প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৮ অক্টোবর, ২০২৫
চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে এক গভীর উদ্বেগ ও চেতনাশূন্যতার প্রতিফলন দেখা দিয়েছে। ২০২৫ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় গড় পাসের হার ৫৮.৮৩ শতাংশ, যা গত বছর ৭৭.৭৮ শতাংশের তুলনায় প্রায় ১৮.৯৫ শতাংশ কম। শুধু তাই নয়, জিপিএ ৫ প্রাপ্তির সংখ্যা এই বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে; ৬৯,০৯৭ জন শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছেন। এটি কোনো স্বাভাবিক পার্থক্য নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষার মান এবং শিক্ষানীতির কার্যকারিতার একটি শঙ্কাজনক প্রতিফলন। ফলাফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা বোর্ডগুলোর ভৌগোলিক পরিসংখ্যানও উদ্বেগজনক চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে। ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৬৪.৬২ শতাংশ, রাজশাহী বোর্ডে ৫৯.৪০, চট্টগ্রামে ৫২.৫৭, দিনাজপুরে ৫৭.৪৯, ময়মনসিংহে ৫১.৫৪, কুমিল্লায় ৪৮.৮৬ এবং যশোরে ৫০.২০ শতাংশ। বরিশাল ৬২.৫৭, সিলেট ৫১.৮৬। মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের তুলনায় পাসের হার ৭৫.৬১ এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে ৬২.৬৭। এই পরিসংখ্যানগুলো স্পষ্টভাবে নির্দেশ করছে যে, শিক্ষার মান ও শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য বিদ্যমান। পাশাপাশি, এবারের ফলাফলে ৩৪৫টি প্রতিষ্ঠান শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করলেও, ২০২টি প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষার্থীও পাস করতে পারেনি। এই পরিসংখ্যান আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরের কাঠামোগত অঙ্গসংস্থার দুর্বলতার দিকে ইঙ্গিত করে। এটি নির্দেশ করে যে, শিক্ষার মাপকাঠি ও ফলাফলের মধ্যে এক ধরনের স্থানান্তরিত বৈষম্য বিদ্যমান, যেখানে কিছু প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণভাবে শিক্ষার্থীর সামর্থকে বিকশিত করতে সক্ষম, আবার অন্যরা কেবল পারিপার্শ্বিক প্রভাব এবং সীমিত সম্পদে আটকে রয়েছে। শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক খন্দকার এহসানুল কবির এ ফলাফল প্রকাশের সময় বলেন, ‘আমরা অতিরিক্ত নম্বর দিয়ে সন্তুষ্টি নয়, বরং ন্যায্য নম্বর দিয়ে সততাকে বেছে নিয়েছি। এই সিদ্ধান্ত সহজ নয়, কিন্তু প্রয়োজনীয়।’ এটি বোঝায় যে, ফলাফলে হঠাৎ ধাক্কা আসলেও এটি কোনো ব্যর্থতা নয়, বরং বাস্তবতার স্বীকৃতি। বাস্তবতা থেকে চোখ ফেরালে আমরা শিক্ষার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ঘটাতে পারি, যা মেধাবী ছাত্রছাত্রী এবং আগামী প্রজন্মের প্রতি অন্যায়।
এই ধসের পেছনে কারণ অনুসন্ধানের জন্য শিক্ষামন্ত্রীর দিকনির্দেশ স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, ‘আমরা তিনটি নীতিতে এগোতে চাই: বাস্তবতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নয়, বাস্তবতাকে বুঝে এগোনো। দোষারোপ নয়, সমাধান খোঁজা। সংখ্যা নয়, শেখার মানকে সাফল্যের মাপকাঠি করা।’ এটি শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ মূল্যায়নের জন্য এক যুগান্তকারী দিক নির্দেশনা। আমাদের প্রয়োজন শুধু ফলাফল দেখার নয়, বরং সেই ফলাফলের পেছনের জটিল কাঠামোগত কারণগুলো চিহ্নিত করা। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা এই ধসকে শুধুমাত্র শিক্ষার্থী বা শিক্ষকের ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন না। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব রেহানা পারভীন বলেছেন, ‘শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ খুব বেশি শিক্ষামুখী ছিল না। এটি আমাদের সবাই অনুভব করেছি।’ বাস্তবিক অর্থে, শিক্ষার মানে শুধুমাত্র বই পড়া বা পরীক্ষা দেওয়া নয়; এটি একটি অনুকূল পরিবেশে চিন্তা, বিশ্লেষণ এবং আত্মমূল্যায়নের সুযোগ প্রদান করা। যখন শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা ও মননশীলতা বিকশিত করার জন্য পর্যাপ্ত নয়, তখন ফলাফল স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগজনক হয়। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, শহর এবং নগর এলাকায় অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের তুলনায় সীমান্তবর্তী, গ্রামীণ ও পর্যাপ্ত সংস্থানবিহীন অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা প্রায়শই সুযোগ থেকে বঞ্চিত। কুমিল্লা, যশোর এবং ময়মনসিংহ বোর্ডে কম পাসের হার এবং জিপিএ ৫ প্রাপ্তির সংখ্যা কম থাকা এ বাস্তবতার প্রমাণ। এটি স্পষ্ট করে যে, শিক্ষার মানে শুধুমাত্র শিক্ষকের দক্ষতা বা পাঠ্যক্রমের মান নয়; এটি অবকাঠামোগত সমতা, শিক্ষাসংক্রান্ত নীতি এবং স্থানীয় শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।
শিক্ষাব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা নির্ণয়ে একটি বিষয় হলো- শিক্ষক ও অভিভাবকের সমন্বয়হীনতা। অধিকাংশ বিদ্যালয় ও কলেজে শিক্ষকের সংখ্যা, শিক্ষার পরিকাঠামো এবং পাঠ্যক্রম বাস্তবায়ন সঠিকভাবে হয় না।
মো. শামীম মিয়া
শিক্ষার্থী ফুলছড়ি সরকারি কলেজ
আমদিরপাড়া জুমারবাড়ী সাঘাটা গাইবান্ধা