ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আধুনিক যুগের শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনের পথ

ড. এসএম হাসান মাহমুদ
আধুনিক যুগের শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনের পথ

জব ও ক্যারিয়ারের উন্নতির জন্য একাডেমিক ডিগ্রির পাশাপাশি শিল্পভিত্তিক শিক্ষার গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান সময়ে পৃথিবী দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে এবং সেই সঙ্গে উদ্ভূত হচ্ছে নতুন শিক্ষার ধারণা ও পদ্ধতি; যার মধ্যে অন্যতম হলো মাইক্রো-ক্রেডেনশিয়াল। সহজভাবে, মাইক্রো-ক্রেডেনশিয়াল হলো শর্ট ও ফোকাস্ড কোর্স, যা একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা ও জ্ঞানের উদ্দেশ্যে ডিজাইন করা হয়। এ কোর্সগুলো সাধারণত ডিগ্রি প্রোগ্রামের তুলনায় স্বল্পমেয়াদি, ব্যবহারিক ও কর্মসংস্থানমুখী। একজন শিক্ষার্থী এ কোর্স সম্পন্ন করার পর সনদপত্র বা ডিজিটাল ব্যাজ পাবে, যা শিক্ষার্থীর নির্দিষ্ট দক্ষতা ও জ্ঞানকে স্বীকৃতি দেবে। মাইক্রো-ক্রেডেনশিয়াল সাধারণত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রফেশনাল সংস্থা বা অনলাইন শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। ২০০০ সালের পর অনলাইন শিক্ষার যাত্রা শুরুর ধারাবাহিকতায় বর্তমানে বিভিন্ন আঙ্গিকে মাইক্রো-ক্রেডেনশিয়াল ধারণাটির সূচনা হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এ কোর্সের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো দ্রুত ও স্বল্প খরচে দক্ষতা অর্জন। জনপ্রিয় ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে টেকনোলজি, স্বাস্থ্যসেবা, বিজনেস স্ট্র্যাটেজি, মার্কেটিং ও শিক্ষা। উদাহরণস্বরূপ, প্রোগ্রামিং, ডেটা সায়েন্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং মেশিন লার্নিংয়ের মতো প্রযুক্তিভিত্তিক কোর্সগুলো এখন জরুরি।

বিশ্বব্যাপী শিক্ষার নতুন ধারা: ২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের অনেক উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের পাঠ্যক্রমে মাইক্রো-ক্রেডেনশিয়াল কোর্স অন্তর্ভুক্ত করেছে, যার মধ্যে ৫৩ শতাংশ প্রতিষ্ঠান মাইক্রো-ক্রেডেনশিয়াল কোর্স ক্রেডিট হিসাবে গণ্য করছে। ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে মাইক্রো-ক্রেডেনশিয়াল প্রোগ্রামের উপলব্ধি ৯৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বেশির ভাগ নিয়োগকর্তা বিশ্বাস করেন, মাইক্রো-ক্রেডেনশিয়াল চাকরি আবেদনকারীর দক্ষতা ও যোগ্যতা বাড়িয়ে দেয়, ফলে তারা সনদপ্রাপ্ত প্রার্থীদের জন্য উচ্চ বেতন দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। উত্তর আমেরিকা, এশিয়া-প্যাসিফিক এবং ইউরোপের মতো অঞ্চলে এ কোর্সের জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা, ইনফরমেশন সিকিউরিটি এবং ব্যবসা খাতে এর চাহিদা ব্যাপক। শিক্ষাবিদরা মনে করেন, এ কোর্সগুলোর প্রভাব শিক্ষার্থীদের জন্য ইতিবাচক।

তাছাড়া, ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী মাইক্রো-ক্রেডেনশিয়াল কোর্সে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং এটি আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে করপোরেট মাইক্রোলার্নিং মার্কেট (টাকা) ৫.৪৯ বিলিয়নে পৌঁছানোর পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে, যা ১৩.১৩ শতাংশ বার্ষিক বৃদ্ধির হারসহ বাড়বে। মাইক্রো-ক্রেডেনশিয়াল কোর্সগুলোর প্রতি এ আগ্রহ বাংলাদেশের জন্যও একটি সম্ভাবনা তৈরি করবে, যদিও এর প্রয়োগ এখনো তুলনামূলকভাবে কম। তবে, প্রযুক্তি ও উদ্যোক্তা খাতে এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে এবং ভবিষ্যতে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাতেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

বাংলাদেশে মাইক্রো-ক্রেডেনশিয়াল কোর্স বিকাশের উপায়: বাংলাদেশে মাইক্রো-ক্রেডেনশিয়াল কোর্স সংস্কৃতি গড়ে তুলতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। প্রথমত, সেমিনার, ওয়ার্কশপ ও প্রচারণার মাধ্যমে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এর সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের বিদ্যমান পাঠ্যক্রমে মাইক্রো-ক্রেডেনশিয়াল কোর্স অন্তর্ভুক্তকরণ এবং ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যৌথভাবে কোর্স ডিজাইন, পরিচালনা ও মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকরা কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইন্ডাস্ট্রির প্রয়োজন অনুসারে মার্কেটের চাহিদাসম্পন্ন কোর্স তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারেন। সঙ্গে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম যেমন Coursera edX, Udemy এবং LinkedIn Learning- এর মতো গ্লোবাল প্লাটফর্মের কোর্সগুলোর জন্য শিক্ষার্থীদের এক্সেস বৃদ্ধিকরণ, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষার্থীদের জন্য কোর্সগুলো সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যে প্রদান করা যেতে পারে।

এছাড়া, শিক্ষার্থীদের কোর্স সম্পন্ন হলে মতামত গ্রহণ এবং কোর্সগুলোর ফিডব্যাক পর্যালোচনা করতে হবে। শিক্ষকরা উদ্ভাবন ও ইন্ডাস্ট্রির প্রয়োজন অনুযায়ী কোর্স ডিজাইন এবং শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বাস্তবভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান করে নতুন শিক্ষা পথ তৈরি করতে পারেন। এভাবে মাইক্রো-ক্রেডেনশিয়াল কোর্সের মাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানে গুণগত উন্নতি আনা সম্ভব।

মাইক্রো-ক্রেডেনশিয়াল কোর্স ডিজাইন ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়া: মাইক্রো-ক্রেডেনশিয়াল কোর্স ডিজাইন করতে হলে প্রথমে জব মার্কেটে যে দক্ষতার চাহিদা রয়েছে, তা চিহ্নিতকরণ এবং তার ভিত্তিতে কোর্সের বিষয়বস্তু তৈরি করা প্রয়োজন। কোর্সটি মডুলার ফরম্যাটে তৈরি করা উচিত, যেখানে প্রতিটি মডিউলে নির্দিষ্ট আউটকাম নির্ধারিত থাকবে। এছাড়া, কোর্সে শেখার পদ্ধতি যেমন অনলাইন লেকচার, ভিডিও, ইন্টারঅ্যাকটিভ সেশন ও মূল্যায়ন অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, যা শিক্ষার্থীদের শেখার অভিজ্ঞতাকে আরও বাড়িয়ে দেবে। পাশাপাশি, কোর্সটি সহজে এক্সেসের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে দেওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে, কোর্সটির বিষয়বস্তু অবশ্যই ইন্ডাস্ট্রি চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ এবং শিক্ষার্থীদের জন্য এটি কাজে লাগানোর মতো দক্ষতা অর্জন করবে কিনা, তা দেখা প্রয়োজন। ইন্ডাস্ট্রির সহযোগিতায় কোর্স ডিজাইন করা এবং সার্টিফিকেট প্রদান গুরুত্বপূর্ণ, যাতে এটি বিভিন্ন সেক্টরে স্বীকৃতি পায়। একটি যথাযথ মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা উচিত, যেন কোর্সটি আমেরিকান ও ইউরোপীয় স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী মানসম্মত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রে কোর্সগুলোর মূল্যায়ন করা হয়, তাদের ইন্ডাস্ট্রি চাহিদার সঙ্গে সংগতি, প্রশিক্ষকদের দক্ষতা ও মূল্যায়নের গুণগত মানের ভিত্তিতে। ইউরোপে ইউরোপীয় কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্ক (EQF), ECVET I EQAR-এর মতো সিস্টেমগুলো কোর্সটির মান নিশ্চিত করে, যা ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে স্বীকৃতি পায়। শিক্ষার্থীদের ও নিয়োগকারীদের কাছে থেকে নিয়মিত ফিডব্যাক সংগ্রহ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা কোর্সের প্রাসঙ্গিকতা এবং গুণগত মান বজায় রাখবে। মাইক্রো-ক্রেডেনশিয়াল সার্টিফিকেটের স্থানান্তরযোগ্যতা এবং বিভিন্ন সেক্টরে এর ব্যবহারযোগ্যতা নিশ্চিত করা আবশ্যক। এ নির্দেশিকাগুলো অনুসরণ করলে কোর্সগুলো বাংলাদেশের কর্মসংস্থানে নতুন সুযোগ সৃষ্টি এবং শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তবে নির্দিষ্ট কিছু কোর্সে অংশগ্রহণ করতে প্রাথমিক কিছু দক্ষতা বা জ্ঞানের প্রয়োজন হতে পারে, যা কিছু শিক্ষার্থীর জন্য চ্যালেঞ্জিং। সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা প্রয়োজন অনুসারে প্রি-রিকুইজিট নলেজ অর্জন করলে সহজে কোর্স সম্পন্ন করতে পারবে।

ড. এসএম হাসান মাহমুদ

অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর

ডিপার্টমেন্ট অব সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত