ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

নাগরিকদের আইন সম্পর্কে ধারণা রাখা প্রয়োজন

মো. নূর হামজা পিয়াস, কলামিস্ট ও সমাজকল্যাণ বিশ্লেষক, শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
নাগরিকদের আইন সম্পর্কে ধারণা রাখা প্রয়োজন

আইন-কানুন মেনে চলার মাধ্যমেই একটি সমাজে শৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। যখন নাগরিকরা নিজেদের আচরণকে আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত রাখতে শেখে, তখন সামাজিক ভারসাম্য বজায় থাকে। আইন মানুষকে সীমার মধ্যে রাখে, যাতে কেউ অন্যের অধিকার লঙ্ঘন না করে। আইন অমান্য করা শুধু অপরাধ নয়, বরং সামাজিক অবক্ষয়ের পথ খুলে দেয়। তাই রাষ্ট্রের টেকসই উন্নয়ন এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রত্যেক নাগরিকের আইন সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি।

একটি সচেতন সমাজে অপরাধের প্রবণতা কম থাকে। কারণ আইন সম্পর্কে জানলে মানুষ জানে কী করা উচিত, কী নয়। বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরের ২০২৫ সালের তথ্যানুসারে, যেসব এলাকায় আইনি সচেতনতা কর্মসূচি পরিচালিত হয়েছে, সেখানে ছোটখাটো অপরাধের হার ৩১ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। এটি প্রমাণ করে যে সচেতনতা অপরাধ প্রতিরোধের অন্যতম কার্যকর হাতিয়ার। আইন জানলে মানুষ ভয় নয়, দায়িত্ববোধ থেকে শৃঙ্খলিত হয়, যা ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের মূল চাবিকাঠি।

মানুষের নিজের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে জ্ঞান থাকলে সে সহজেই অন্যায়, প্রতারণা ও শোষণ থেকে রক্ষা পায়। অনেকেই জানেন না তাদের শ্রম, ভোট, কিংবা মতপ্রকাশের অধিকার সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত। ফলে তারা অন্যের শোষণের শিকার হয়েও বুঝতে পারেন না। ২০২৫ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে প্রতি পাঁচজন নাগরিকের মধ্যে তিনজন মৌলিক অধিকার সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা রাখেন না। এই অজ্ঞতা শোষকদের জন্য সুযোগ তৈরি করে দেয়। তাই অধিকার জানা মানেই আত্মরক্ষার প্রথম ধাপ।

আইন সম্পর্কে জানলে নাগরিকরা শুধু নিজের সুরক্ষাই নয়, রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডেও অংশ নিতে পারে। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বাংলাদেশ একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। ভোটাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও তথ্যের অধিকার এসবই নাগরিকদের মৌলিক ক্ষমতা। ২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, যেসব নাগরিক আইন সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ বা সেমিনারে অংশ নিয়েছেন, তাদের মধ্যে ভোটার অংশগ্রহণের হার ৭৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে আইনি সচেতনতা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে। আইন একটি বিশাল বিষয় এবং সাধারণ নাগরিকের পক্ষে সব আইন জানা সম্ভব নয়। তবে, তাদের জন্য ব্যবহারিক আইনের জ্ঞান অর্জন করা জরুরি। যেমন- পারিবারিক আইন, সম্পত্তি আইন, ভোক্তা অধিকার আইন এবং শ্রম আইন। স্কুল ও কমিউনিটি পর্যায়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই আইনগুলোকে শ্রেণিবিন্যাস করে সরল ভাষায় বোঝানো উচিত। একজন শ্রমিক তার শ্রমের অধিকার জানলে, একজন ভোক্তা তার অধিকার জানলে এবং একজন সাধারণ মানুষ সম্পত্তি ক্রয়ের নিয়ম জানলে, তারা দৈনিক জীবনে প্রতারণা ও শোষণের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারেন। আইন সম্পর্কে অজ্ঞ মানুষ সহজেই অন্যের শোষণের শিকার হয়। দালাল চক্র, প্রতারক ও দুর্নীতিবাজরা এই অজ্ঞতাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। জমি, সম্পত্তি বা শ্রমের অধিকারের মামলা থেকে শুরু করে নারী নির্যাতন পর্যন্ত সবখানেই দেখা যায়, আইন না জানার ফলে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। ২০২৫ সালে লিগ্যাল এইড বোর্ডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদালতে জমা হওয়া মামলার ৪০ শতাংশই এমন মানুষদের, যারা প্রাথমিক আইনি পরামর্শ পাননি। এই বাস্তবতা পরিবর্তনে আইনি শিক্ষার প্রসার এখন সময়ের দাবি। আইন জানা শুধুমাত্র আইনজীবীদের কাজ নয়; এটি প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব। এজন্য স্কুল ও কলেজ পর্যায় থেকেই আইন ও নাগরিক দায়িত্ববোধের মৌলিক শিক্ষা থাকা জরুরি। শিক্ষার্থীরা যদি ছোটবেলা থেকেই জানে তাদের অধিকার ও কর্তব্য কী, তবে তারা ভবিষ্যতে সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে। ২০২৫ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল পর্যায়ে ‘নাগরিক শিক্ষা’ বিষয়টি নতুনভাবে চালু করেছে, যার লক্ষ্য তরুণ প্রজন্মকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলা। এটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ হলেও কার্যকর বাস্তবায়নই নির্ধারণ করবে এর সফলতা।

আইন সাধারণত খুবই জটিল ও কঠিন ভাষায় লেখা হয়, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা অসম্ভব। এই জটিলতাই জনগণকে আইন থেকে দূরে রাখে। সরকারের উচিত আইনের ভাষা সহজীকরণ এবং সব গুরুত্বপূর্ণ আইনের সারসংক্ষেপ সহজ বাংলায় প্রকাশ করা। আইনি সহায়তা প্রদানকারী সংস্থাগুলোকেও জনগণের বোধগম্য ভাষায় আইনি পরামর্শ দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা উচিত। আইন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। টেলিভিশন, রেডিও, অনলাইন পোর্টাল কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সব জায়গায় নিয়মিতভাবে আইন বিষয়ক সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান ও প্রতিবেদন প্রচার করা গেলে তা জনগণের মনে স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের ২০২৫ সালের জরিপে দেখা গেছে, আইনি সচেতনতা বিষয়ক সংবাদ নিয়মিত পড়া নাগরিকদের মধ্যে ৬২ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তারা আইনি পরামর্শ নিতে ভয় পান না। অর্থাৎ গণমাধ্যম মানুষকে ভয় নয়, সাহসী করে তুলতে পারে।

আইন শুধু কাগজে নয়, বাস্তব জীবনে প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন সামাজিক উদ্যোগ। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও এনজিও এরইমধ্যে ‘আইন জানো, অধিকার জানো’ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণ জমি, উত্তরাধিকার, বাল্যবিবাহ বা যৌতুক সংক্রান্ত বিষয়ে সচেতন হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্রগুলোতেও আইন সহায়তা বুথ চালু করা হয়েছে। ২০২৫ সালে সরকারের ‘ডিজিটাল আইনি সহায়তা সেবা’ অ্যাপটি চালু হওয়ার পর প্রায় ৪ লাখ মানুষ বিনামূল্যে আইনি পরামর্শ নিয়েছেন, যা এক ইতিবাচক দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশে অনেক নারী এখনও জানেন না তারা যৌতুক, নির্যাতন বা কর্মক্ষেত্রে হয়রানির বিরুদ্ধে আইনি প্রতিকার পেতে পারেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এই দুই আইনের অধীনে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৮ হাজার অভিযোগ দাখিল হয়েছে, কিন্তু মামলা করেছেন মাত্র ৫ হাজার নারী। এর কারণ, অধিকাংশ নারী জানেন না কীভাবে ন্যায়বিচার চাইতে হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত