প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৫ অক্টোবর, ২০২৫
দেশ বর্তমানে নানাদিক থেকে অস্থিতিশীল সময় অতিক্রম করছে। তার উপর সম্প্রতি খোদ রাজধানী থেকে মাদকের বড় বড় চালান আটকের খবর অনাগত দিনগুলোতে অস্থির পরিস্থিতির বার্তা বহন করছে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রায় প্রতিটি স্তরেই অস্থিরতা, অনিশ্চয়তার ছায়া ঘন হয়ে উঠেছে। সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, রাজনীতি, আইনশৃঙ্খলা এবং সংস্কৃতির প্রতিটি পরতে পরতে আমরা দেখতে পাচ্ছি উদ্বেগজনক এক চিত্র। যেখানে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতা কমে যাচ্ছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে, রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত হচ্ছে এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ভয়াবহ আকারে বিস্তার লাভ করছে। এই পরিস্থিতিতে সমাজের প্রতিটি নাগরিকের জন্য প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে- আমরা কী করছি, আমাদের ভূমিকা কোথায় এবং এই অস্থিরতার সময়ে আমাদের দায়বদ্ধতা কী? মাদকের ভয়াবহতাকে মাথায় রেখে এখনি যদি রুখে না দাঁড়ানো যায় তাহলে অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। দেশে প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী শিশু, কিশোর ও তরুণ। এরাই আগামী দিনের জাতির কর্ণধার। তাই মাদকের ভয়াল গ্রাস যেন আমাদের আগামীর আলোকিত প্রজন্মকে ধ্বংস না করতে পারে, সে দিকে আমাদের সচেষ্ট হতে হবে। একাধিক জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরের সূত্রমতে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার রোহিঙ্গা নারী পুরুষদের মাধ্যমে মিয়ানমার থেকে আসছে ইয়াবা-আইসের মতো জীবন ধ্বংসকারী মাদক। মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ মাদকের ঝুঁকিতে রয়েছে।
আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের পথ গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল (মিয়ানমার, লাওস ও থাইল্যান্ডের সীমানা), গোল্ডেন ক্রিসেন্ট (ইরান, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান) এবং গোল্ডেন ওয়েজের (ভারতের হিমাচল প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, অরুণাচল প্রদেশ, নেপাল ও ভুটানের কিছু অংশ) একেবারে কেন্দ্রে অবস্থান হওয়ায় এমন ঝুঁকিতে বাংলাদেশ। এ ছাড়া ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে দেশের ৩২টি সীমান্তবর্তী জেলা রয়েছে। এসব জেলার অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে প্রচলিত ও অপ্রচলিত মাদক দেশে আসছে। মাদক পাচারের সময় অনেকে আটক হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে মূল দালাল সিন্ডিকেট। সীমান্ত উপজেলা টেকনাফের নাফ নদী ও সমুদ্র উপকূলবর্তী ইউনিয়ন সেন্টমার্টিন, সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ, পৌরসভা, টেকনাফ সদর, বাহারছড়া, হ্নীলা, হোয়াইক্যং ও সমুদ্র উপকূলের বিভিন্ন মৎস্যঘাট এখন মাদক পাচারের হটস্পট। নৌকায় করে মিয়ানমার থেকে আসছে ইয়াবা-আইসের বড় চালান। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অনিশ্চয়তা এবং অর্থনৈতিক টানাপড়েন দেশের ভেতর এমনিতেই সংকটজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তার উপর মাদকের বিস্তার হলে সামাজিক অস্থিরতার শিকড় আরো গভীর হবে।
সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি ঘটনা জানান দিচ্ছে যে- দেশে মাদকের সরবরাহ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একের পর এক বড় বড় মাদকের চালান জব্দ করছে- যার মধ্যে রয়েছে ইয়াবা, ফেনসিডিল, আইস (ক্রিস্টাল মেথ), গাঁজা, হেরোইনসহ নানা ধরনের অবৈধ ও ক্ষতিকর দ্রব্য। মাদক বিস্তারের এই প্রবণতা শুধু ভয়াবহই নয়, এটি আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা, তরুণ সমাজ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক অশনিসংকেত। দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ আমাদের তরুণ প্রজন্ম। কিন্তু এই প্রজন্মই আজ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। বেকারত্ব, হতাশা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সামাজিক বৈষম্য এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে তরুণদের এক বড় অংশ আজ মাদকের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। অনেকে শখে, কেউ বন্ধুবান্ধবের প্ররোচনায়, কেউ মানসিক চাপে পড়ে মাদকের দিকে ধাবিত হচ্ছে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে প্রশাসনিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়া, নিরাপত্তা বাহিনী রাজনৈতিক গোলযোগে ব্যস্ত থাকা এবং দুর্বল শাসন কাঠামোর সুযোগে মাদক কারবারিরা তাদের কার্যক্রম আরও গতিশীল করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একদিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যস্ত, অন্যদিকে সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় শৈথিল্য ও দুর্বলতা স্পষ্ট। এমন পরিস্থিতিতে মাদক পাচারকারীরা যেমন সক্রিয় হয়েছে, তেমনি মাদকের ব্যবহারকারীর সংখ্যাও বাড়ছে। সীমান্ত এলাকায় মাদক পাচারের হার বেড়েছে। বিশেষত টেকনাফের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো দিয়ে বাংলাদেশে মাদক ঢুকছে দেদারসে। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মায়ানমারের সাথে দীর্ঘ সীমান্ত মাদক পাচারের অন্যতম কারণ।
কক্সবাজার জেলার টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলায় রয়েছে মাদকের ৬০টি হটস্পট। এসব স্পট দিয়ে মিয়ানমার থেকে মাদকের চালান আনা হচ্ছে, বিক্রিও করা হচ্ছে। প্রবেশকৃত এসব মাদক মজুদ করা হচ্ছে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয়। এসব শিবির থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন চক্রের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। বিজিবির তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত বিজিবির অভিযানে ৪৬ লাখ ৮৯ হাজার ৩২২ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। ৭০ জনকে আটক এবং ৪৭ জনকে পলাতক আসামি করা হয়েছে। কোস্ট গার্ড চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে প্রায় ৩০ লাখ ইয়াবা উদ্ধার করেছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টেকনাফ থানায় ৩০৮টি মাদক সংক্রান্ত মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় ৩৬৫ জন আসামিকে আটক করা হয়। কিন্তু মাদক পাচারে যাদেরকে ধরা হচ্ছে তাদের বেশির ভাগই মূলত নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে নিরীহ জেলে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে মূল হোতাদের উল্লেখযোগ্য অংশই ধরা পড়ছে না। অতি লাভজনক ব্যবসা হওয়ার সুবাদে মাদক দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জিরো টলারেন্স সত্ত্বেও এর আগ্রাসন ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
মাদককারবারিরা- নৌ, সড়ক, রেল ও আকাশপথ ব্যবহার করে রাজধানীসহ সারা দেশে মাদক ছড়িয়ে দিচ্ছে। পাচার ও বিক্রির ক্ষেত্রে তারা নিত্যনতুন কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে টার্গেট করেও দেশে মাদকের কারবার জমে উঠছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই তিন বছরে মাদকাসক্ত হয়ে সরকারি ও বেসরকারি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে গেছেন ১ লাখ ১০ হাজার ৬৭৫ জন মাদকসেবী। এ সময়ে রিহ্যাবে চিকিৎসা নেওয়া নারী মাদকাসক্ত বেড়েছে ৫ গুণ। আর ১৫ ও তার কম বয়সি মাদকাসক্ত বেড়ে হয়েছে তিন গুণ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উদ্ধারকৃত মাদক, আসামি ও মামলার পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১১ লাখ ৫২ হাজার ৫৯৫টি মামলায় ১৪ লাখ ৬২ হাজার ৭৮৯ জন আসামি গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ৩৮ কোটি ৭৮ লাখ ৫১ হাজার ৩৯৫ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ১ কোটি ৩২ লাখ ৮১ হাজার ৫৪৮ বোতল ফেনসিডিল, ৩২ লাখ ৮ হাজার ৪২৭ বোতল বিদেশি মদ জব্দ করা হয়েছে। দেশে মোট মাদকসেবী প্রায় দেড় কোটি। এর মধ্যে এক কোটি মাদকাসক্ত।
মোট মাদকসেবীর ৮০ শতাংশ পুরুষ, আর ২০ শতাংশ নারী। মাদকাসক্তের ৮০ ভাগ অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। সড়কে দুর্ঘটনাকবলিত যানবাহনের ৩০ ভাগ চালকই মাদকসেবী। দিনদিন নারীদের মধ্যে এ প্রবণতা বাড়ছে। এ ছাড়া নতুন নতুন মাদকেও আসক্তি বাড়ছে। বর্তমানে মাদকের দিকে কারও নজর নেই। ফলে মাদক মাফিয়া চক্র সুযোগ পেয়ে দেশব্যাপী মাদক ছড়িয়ে দিয়ে রমরমা ব্যবসা করছে। স্থানীয়ভাবে মাদক বিস্তার রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সাধারণত সহায়তা করে থাকে ইউপি সদস্যরা। কিন্তু সম্প্রতি কুমিল্লার একটি ঘটনা আমাদের সকলের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার একটি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্যের বাড়ির ছাদ থেকে প্রায় ১০০ কেজি গাঁজা জব্দ করেছে পুলিশ। এ সময় ছাদ থেকে লাফিয়ে ওই ইউপি সদস্য পালিয়ে গেলেও তাঁর সহযোগীকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় পুলিশ। মাদক শুধু একজন ব্যক্তিকে ধ্বংস করে না, তার পরিবার, আশপাশের মানুষ এবং পুরো সমাজকে নৈতিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। মাদক কতো ভয়াবহ বিরূপ প্রভাব ফেলে পরিবারে তাঁর একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত দেশবাসী জানতে পেরেছে শরীয়তপুরের এক সন্তানকে বাবা-মা অতিষ্ঠ হয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সোপর্দ করার মাধ্যমে। সর্বনাশা মাদকের মরণ-ছোবলে সমাজদেহ আজ দুরারোগ্য ক্যান্সার ব্যাধিগ্রস্তের ন্যায় ক্ষত-বিক্ষত। মানবসৃষ্ট এ অভিশাপ যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়েও অনেক বেশি ভয়াবহ, পারমাণবিক অস্ত্রের চেয়েও ঝুঁকিপূর্ণ।
এই সংকটময় সময়ে শুধু রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ভরসা করে থাকলে চলবে না। মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে সামাজিকভাবে। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় সংগঠন, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে তুলতে হবে একটি প্রতিরোধমূলক সংস্কৃতি। সমাজের শিক্ষিত, প্রগতিশীল এবং সুশীল সমাজকে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব নিতে হবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সক্ষমতা বাড়ানো, আদালতে মাদক মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি এবং মাদকাসক্তদের জন্য আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন জরুরি। যেহেতু আমরা এক অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি তাই মাদকের বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একটি জাতীয় ঐক্য। যেখানে সবাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে মাদকের বিরুদ্ধে সম্মিলিত সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।
মো. তাহমিদ রহমান
শিক্ষক ও কলামিস্ট