষের তো এটুকু বুঝ থাকা দরকার যে, এ মহিলার ইচ্ছাধীন কী আছে? না পুত্র সন্তান ভূমিষ্ট করা তার ইচ্ছাধীন, না কন্যাসন্তান। তার ইচ্ছাধীন তো কিছুই নেই। বরং এসব তো আল্লাহর হিকমত ও কল্যাণ-জ্ঞানের বিষয়। আর তিনিই তো স্রষ্টা। তিনি ছেলে দান করতে চেয়েছেন, ছেলে হয়েছে, মেয়ে দান করতে চেয়েছেন, মেয়ে হয়েছে। সুতরাং স্ত্রীর উপর অসন্তুষ্ট হওয়া এবং তার সঙ্গে কথা বন্ধ করে দেওয়া কতটা বাড়াবাড়ি! কন্যাসন্তান হলে তালাকের ধমকি এ ধরনের ঘটনাও শুনেছি, কারও এক-দুটি কন্যাসন্তান হওয়ার পর স্বামী তার স্ত্রী কে এ কথা বলে দিয়েছে, যদি এবারও তোমার মেয়ে হয় তাহলে তোমাকে তালাক দিয়ে দেব। কেমন ধৃষ্টতা ও বাড়াবাড়ি! যেন কন্যাসন্তানের স্রষ্টা এই নারী নিজে! পুত্র বা কন্যা হওয়া যেন তার ইচ্ছাধীন! মোটকথা, কিছু মানুষ এমন আছে, যারা মেয়ে সন্তান হওয়ার কারণে অসন্তুষ্ট হয়।

এটি জাহেলী যুগের কর্মপন্থা। ইসলামপূর্ব জাহেলী আরবে নিয়ম ছিল, যদি তাদের কন্যা জন্মলাভ করত, তাহলে তারা কন্যা হওয়াকে নিজের জন্য অমঙ্গল ও অপমানের কারণ মনে করত। সন্তান জন্মের কিছুদিন পূর্ব থেকেই তারা মানুষের আড়াল হয়ে যেত, মানুষের কাছ থেকে লুকিয়ে বেড়াত যে, জানা নেই আমার ঘরে কী সন্তান জন্মলাভ করবে। পরে যদি ছেলে সন্তান হতো এটাকে তার জন্য সম্মানের বিষয় মনে করত। আর যদি মেয়ে সন্তান হত তাহলে তারা সেটাকে অমঙ্গল ও অপমানের কারণ মনে করত। আল্লাহতায়ালা সূরায়ে নাহলে তাদের বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন-   

তাদের কাউকে যখন কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয়, তখন তার মুখ কালো হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনোস্তাপে ক্লিষ্ট হয়। তাকে যে সুসংবাদ দেওয়া হয়, তার গ্লানী হেতু সে নিজ সম্প্রদায় হতে আত্মগোপন করে; সে চিন্তা করে যে, হীনতা সত্ত্বেও সে তাকে রেখে দিবে, না মাটিতে পুতে দেবে। লক্ষ্য কর, সে কত নিকৃষ্ট সিদ্ধান্ত স্থির করেছিল। -সূরা নাহল (১৬) : ৫৮-৫৯। কন্যাসন্তান ‘সুসংবাদ’ লক্ষ্য করুন, আয়াতে কন্যাসন্তানের জন্মের সংবাদকে ‘সুসংবাদ’ বলা হচ্ছে। তাদের জাহেলী কর্ম ও মানসিকতার শুধু নিন্দাই করা হয়নি, বরং তারা যেটাকে দুঃসংবাদ মনে করছে সেটাকে ব্যক্তই করা হয়েছে ‘সুসংবাদ’ বলে। একটি শিক্ষণীয় ঘটনা, জাহেলি যুগে অনেকে নিজের দশ দশটি কন্যাসন্তানকেও জীবিত কবর দিয়েছে। হাদীস শরীফে এক ব্যক্তির একটি আশ্চর্য ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এক ব্যক্তি মুসলমান হওয়ার পর সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিজের জাহেলী যুগের ঘটনা শুনিয়েছেন। হে রাসূল! আমার একটি কন্যাসন্তান ছিল। সে দিনে দিনে বড় হতে থাকে। কিন্তু তার জীবিত থাকার বিষয়টি আমার সহ্য হচ্ছিল না। আমি একদিন তাকে তার মায়ের কাছ থেকে কোনো এক বাহানায় নিয়ে গেলাম। আমি তাকে বললাম, চলো একটু ঘুরে আসি। পরে আমি তাকে এক খোলা প্রান্তরে নিয়ে গেলাম। সেখানে পূর্বেই আমি একটা গর্ত করে রেখেছিলাম। সেখানে গিয়ে আমি তাকে বললাম, আমি এ কূপটি খনন করব যেন পানি পাওয়া যায়। আমি তোমাকে নিচে নামিয়ে দিচ্ছি, তুমি বালতিতে মাটি ভরে দিবে আর আমি তা উপরে তুলে নেব। আমার মেয়ে আমার কথা মেনে নিল। সে নিচে নেমে গেল। কিন্তু যখনই সে নিচে নামল, আমি তার উপর মাটি দিতে শুরু করলাম। মেয়েটি আমাকে বলল, আব্বা! আপনি কী করছেন? আমার উপর মাটি দিচ্ছেন! কিন্তু আমি এতটাই কঠিন দিলের ছিলাম যে, তার কথায় আমার কোনো আছর হলো না। আমি মাটি দিতেই থাকলাম। প্রথমে মাটি তার হাঁটু পর্যন্ত ঢেকে নিল। পরে পেট, এরপর বুক, তারপর ঘাড়, অবশেষে মাথা পর্যন্ত ঢেকে নিল। এমনকি মাটি যমিনের সমান হয়ে গেল। আমার মেয়েটি চিৎকার করছিল, আমাকে ডাকছিল। এক সময় তার চিৎকার ও ডাকাডাকি শেষ হয়ে গেল। আমি তাকে এভাবে জীবিত দাফন করে ফিরে এলাম। তিনি বলেন, আমি যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ ঘটনা শুনিয়েছি, তখন তার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। তিনি বললেন, এ কেমন পাষ-তা! ইসলাম এই জুলুমণ্ডপ্রথার অবসান ঘটিয়েছে।

বাংলাদেশে  ছেলে সন্তানের চাইতে মেয়ে সন্তানের ভ্রুণ নষ্ট করার প্রবণতা বেশি। ছেলে সন্তানের প্রত্যাশায় বছরে ৬ শতাংশ মেয়ে শিশুর ভ্রুণ নষ্ট করা হয়। সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি করে তা কমিয়ে আনতে হবে। গর্ভের সন্তান ছেলে না মেয়ে, তা নির্ধারণের পদ্ধতি বাতিল করতে হবে। যারা এই কাজে নিয়োজিত আছেন, তাদের উচিত বাবা-মাকে আগাম সন্তানের তথ্য না দেওয়া। এক্ষেত্রে সন্তানের ওপর ভায়োলেন্স কমে আসবে। কেননা, বেশিরভাগ ভায়োলেন্স হয় সন্তানের তথ্য আগাম পেয়ে যাওয়ার ফলে।

আজ হতে এ কথা ভাবব যে, মেয়েই আমার জান্নাতে দুনিয়া এবং পরলোকে কল্যাণের কারণ হতে পারে। তাই পূর্ণ খুশি ও সন্তুষ্টির সঙ্গে যেভাবে ছেলেদের লালনপালন করা হয়, ঠিক সেভাবেই মেয়েদেরও লালনপালন করব।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কথা সাহিত্যিক এবং প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত