ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মূল্যস্ফীতি ফের ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার নেপথ্যে

মূল্যস্ফীতি ফের ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার নেপথ্যে

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত রোজায় মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছিল। কিন্তু কয়েক মাসে সেটা আবার বাড়তে শুরু করেছে। এটা অনেক কারণেই হতে পারে। আমি বারবারই একটি কথা বলে এসেছি। বাংলাদেশের বাজারে যেভাবে নগদ অর্থপ্রবাহ হচ্ছে তা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। শেখ হাসিনার আমলে বিশাল বিশাল মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। এ প্রকল্পগুলোকে কেন্দ্র করে একদিকে যেমন দুর্নীতি হয়েছে, অন্যদিকে এসবের সঙ্গে যারা জড়িত পরামর্শক, প্রকৌশলী, ঠিকাদার, শ্রমিকসহ অনেকের কাছে অতিরিক্ত অর্থ এসেছে। এটা গত কয়েক বছরে আমরা যে মূল্যস্ফীতি দেখছি তার একটা বড় কারণ।

উন্নয়নশীল দেশগুলোয় অবকাঠামোগত প্রকল্পের কাজগুলো যখন হয়, তখন সেখানে যে ব্যয় হয় তার ফলে বাজারে প্রচুর টাকা প্রবেশ করে। অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে যে লাভ আসার কথা সেটা খুব ধীরগতিতে আসে। ফলে বাজারে যে পরিমাণ মুদ্রা বা অর্থ প্রবেশ করে সে তুলনায় পণ্য ও সেবা বাজারে প্রবেশ করে না। এ ভারসাম্যহীনতার ফলে মূল্যস্ফীতি হয় এবং এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন। তার ওপর আরও বড় বিষয় যেটা যোগ হয়, সেটা হলো দুর্নীতি। ফলে প্রকল্প ব্যয়ের পরিমাণ দ্বিগুণ, তিনগুণ বৃদ্ধি পায় ইউরোপ, চীন, ভারতের তুলনায়। এটাও একটা কারণ, যার ফলে অতিরিক্ত অর্থ কিছু লোকের কাছে চলে গেছে। এর বাইরেও যেসব দুর্নীতি হয় এর ভেতর দিয়েও কিন্তু অতিরিক্ত অর্থ কারও কাছে চলে যায়। এমন পরিস্থিতিতে যখন বাজারে পণ্য ও পরিষেবা বাড়ছে না; কিন্তু অর্থপ্রবাহ বাড়ছে তখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ খুবই কঠিন। বিদ্যমান মুদ্রানীতি দিয়ে বড় অংকের নগদ অর্থপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ দুরূহ কাজ।

আমাদের আরেকটা জায়গায় দুর্বলতা রয়েছে। কয়েক বছরে প্রচুর অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। বলাই বাহুল্য, সেখানে বাংলাদেশী মুদ্রা পাচার কিন্তু হয়নি। পাচার হয়েছে কিন্তু ডলার, পাউন্ড, ইউরোর মতো হার্ড কারেন্সি। কিন্তু তার পেছনে যে টাকাটা থাকার কথা সেটা কোথায় আছে সেটার খোঁজ আমরা নিচ্ছি না এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকও তা নিয়ে অনুসন্ধান করছে না। তার একটা যথাযথ তদন্ত হলে আমরা কিছুটা জানতে পারব। আরেকটা কথা প্রচার হচ্ছে, সামাজিক মাধ্যমে যে ভারত বাংলাদেশের বাজারে ২ লাখ কোটি টাকা অনুপ্রবেশ করানোর চেষ্টা করছে বা করেছে। এ টাকা বাংলাদেশের নোটের মতোই প্রায়। এ জাল টাকা ধরা খুব কঠিন। এমনভাবে নগদ বা জাল টাকা অনুপ্রবেশ করিয়ে কোনো দেশের অর্থনীতিকে প্রায় পঙ্গু করে দেয়া যায়।

বাংলাদেশের অর্থনীতির আরেকটা বড় সংকট হলো- দায়-দেনা পরিশোধ। এটা করতে গিয়ে বিদেশী ঋণ ও সহায়তার ৮০-৯০ শতাংশ চলে যায়। বৈদেশিক ঋণে আমরা দেশে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারছি না। মূল্যস্ফীতির মূল কথা হলো টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি ও পণ্যের পরিমাণ কমে যাওয়া। এখানে অর্থনীতিতে স্থবিরতা আসার ফলে পণ্যে ও সেবার প্রবাহ কমে গেছে। স্থবিরতাটা আসছে রাজনৈতিক কারণে। বর্তমান সরকার এখন যেটা চেষ্টা করছে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো। আগের যেসব প্রকল্পে বাহুল্য ছিল, সেটাকে ছেঁটে ফেলা। এগুলো হলো রাষ্ট্রীয় অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহারের একটা পদক্ষেপ। কিন্তু তার পাশাপাশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যদি চাঙ্গা করা না যায় তাহলে; কিন্তু আরেক ধরনের স্থবিরতা আসবে। আমাদের প্রবৃদ্ধি হারে অর্থনৈতিক স্থবিরতার চিত্রটা দেখতে পাচ্ছি। স্থবির অবস্থায় টাকার প্রবাহ স্বাভাবিক থাকছে না। ফলে একটা উলটপালট অবস্থা আমরা লক্ষ করছি। আর কিছু হচ্ছে প্রাকৃতিক কারণে- যেমন অতিবৃষ্টি, বন্যা ইত্যাদি। তবে মূল্যস্ফীতি এমন একটা ঘটনা একে সহজে সামলানো যায় না। কথায় আছে, সভ্যতার ইতিহাস হচ্ছে মূল্যবৃদ্ধির ইতিহাস।

আমরা ইতিহাসের গল্পে শুনি, শায়েস্তা খাঁর আমলে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। তার সঙ্গে তুলনা করলে দেখুন আমরা কি পরিমাণ মূল্যস্ফীতিতে আছি। এখন টাকায় আট মণ দূরের কথা আট ছটাক চালও পাওয়া যাবে না। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও মূল্যস্ফীতি থাকে, কিন্তু একটা সীমার বাইরে গেলেই বিপদের কারণ হয়ে ওঠে। স্বাভাবিকভাবে ৩-৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতিকে গ্রহণ করা যায়। এর ওপরে চলে গেলে মানুষের জীবন দুঃসহ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমনটা হয়েছে। এক পর্যায়ে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি দুই অংক ছাড়িয়ে গিয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার এটাকে ৮ শতাংশের ঘরে নামিয়ে এনেছিল। এখন আবার বাড়ছে।

বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির পেছনে সরকারি নিয়োগেরও ভূমিকা দেখছেন কেউ কেউ। উচ্চ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা চাউর আছে। উচ্চ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়োগ বাণিজ্য ও দুর্নীতিও মূল্যস্ফীতিতে ভূমিকা রাখছে। সরকারি উচ্চ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগের মতলবটা আমরা ধরতে পারছি না, কেন তা ঠিক বুঝে আসে না। এমন অবস্থায় আমরা কীভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করব, সেটা এখন বড় প্রশ্ন। আমরা একটা সময় রাজনৈতিক সরকারগুলোকে দায়ী করেছি এটার জন্য। তারা তাদের নেতাকর্মীদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য দুর্নীতি করত। এখন তো অরাজনৈতিক সরকার, এতে বিভিন্ন সেক্টরের সফল ব্যক্তিদের নিয়ে এ সরকার গঠিত হয়েছে। তাদের কোনো রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা থাকার কথা নয়। তাহলে তারা কেন দুর্নীতি করবে? কিন্তু ক্ষমতা এমন বিষয়, সেখানে যদি শক্তির ভারসাম্য না থাকে তাহলে তা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। সেই অপ্রতিরোধ্য অবস্থা থেকেই বড় ধরনের দুর্নীতির জন্ম হয়। বাংলাদেশে এ রকম হচ্ছে বলে সন্দেহ করা যায়। এটার জন্য বস্তুনিষ্ঠ কোনো ডাটা দেওয়া হয়তো সম্ভব নয়। তবে বাইরে থেকে এটার প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে তা বোঝা যায়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত