প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৬ অক্টোবর, ২০২৫
একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তিগত বিপ্লবের অন্যতম বিস্ময়কর এবং সম্ভবত সবচেয়ে বিতর্কিত সংযোজন হলো ‘ক্রিপ্টোকারেন্সি’ বা কৃত্রিম মুদ্রা। ২০০৯ সালে বিটকয়েনের উদ্ভবের মধ্য দিয়ে যে ধারণার সূচনা হয়েছিল, তা আজ এক মহীরুহে পরিণত হয়েছে। এটি কেবল একটি নতুন সম্পদশ্রেণি (Asset Class) নয়, বরং এটি বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থার প্রচলিত কাঠামোকেই আমূল বদলে দেওয়ার এক শক্তিশালী অনুঘটক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ডলার-কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক অর্থনীতি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর একচ্ছত্র ক্ষমতা এবং প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত নিয়মগুলো আজ একবিংশ শতাব্দীর এই ডিজিটাল মুদ্রার কাছে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
আন্তর্জাতিক অর্থনীতির বর্তমান কাঠামোটি মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ব্র্যাটন উডস সিস্টেমের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যা সময়ের সঙ্গে বিবর্তিত হয়ে মার্কিন ডলারকে বিশ্বের প্রধান রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় এবং বৈশ্বিক লেনদেনের প্রায় পুরোটাই আজ SWIFT (Society for Worldwide Interbank Financial Telecommunication) নামক ব্যবস্থার মাধ্যমে এবং ডলারের ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হয়। এই ব্যবস্থাটি কার্যকরী হলেও এটি ধীর, ব্যয়বহুল এবং ভূ-রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল। ক্রিপ্টোকারেন্সি ঠিক এই দুর্বলতাগুলোকেই আঘাত করেছে। ব্লকচেইন প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে নির্মিত এই বিকেন্দ্রীভূত (Decentralized) মুদ্রা ব্যবস্থা কোনো একক দেশ, সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। এর ফলে এটি আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেছে।
প্রথমত, রেমিট্যান্স বা প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে রেমিট্যান্স প্রবাহ তাদের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। কিন্তু প্রচলিত ব্যাংকিং চ্যানেলে এই অর্থ পাঠাতে যে উচ্চ ফি এবং সময় লাগে, তা প্রবাসীদের জন্য একটি বড় বোঝা। ক্রিপ্টোকারেন্সি, বিশেষত স্টেবলকয়েনগুলো (যাদের মূল্য কোনো নির্দিষ্ট মুদ্রার সঙ্গে সংযুক্ত), এই লেনদেনকে প্রায় তাৎক্ষণিক এবং নগণ্য খরচে সম্পন্ন করতে পারে। এটি আন্তর্জাতিক অর্থনীতির তৃণমূল স্তরে এক নীরব বিপ্লব ঘটাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি (Financial Inclusion)। বিশ্বের শত শত কোটি মানুষ এখনও প্রথাগত ব্যাংকিং সেবার বাইরে। কিন্তু তাদের অনেকের কাছেই স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট পৌঁছে গেছে। ক্রিপ্টোকারেন্সি এই ‘ব্যাংকিং সেবাবহির্ভূত’ জনগোষ্ঠীকে সরাসরি বৈশ্বিক আর্থিক সিস্টেমে প্রবেশের সুযোগ করে দিচ্ছে। ডিসেন্ট্রালাইজড ফাইন্যান্স (DeFi) বা বিকেন্দ্রীভূত অর্থায়ন নামক নতুন এই খাতটি মানুষকে ব্যাংক বা মধ্যস্বত্বভোগীর সাহায্য ছাড়াই ঋণ গ্রহণ, বিনিয়োগ এবং সঞ্চয় করার সুবিধা প্রদান করছে, যা প্রচলিত অর্থনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
তবে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির রূপান্তরে ক্রিপ্টোকারেন্সির সবচেয়ে বড় প্রভাব সম্ভবত ভূ-রাজনৈতিক। মার্কিন ডলারের যে একচ্ছত্র আধিপত্য, তাকে আজ সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে এই ডিজিটাল মুদ্রা। কোনো দেশ যখন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে, তখন তাকে বৈশ্বিক বাণিজ্য থেকে একঘরে করে ফেলার প্রধান অস্ত্র হলো SWIFT সিস্টেম থেকে তাকে বাদ দেওয়া এবং ডলারের লেনদেন বন্ধ করা। সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া, ইরান বা উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলো এই নিষেধাজ্ঞা এড়াতে ক্রিপ্টোকারেন্সিকে একটি বিকল্প লেনদেন ব্যবস্থা হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করছে। এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সমীকরণকেই পাল্টে দিচ্ছে। দেশগুলো বুঝতে পারছে যে, ডলারের ওপর অতি-নির্ভরশীলতা তাদের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।
এই নতুন বাস্তবতায় বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও বসে নেই। তারা ক্রিপ্টোকারেন্সির বিকেন্দ্রীভূত চরিত্রকে চ্যালেঞ্জ জানাতে নিজস্ব ডিজিটাল মুদ্রা অর্থাৎ ‘সেন্ট্রাল ব্যাংক ডিজিটাল কারেন্সি’ (CBDC) নিয়ে আসছে। চীনের ডিজিটাল ইউয়ান (e-CNY) ইতিমধ্যেই বহুল প্রচলিত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ডিজিটাল ইউরো নিয়ে কাজ করছে এবং ভারতও ডিজিটাল রুপি চালু করেছে। এটি মূলত ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রযুক্তির সুবিধা গ্রহণ করে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতেই রেখে দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা। এই CBDC -গুলো ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, যা বৈশ্বিক ক্ষমতা কাঠামোকে একটি ‘মাল্টিপোলার’ বা বহুমুখী আর্থিক বিশ্বের দিকে ঠেলে দেবে।
অবশ্য এই রূপান্তরের পথটি কুসুমাস্তীর্ণ নয়। ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রধান দুর্বলতা হলো এর চরম মূল্য অস্থিতিশীলতা (Volatility)। বিটকয়েনের মূল্যের নাটকীয় উত্থান-পতন একে একটি নির্ভরযোগ্য বিনিময় মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে বাধা দেয়। দ্বিতীয়ত, নিরাপত্তা ঝুঁকি। হ্যাকিং, জালিয়াতি এবং অর্থ পাচারের (Money Laundering) মতো অবৈধ কাজে এর ব্যবহার ক্রিপ্টোকারেন্সিকে বিশ্বব্যাপী নীতিনির্ধারকদের কাছে সন্দেহের পাত্র করে তুলেছে। তদুপরি, বিটকয়েনের মতো কিছু ক্রিপ্টোকারেন্সি (যারা ‘প্রুফ-অফ-ওয়ার্ক’ সিস্টেমে চলে) তৈরিতে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হয়, তা পরিবেশবাদীদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই নতুন প্রযুক্তিকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে এক বিশাল বিতর্ক। কিছু দেশ (যেমন এল সালভাদর) একে আইনি মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করেছে, কিছু দেশ (যেমন চীন) একে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেছে, আবার যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো অর্থনৈতিক শক্তিগুলো একে কঠোর নীতিমালার আওতায় আনার চেষ্টা করছে। এই নিয়ন্ত্রণের ধরনই বলে দেবে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে এর চূড়ান্ত ভূমিকা কী হবে।
ক্রিপ্টোকারেন্সি নামক ‘জিন’টি এরইমধ্যে বোতল থেকে বেরিয়ে এসেছে। এটি আন্তর্জাতিক অর্থনীতির প্রতিষ্ঠিত নিয়মগুলোকে যে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে, তা আর ফিরিয়ে নেওয়ার উপায় নেই। এটি ডলারের আধিপত্যকে খর্ব করতে পারে, রেমিট্যান্সের খরচ কমিয়ে আনতে পারে এবং কোটি কোটি মানুষকে আর্থিক সেবার আওতায় আনতে পারে। তবে এর ঝুঁকিগুলোকেও অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশ্ব এখন একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। আগামী দশকটিই নির্ধারণ করে দেবে যে, এই কৃত্রিম মুদ্রা কি প্রচলিত ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে নতুন কিছু তৈরি করবে, নাকি উভয় সিস্টেম একে অন্যের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি হাইব্রিড (Hybrid) বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্ম দেবে। তবে এটা নিশ্চিত যে, প্রযুক্তি, অর্থশাস্ত্র এবং ভূ-রাজনীতির একবিন্দুতে মিলিত হয়ে ক্রিপ্টোকারেন্সি আন্তর্জাতিক অর্থনীতির নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
হেনা শিকদার
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, দর্শন বিভাগ