প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৪ অক্টোবর, ২০২৫
একটি শিশুর মাতৃগর্ভের প্রাথমিক রূপকে বলা হয় ভ্রুণ। মাতৃগর্ভ হতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তাকে শিশু বলে ধরা হয়। জীববিজ্ঞানের ভাষায়, মনুষ্য সন্তানের জন্ম এবং বয়ঃসন্ধির মধ্যবর্তী রূপ হচ্ছে শিশু। চিকিৎসাশাস্ত্রে সংজ্ঞানুযায়ী মাতৃগর্ভে ভ্রুণ আকারে অভূমিষ্ঠ সন্তানই শিশু। আবার আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় সংজ্ঞায় জন্মের পর থেকে যৌবনপ্রাপ্ত হওয়ার পূর্ব কিংবা বয়ঃসন্ধিক্ষণে প্রবেশ করেনি তাকে শিশু হিসেবে রাষ্ট্র বা সমাজে চিহ্নত করা হয়।
আমরা শিশুর সংজ্ঞা যে যেভাবেই উপস্থাপন করি না কেন, সকলের সংজ্ঞায় লুকিয়ে আছে একটি শান্ত শীতল কোমলমতি মন। সেই মনটা কখনও থাকে চঞ্চল কখনওবা সজীব, তবে নিষ্পাপ। তাই তারা ভোরে ডাকা পাখির মতো কিচিরমিচির করে গাইতে চায় সুপ্তসুরে, উড়তে চায় মুক্তমনে। তার খিলখিল হাঁসিতে পরিবারের সদস্যরা মাতিয়ে থাকলেও নানা বায়নায় বিরক্তও হয় বটে, তবে সে বিরক্তির মাঝেও খুঁজে পায় এক অনবরত সুখ। সেই অসংজ্ঞায়িত সুখের নির্যাস অনুভব করতে পারে একমাত্র তার বাবা-মা।
একজন শিশুর মন ভাবনায় সার্বক্ষণিক অজানাকে জানা, আর অদেখাকে দেখার ইচ্ছাটায় বেশি পরিলক্ষিত হয়। তাদের হাসি-কান্না, জানা-অজানাসহ সকল কিছুর সঙ্গে যুক্ত থেকে একটি সুন্দর সাবলীল পরিবেশ সৃষ্টি করে দেওয়ার প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব তার বাবা-মার। এরপরেই পরিবারের অন্য সদস্যসহ তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দায়িত্ব সমাজ ও রাষ্ট্রের। তাদের যদি সহজ সরল ও সঠিক পথ না দেখানো হয় তাহলে তারা ভুল পথে পা বাড়াবে। কারণ তারা শিশু, তাদের ভুল হওয়াটায় স্বাভাবিক। তাই তাদের স্বাভাবিক ভুলটাকে আমরা যদি অস্বাভাবিক কৌশল অবলম্বনের মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিতে পারি, তাহলে তাদের আগামীর পথচলাটা হবে সহজ, সুন্দর ও সুগম। তারাই জাতিকে উপহার দিতে পারে একটি সুশীল সমাজ।
১৪-১৫ বছর বয়সসীমা যারা অতিক্রম করে তাদের মনস্তত্বে থাকে, রোমান্স, অ্যাডভেঞ্চার, স্বপ্ন, রূপকথা, কল্পনা এবং জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার উপস্থাপন। এ বয়সের শিশুদের চেনানো ও জানানোর মাধ্যম হলো শিশু সাহিত্য। যারা শৈশব ও কৈশরের খুব সন্নিকটে, তাদের জন্য এই চেষ্টা অনেকটা ফলপ্রসূ। বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, আমাদের বাংলায় শিশু সাহিত্যের সূচনা হয় উনিশ শতকের দিকে। যদি বাংলাদেশের কথা বলা হয় তাহলে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ১৯৭৮ সালের পরেই মূলত বাংলা সাহিত্যের চর্চা মোটামুটি নতুনরূপে সূচিত হয়। আর সে সময়ে বিভিন্ন বিষয়বস্তুতে বিভিন্ন বৈচিত্র লক্ষ্য করা যায়। আর সেই বিষয় বস্তুর আলোকেই শিশুদের নিয়ে শিশুতোষ গ্রন্থ প্রকাশ হতে শুরু করে। আমাদের বাংলাদেশে যদি এই সময়ের কথা বলি, তাহলে অবস্যই বলতে হয়, শিশু সাহিত্য নানা বাঁধা-বিপত্তি পেরিয়ে এখন মোটামুটি একটা ভালো অবস্থানে আছে।
আমরা প্রাপ্ত বয়স্করা যখন কোন বই পড়ি, তা হতে পারে কোন উপন্যাস, কবিতা, অথবা কারো জীবনী। তখন কিন্তু লেখকের চেতনায় যা বুঝাতে চেয়েছে তার অনুরুপ না হলেও সেই অর্থবহ শব্দগুলোর স্থান, কাল ও দৃশ্যপটের প্রতিচ্ছবি কল্পনার মানসপটে ভেসে উঠে। অনুরূপভাবে একটি শিশু যখন কোন শিশুতোষ বই পড়বে ঠিক তার মানসপটেও ওই ভাবনা বা চিত্রগুলো ভেসে উঠবে। যেমন একজন রাখালের কোনো গল্পের বই যখন কোনো শিশু পড়বে, তখন কিন্তু তার মন ভাবনায় দিগন্ত সবুজের মাঠ, মাঠের মাঝে লতা ছাড়া প্রাচীন বট গাছ, গরু-ছাগলসহ রাখালের মায়াবী বাঁশির সুর তার কানে ভেসে আসবে। তখন সে এমন স্থান ও দৃশ্য দেখার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠবে। আর এই ধরনের দৃশ্যপট যখন কোনো শিশু প্রত্যাক্ষভাবে দেখবে, তখন তার মনে একটা প্রাকৃতিক প্রশান্তি অনুভব করবে, যা তার মন ও আগামীর জন্য প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে সাহায্য করবে। যা বর্তমান প্রযুক্তির যুগে ডিভাইসনির্ভর হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এর জন্য বাবা-মার চেষ্টাটাই বেশি প্রধান্য।
আমাদের দেশে একটি শিশুকে যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গড়ে তোলা হয়, সেই প্রক্রিয়াই শুধু মাত্র ভালো মানের স্কুল কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার প্রতিযোগিতা। সেই সাথে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে পড়াশোনা নতুবা দেশেই সোনার হরিণ নামক ভালো একটি চাকরির পেছনে ছোটাছুটির আপ্রাণ চেষ্টা। ক’জন বাবা-মা আছে এমন সব হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতার মধ্যে সেই সন্তানকে সাহিত্যমনা চেতনায় গড়ে তুলতে শিশু বয়স হতেই তার হাতে শিশুতোষ বইগুলো তুলে দেয়, কজন বাবা-মা আছে তার আদরের সন্তানকে মাঝে মধ্যেই কৃত্রিম পার্কগুলোতে ঘুরতে না গিয়ে অতীতের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস ঐতিহ্য অথবা মুক্ত নীল আকাশের নিচে সবুজ ধানখেতের দোল দেখিয়ে বাংলার কৃষকের গল্প শোনান? এমন ইচ্ছা থাকলেও প্রযুক্তির রঙিন দুনিয়ার জালে আটকা পড়েছে প্রায় সকল বয়সের মানুষ। তাই সন্তানদের পাশাপাশি বাবা-মা ও ডুবে গেছে প্রযুক্তির রঙিন দুনিয়াই। একজন সাহিত্যমনা শিশু আর স্বাভাবিক মেধা সম্পূর্ণ শিশুর মধ্যে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। একজন প্রকৃত সাহিত্যমনা শিশু তার বাবা-মাকে কখনও উচ্চস্বরে কথা বলতে পারে না। আর দশটা শিশু হতে তার চাল-চলন কথা বার্তায় আলাদা কিছু দৃশ্যমান। যা যে কোনো মানুষকে মুগ্ধ করবে।
একজন প্রকৃত শিল্প সাহিত্যমনা শিশু কখনও মুখে তুলে নিতে পারে না মাদক, হাতে ধরতে পারে না অস্ত্র। শুধু তাইনা, তার বাবা মাকে গালি দেওয়া দূরে থাক উচ্চস্বরে কথাও বলতে পারে না। কারণ তার ভেতরে এমন এক চেতনা কাজ করে, যে চেতনা নত করতে শেখায় মাথা, যে চেতনা নিজেকে অন্যের সামনে উপস্থাপনা করতে শেখায় ক্ষুদ্র করে। সবাই বাঁচাল হলেও সে কম বলে। তবে সে কিন্তু বোকা নয়, কারণ সে সবার কথাগুলো মন দিয়ে শুনে বিচার বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করে যায়, সেই সঙ্গে নিজের কাজ এবং কর্মের তুলনা করার চেষ্টা করে। তবে একজন শিশুর ভেতরে এমন চিন্তা-চেতনা উজ্জীবিত করার জন্য সবচেয়ে বেশি পরিমাণ ভূমিকা রাখে, যদি তার বাবা-মা শিল্প সাহিত্যমনা হয়।
কবিতা দিয়ে লেখালেখি শুরু করলেও কথা সাহিত্যিক উপাধিতে ভূষিত হন শওকত ওসমান। তার প্রথম প্রকাশিত বই শিশু সাহিত্যের উপর। শিশু মনস্তত্বকে তিনি যেভাবে উপলব্ধি করেছেন- তার একটা উজ্বল দৃষ্টান্ত ‘ওটেন সাহেব বাংলোতে’ এই বইটিতে লেখক মোট চারটি গল্প তুলে ধরেন, যে গল্পগুলোর মধ্যে ভূতের ভয় দেখিয়ে ব্রিটিশ সাহেবকে তাড়ানোর যে অসাধারণ চিত্র ফুটে উঠে, সেখানে শিশুমনে ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবের বীজ বপন করে দেয়। ন্যায়-অন্যায় দেখিয়ে নৈতিকতা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। তিনি শিশুমনে সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি সচেতন হওয়ার যথেষ্ট প্রমাণ গল্পের মধ্য দিয়ে ইঙ্গিত দেয়। শিশু সাহিত্যে তার প্রধান উপজীব্য ছিল সমাজের নানা বৈষম্যসহ যুক্তি, বিজ্ঞান ও বাস্তববাদিতা। তিনি শিশুদের জন্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য রচনা করেন।
এনআর খোরশেদ আলম রাজু
লেখক ও সাংবাদিক