প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৮ অক্টোবর, ২০২৫
জাতি হিসেবে আমরা এক গভীর আত্মবিস্মৃতির অন্ধকারে নিমজ্জিত। আমাদের মধ্যে আছে সীমাহীন মেধা, কর্মদক্ষতা, ধর্মীয় চেতনা, সহনশীলতা ও পরিশ্রমের অসাধারণ ঐতিহ্য; কিন্তু সেই শক্তিগুলোকে একত্র করে রাষ্ট্রগঠন ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণের যে প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি ও আত্মসমালোচনার সাহস প্রয়োজন, তা আমাদের চেতনা থেকে প্রায় লুপ্ত। আমাদের সভ্যতার কাঠামো এখন এমন এক আলোকিত; কিন্তু ভিতহীন দালান, যার বাইরে আছে জৌলুস, কিন্তু ভেতরে শূন্যতা, বিচ্ছিন্নতা আর আত্মঅবচেতনের দীর্ঘ ছায়া। এই দুর্বলতা কোনো কাকতালীয় ব্যর্থতা নয়, বরং এটি আমাদের দীর্ঘদিনের মানসিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অনুশাসনের অভাবের প্রতিফলন। আমরা জানি কী ন্যায়; কিন্তু অন্যায়ের কাছে নত হই; জানি কে প্রতারক, তবুও তার অনুসারী হই। আমাদের সমাজে অযাচিত আনুগত্যের সংস্কৃতি এমনভাবে প্রোথিত যে, নেতৃত্বের জবাবদিহির প্রশ্ন তুললেই সেটি বিদ্রোহ হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই সংস্কৃতি জন্ম দিয়েছে এক নৈতিক অন্ধত্ব, যেখানে নেতৃত্ব ব্যক্তিত্বে পরিণত হয় দেবতায়, এবং নাগরিক চেতনা পরিণত হয় নীরব দাসত্বে।
আমাদের ইতিহাস প্রমাণ করে, প্রতিবার আমরা আবেগে ভেসে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যুক্তিতে নয়। রাজনীতিতে, ধর্মে, সামাজিক জীবনে আমরা মানুষ নয়- প্রতীক বেছে নিই। এই প্রতীকের পূজাই আমাদের চিন্তাশক্তিকে অবশ করে ফেলেছে। নেতৃত্ব ব্যর্থ হলেও আমরা তার ব্যর্থতাকে ব্যাখ্যা দিয়ে ঢাকি; অন্যায় করলেও আমরা তার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাই। এর ফলে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি ধ্বংস হয়েছে, ন্যায়ের ধারণা বিকৃত হয়েছে, আর নাগরিক চেতনা পরিণত হয়েছে অনুগত ভক্তির কাঠামোয়।
আমরা যে জাতি ইতিহাসের প্রতি অকৃতজ্ঞ, তা আজ আর অস্বীকার করার উপায় নেই। আমাদের রাজনৈতিক স্মৃতি ক্ষণস্থায়ী, আমাদের নৈতিক স্মৃতি ভঙ্গুর। বারবার প্রতারিত হয়েও আমরা একই প্রতারকের কাছে ফিরে যাই, যেন প্রতারণা আমাদের ভাগ্য, আর আত্মপ্রবঞ্চনা আমাদের প্রিয় অভ্যাস। এই আত্মপ্রবঞ্চনার সংস্কারই আমাদের জাতীয় মুক্তির পথে প্রধান অন্তরায়। জাতি যদি নিজেকে প্রতারিত জানার পরও প্রতারককে ক্ষমা করে দেয়, তবে তার পতন অনিবার্য।
২০২৫ সালের জুলাই-আগস্টের বিপ্লব নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক মোড়। কিন্তু বিপ্লব কেবল নেতৃত্বের পরিবর্তন নয়; এটি মূল্যবোধের রূপান্তর, মানসিক নবজাগরণ। যদি এই পরিবর্তন শুধু ক্ষমতার হাতবদলে সীমিত থাকে, যদি এর ভেতর না জন্ম নেয় নৈতিক বোধ, আত্মসমালোচনা ও প্রজ্ঞা- তাহলে সেই বিপ্লবও ইতিহাসের আরেকটি প্রহসন হয়ে থাকবে। আমরা এরমধ্যেই বহু প্রহসন দেখেছি; এখন প্রয়োজন সত্যিকারের জাগরণ- যেখানে পরিবর্তন হবে মনের, নীতির ও রাষ্ট্রচিন্তার।
বাংলাদেশের নেতৃত্ব আজ এমন এক সংকটে, যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্ব আর নৈতিক ক্ষয় একে অপরের পরিপূরক। ক্ষমতার জন্য তাদের লড়াই যতই তীব্র হোক, নীতির জন্য তাদের দৃঢ়তা ততটাই ক্ষীণ। তারা জানে না কে মিত্র, কে প্রতারক; তারা বুঝেও বুঝতে চায় না রাষ্ট্রের কল্যাণ আর ব্যক্তিস্বার্থের মধ্যে পার্থক্য কোথায়। এই অন্ধ নেতৃত্ব কেবল নিজেদের নয়, সমগ্র জাতিকে বিপথে ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের জাতির আরেক ভয়ংকর বৈশিষ্ট্য হলো বিস্মৃতি। আমরা প্রতারণা ভুলে যাই, দুঃখ ভুলে যাই, এমনকি ইতিহাসের রক্তাক্ত শিক্ষা ভুলে যাই। ফলে একের পর এক পুনরাবৃত্ত ব্যর্থতা আমাদের জাতীয় জীবনের অংশ হয়ে গেছে। এই স্মৃতিহীনতার সুযোগে দুর্নীতি, প্রতারণা ও স্বেচ্ছাচার আমাদের সমাজের অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়েছে। জাতির স্মৃতি যেন এক মরুভূমির ধূলিকণা- যা মুহূর্তেই ঝড়ে উড়ে যায়, কিন্তু কোনো শিকড় তৈরি করে না। পাশ্চাত্য সমাজে রাষ্ট্রচিন্তা ও নাগরিক চেতনার মধ্যে যে সম্পর্ক, সেটিই তাদের উন্নতির মূল রহস্য। সেখানে জনগণই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক; নেতৃত্ব কেবল দায়বদ্ধ সেবক। কিন্তু আমাদের বাস্তবতায় নেতৃত্বই সর্বশক্তিমান, আর জনগণ পরিণত হয়েছে নিঃশব্দ দর্শকে। এই বিপরীত বাস্তবতা আমাদের গণতন্ত্রকে রক্তশূন্য করে ফেলেছে। জবাবদিহিহীন নেতৃত্ব যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন রাষ্ট্রযন্ত্র পরিণত হয় ভয়ঙ্কর এক দানবে- যা শেষ পর্যন্ত জনগণকেই গ্রাস করে। আমরা এখন এমন এক অবস্থায় দাঁড়িয়ে, যেখানে নির্বাচন মানে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা, জনগণের মুক্তি নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নির্বাচন নীতি নয়, কৌশল; আদর্শ নয়, অর্জনের হাতিয়ার। গণতন্ত্রের চেহারা রয়ে গেছে, কিন্তু আত্মাবিলীন। অথচ নির্বাচন শুধু রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়- এটি জাতির আত্মসমালোচনার সুযোগ, রাষ্ট্রচিন্তার পুনর্গঠনের মুহূর্ত। কিন্তু আমাদের রাজনীতি সেই আত্মসমালোচনার জায়গা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে।
এই ব্যর্থতা কেবল নেতৃত্বের নয়, গোটা সমাজের। কারণ, কোনো নেতা তখনই স্বৈরাচারী হয়, যখন জনগণ নীরব থাকে। কোনো অন্যায় তখনই রাষ্ট্রীয় রূপ নেয়, যখন মানুষ ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে ভয় পায়। আজ আমাদের সমাজে ন্যায়ের দাবি যতটা কম, ততটাই বেড়েছে আপোষের সংস্কৃতি। সবাই জানে রাষ্ট্রের গভীরে পচন ধরেছে, কিন্তু কেউ মুখ খোলে না। এই নীরবতা আসলে এক ধরনের অনুমোদন, যা অন্যায়কে বৈধতা দেয়।
বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই রাষ্ট্রের ভিত্তি নির্মাণ করেছে। তাদের রক্তে, ঘামে, আত্মত্যাগে গড়ে উঠেছে এই দেশের সভ্যতা। অথচ তাদের ভাগ্যের নিয়ন্তা হয়ে উঠেছে এক ক্ষুদ্র স্বার্থান্ধ শ্রেণি, যারা রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে নিজেদের দখলে রেখেছে। তারা দেশের সম্পদ ভোগ করে, কিন্তু জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ নয়। এই অসম সামাজিক কাঠামো ভাঙতে না পারলে কোনো বিপ্লবই স্থায়ী হবে না।
আমাদের দরকার নতুন এক সমাজদর্শন- যেখানে ন্যায়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে, যেখানে শাসন নয়, সেবা হবে নেতৃত্বের মূলনীতি। এমন এক সমাজ যেখানে চিন্তা হবে মুক্ত, মনন হবে বিশ্লেষণমূলক, আর নৈতিকতা হবে প্রতিটি সিদ্ধান্তের ভিত্তি। রাষ্ট্র তখনই টিকে থাকবে, যখন নাগরিকদের চিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে; যখন ভয় নয়, প্রজ্ঞা হবে সিদ্ধান্তের চালিকাশক্তি।
তরুণ প্রজন্মের কাঁধেই এখন জাতির ভবিষ্যৎ। তারা যদি এই আত্মবিবেচনার পথে হাঁটে, যদি ইতিহাসের প্রতারণা থেকে শিক্ষা নেয়, তবে এই দেশ বদলাতে বাধ্য। কিন্তু তরুণদের শক্তি আজ বিভক্ত দলে, বিভ্রান্ত আদর্শে, প্রলোভনের রাজনীতিতে। তাদের মুক্ত করতে হবে এই বিভাজন থেকে। তরুণদের হাতে দিতে হবে চিন্তার স্বাধীনতা, নৈতিক দৃঢ়তা এবং সমালোচনামূলক সাহস। কারণ পরিবর্তনের সূচনা সবসময় মনের মধ্যেই ঘটে, অস্ত্র বা আন্দোলনে নয়।
রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় আনতে হবে নৈতিক দর্শনের পাঠ, প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি, আর রাজনীতিতে আদর্শনিষ্ঠ নেতৃত্বের মানদ-। মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবী সমাজকেও এই সংস্কারের অংশ হতে হবে, কারণ চিন্তার দিকনির্দেশনা ছাড়া বিপ্লব অন্ধ হয়ে পড়ে।
অবশেষে বলতে হয়- জাতির মুক্তি কোনো দান নয়, এটি অর্জনের বিষয়। আর সেই অর্জনের প্রথম শর্ত আত্মবিবেচনা। যতক্ষণ না আমরা নিজেদের অন্ধত্ব, ভীরুতা ও আত্মপ্রবঞ্চনার সংস্কৃতি ভাঙতে পারছি, ততক্ষণ কোনো পরিবর্তনই স্থায়ী হবে না।
জাতি এখন এক ভয়াবহ সন্ধিক্ষণে- একদিকে ইতিহাসের ব্যর্থতা, অন্যদিকে সম্ভাবনার আহ্বান। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই: আমরা কি আবারও একই চক্রে ঘুরব, নাকি নতুন এক চেতনার জন্ম দেব? উত্তর আমাদের হাতেই। আমরা যদি সত্যিই বলতে পারি, ‘আর প্রতারণা নয়, আর নীরবতা নয়,’ তবে এই অন্ধকারেই আলো জন্ম নেবে। জাতির পুনর্জন্ম শুরু হবে তখনই, যখন আমরা নিজেরাই নিজেদের বিচার করতে শিখব- চিন্তায়, বিবেকে, ন্যায়ে এবং প্রজ্ঞায়। কারণ একমাত্র আত্মবিবেচনাই পারে এই নিঃসার আবর্ত থেকে জাতিকে মুক্ত করে একটি ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক ও প্রজ্ঞামণ্ডিত রাষ্ট্রের পথে এগিয়ে নিতে।