ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

রসায়নশাস্ত্রের জনক জাবির ইবনে হাইয়ান

এমরান চৌধুরী
রসায়নশাস্ত্রের জনক জাবির ইবনে হাইয়ান

যুগ যুগ ধরে গবেষণা ও সৃজনশীলতায় মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান অবিস্বরণীয়। বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের যে নিজস্ব ধ্যান-ধারণা তা সভ্যতার বিকাশকে করেছে আরও গতিশীল। রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাসসহ এমন কোনো বিষয় নেই যেখানে মুসলিম বিজ্ঞানীরা অবদান রাখেননি। অনেক মুসলিম বিজ্ঞানীর আবিষ্কার গোটা বিশ্বের চেহারাই বদলে দিয়েছে। তাদের সেসব আবিষ্কার ও গবেষণার আধুনিকীকরণের সুফল ভোগ করছে আজকের বিশ্ববাসী। দুনিয়া কাঁপানো মুসলিম আবিষ্কারকদের মধ্যে একজন জাবির ইবনে হাইয়ান।

আমরা জানি, বিভিন্ন শিল্প ও পরীক্ষাগারে হাইড্রোক্লোরিক এসিড ও নাইট্টিক এসিড ব্যবহৃত হয়। হাইড্রোক্লোরিক এসিড এমন একটি শক্তিশালী এসিড যা বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিষ্কারক, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, ধাতুবিদ্যা এবং ওষুধ শিল্পে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও, এটি আমাদের পাকস্থলীতেও উপস্থিত থাকে যা খাদ্য হজমে সহায়তা করে। অন্যদিকে নাইট্রিক এসিড বিভিন্ন সার, বিস্ফোরক, রং, ওষুধ এবং অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ রসায়ন। রসায়নের এই দুটো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যার হাতের ছোঁয়ায় আমরা পেয়েছি তার নাম জাবির ইবনে হাইয়ান।

বিজ্ঞানী জাবির ইবনে হাইয়ান ৭২২ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান ইরানের মাশহাদ শহরের কাছাকাছি অবস্থিত তুস নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্ণ নাম আবু আবদুল্লাহ জাবির ইবনে হাইয়ান। তিনি আবু মুসা জাবির ইবনে হাইয়ান নামেও সুপরিচিত। অনেকে তাঁকে আস সুফী নামেও অভিহিত করেন। তাঁর বাবার নাম হাইয়ান।

জাবির ইবনে হাইয়ানের পূর্বপুরুষরা আরবের দক্ষিণ অংশে বসবাস করতেন। কিন্তু তাঁর বাবা পূর্বপুরুষদের স্থানে থাকেননি। তিনি বসবাস শুরু করেন কুফায়। কুফা একটি শহরের নাম। বর্তমানে এটি ইরাকের একটি শহর। এটি বাগদাদের ১৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং নাজাফের ১০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। শহরটি ইউফ্রেটিস নদীর তীরে অবস্থিত। জাবিরের বাবা ছিলেন একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক। তিনি এক সময় কুফা ত্যাগ করে সপরিবারে পাড়ি জমান তুস নগরে। এই তুস নগরেই জন্ম হয় জাবির ইবনে হাইয়ান-এর। তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে উমাইয়া খলিফা তাঁর বাবাকে গ্রপ্তার করেন। পরবর্তীতে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ফলে তাঁর পরিবার পুনরায় তাঁদের পূর্বপুরুষদের স্থানে ফিরে আসেন।

জাবির ইবনে হাইয়ান-এর শিক্ষাজীবন শুরু হয় দক্ষিণ আরবেই। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন বইপ্রেমি। যে কোনো বিষয়ের বই পেলেই তিনি মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। বইয়ের ওপর গবেষণা করতেন। ফলে খুব অল্প সময়ে তিনি গণিতের বিভিন্ন শাখায় পাণ্ডিত্য লাভ করেন। বড় হয়ে তিনি বাবার মতোই চিকিৎসা পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। তৎকালীন বিখ্যাত পণ্ডিত ইমাম জাফর সাদিকের অনুপ্রেরণায় তিনি রসায়ন ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে গবেষণা শুরু করেন। দ্রুত তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে নতুন নতুন তথ্য ও বিভিন্ন পদার্থ আবিষ্কার করতে আরম্ভ করেন।

তিনি রসায়ন শাস্ত্র গবেষণায় বিশেষভাবে মনোযোগী হন। ওই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি একটি রসায়ন গবেষণাগারও প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলিম ঐতিহাসিকরা ওই গবেষণাগারকে পৃথিবীর প্রথম রসায়নাগার বলে অভিহিত করেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই প্রথম বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে রসায়নের প্রাথমিক প্রক্রিয়াগুলো চর্চা করার উপায় উদ্ভাবন করেন।

জাবির ইবনে হাইয়ান বস্তজগতকে তিন ভাগে বিভক্ত করেন। এই তিন ভাগের নামকরণ করেন তিনি স্পিরিট, ধাতু ও যৌগিক পদার্থ নামে। পরবর্তী বিজ্ঞানীরাও বস্তজগতকে তিন ভাগ করে নাম রাখেন বাষ্পীয়, পদার্থ ও পদার্থবহির্ভূত। জাবির ইবনে হাইয়ান নানাভাবে রাসায়নিক বিশ্লেষণের নামকরণ করেছেন। পাতন, উধ্বপাতন, পরিস্রাবণ, দ্রবণ, গলন, বাষ্পীভবন ইত্যাদি রাসায়নিক গবেষণার কী কী রূপান্তর হয় তা তিনি বিস্তৃত বর্ণনা করেছেন। তিনি চামড়া ও কাপড়ে রং করার প্রণালি, ইস্পাত প্রস্ততকরণ, লোহা, ওয়াটারপ্রুফ কাপড় বার্ণিশ করার উপায় ও সোনার জলে পুস্তকে নাম লেখার জন্য লোহার ব্যবহার ইত্যাদি আবিষ্কার করেন। জাবির ইবনে হাইয়ান-এর মতে সোনা, রুপা, লোহা যত প্রকার ধাতু আছে কোনো ধাতুই মৌলিক নয়। এসব ধাতু পারদ আর গন্ধকের সমন্বয়ে গঠিত।

জাবির ইবনে হাইয়ান গ্রিক ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। রসায়ন শাস্ত্রের পাশাপাশি তিনি চিকিৎসা, খনিজ পদার্থ বিশেষত পাথর, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে অবদান রাখেন। তিনি প্রায় ২ হাজার গ্রন্হ রচনা করেন। এর মধ্যে চিকিৎসা বিষয়ে গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৫০০। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যাধিক্য নিয়ে অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোর আকার নিয়ে। তাঁর লিখিত গ্রন্থের অনেকগুলোর গড় পৃষ্ঠা মাত্র ৮-১০ এর মতো। আবার কোনো কোনোটার পৃষ্ঠা সংখ্যা মাত্র দুটি। তাঁর গ্রন্থের বিষয় ছিল বিভিন্নবিষয় নিয়ে তিনি যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন তার ফলাফল। বিভিন্ন বিষয়ে লেখা তাঁর গ্রন্থাবলির যে সংখ্যা পাওয়া যায় তাঁর মধ্যে চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে লেখা বইই সর্বাধিক। তারপর আছে দর্শন নিয়ে ৩০০টি, রসায়ন নিয়ে ২৬৭টি, জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে ৩০০ পৃষ্ঠার ১টি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

জাবির ইবনে হাইয়ানের আলকেমি সংক্রান্ত গ্রিক ভাষায় কয়েকটি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে সব গ্রন্থের আরবি পাণ্ডুলিপির কোনো সন্ধান মিলে না। ইংরেজিতে যে কটি গ্রন্থ ভাষান্তরিত হয় তা হলো- the sum of perfection, the investigation of perfection, the invention verity, the testament, the book of veance etc.

ইংরেজ বিজ্ঞানী হোলমার্ডের মতে, প্রায় ৩০০ বছর ধরে ইউরোপীয় আলকেমির চিন্তাধারা জাবির ইবনে হাইয়ান-এর উদ্ভাবিত পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করেই সম্প্রসারিত হয়। তাঁর জীবন ও কর্মের ওপর ইউরোপীয় বেশ কজন বিজ্ঞানী গবেষণা করেন।

জাবির ইবনে হাইয়ান মুসলিম সমাজের গর্ব। এ কারণে তার নাম রসায়ন জগতে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিজ্ঞানের এমন কোনো শাখা নেই, যেখানে তার অবাধ বিচরণ ছিল না।

এমরান চৌধুরী, শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত