প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৯ অক্টোবর, ২০২৫
বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান- স্কুল, কলেজ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আজ এক গভীর নৈতিক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সামান্য কথাকাটাকাটি, হালকা মতবিরোধ কিংবা তুচ্ছ কোনো বিষয়কে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ, মারামারি, এমনকি প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি ভাঙচুরের মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। যেখানে জ্ঞানচর্চার আলো ছড়ানোর কথা, সেখানে আজ ধোঁয়ার কুণ্ডলী, ভাঙা চেয়ার-টেবিল, আতঙ্কিত মুখ আর পুলিশের সাইরেন। এই বাস্তবতা যেন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, আমরা কোনো গভীর অসুখে ভুগছি।
এই অবক্ষয়ের মূল কারণ খুঁজলে প্রথমেই চোখে পড়ে ‘নৈতিক শিক্ষার অভাব’। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রযুক্তি, প্রতিযোগিতা ও পরীক্ষার ফলাফলের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হলেও, মানুষ হিসেবে শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠনের দিকটি মারাত্মকভাবে অবহেলিত। এই বাস্তবতা আমাদের এক গভীর প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়, ‘আমরা কি আসলেই শিক্ষা দিচ্ছি, নাকি কেবল সার্টিফিকেট দিচ্ছি?’
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিগত কয়েক বছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহিংসতার যে প্রবণতা দেখা গেছে, তা একটি সামাজিক রোগে রূপ নিয়েছে। সব ঘটনার মধ্যে মিল একটাই- তুচ্ছ বিষয়, কিন্তু পরিণতি ভয়াবহ। সমাজের একদা ‘সেরা সন্তান’ হিসেবে বিবেচিত শিক্ষার্থীরাই আজ হয়ে উঠছে বিশৃঙ্খলার বাহক।
এই পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি। এর শিকড় ছড়িয়ে আছে সমাজ, পরিবার, শিক্ষাব্যবস্থা এবং রাজনীতির গভীরে। সন্তান আজকাল ‘কীভাবে ভালো মানুষ হওয়া যায়’ তা শেখে না, বরং শেখে ‘কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়’। বাবা-মা অনেক সময় সন্তানের চরিত্র নয়, ফলাফল নিয়ে বেশি চিন্তিত। সন্তান যদি পরীক্ষায় প্রথম হয়, তাহলেই সে ভালো, এই ধারণা আমাদের সমাজে গভীরভাবে গেঁথে গেছে। অথচ, সে যদি মিথ্যা বলে, অসভ্য আচরণ করে বা অন্যকে অসম্মান করে সেগুলোকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এর ফলেই গড়ে উঠছে এক নৈতিকভাবে দেউলিয়া প্রজন্ম।
আমাদের পাঠ্যক্রমে এখনও নৈতিক শিক্ষা, মানবিকতা বা জীবনদর্শন শেখানোর বাস্তব ব্যবস্থা নেই। ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ বই থাকলেও সেটি মুখস্থনির্ভর; শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার জন্য পড়ে, জীবনের জন্য নয়। শিক্ষকও অনেক সময় শুধু পরীক্ষার ফলাফল নিয়েই ব্যস্ত। নৈতিকতার বিষয়টি পাঠ্যবইয়ের পাতায় বন্দি, ব্যবহারে নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র রাজনীতি একসময় ছিল মতাদর্শের চর্চার স্থান। সব জায়গায় এখন তা পরিণত হয়েছে ক্ষমতার লড়াইয়ের মঞ্চে। কে কোন হল দখল করবে, কে কার পক্ষে, কে কোন গ্রুপে এসব নিয়ে সংঘর্ষ, এমনকি প্রাণহানি ঘটছে। রাজনীতির মাধ্যমে সামাজিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠার পরিবর্তে, সেখানে তৈরি হচ্ছে ভীতিকর ‘দখল সংস্কৃতি’। শিক্ষকরা অনেকে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায় নিরপেক্ষ প্রশাসনিক ভূমিকা পালন করতে পারছেন না।
ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউব- এই সব প্ল্যাটফর্ম শিক্ষার্থীদের সামাজিক সংযোগ বাড়ালেও, নৈতিক সচেতনতা কমিয়েছে। এখন ‘ভাইরাল’ হওয়াই অনেকের কাছে লক্ষ্য। অনলাইন তর্ক দ্রুত বাস্তব সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে। একদল অন্য দলকে ট্রল করে, অপমান করে, তারপর শুরু হয় বাস্তব জীবনে প্রতিশোধের দৌড়।
পুরো সমাজ এখন এক ধরনের অসহিষ্ণুতা ও অসহনীয় তাড়াহুড়োর মধ্যে বেঁচে আছে। রাস্তায়, অফিসে, সংসারে- সবখানেই মানুষ উত্তেজিত, হিংস্র। শিক্ষার্থীরাও সেই সমাজের অংশ। তারা শিখছে ‘বিতর্ক নয়, ধাক্কা দাও; তর্ক নয়, আঘাত করো’ এই মনোভাব।
নৈতিকতার সংকট মানে শুধু পাপ বা অপরাধ নয়, এর মানে হলো ‘ভালো কাজের প্রেরণা হারানো’। আজকের শিক্ষার্থী জানে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গণিত, কিন্তু জানে না কীভাবে অন্যের কষ্টে কষ্ট পাওয়া যায়। একজন সহপাঠী পড়ে গেলে সাহায্য করার চেয়ে, ভিডিও করে অনলাইনে আপলোড করা এখন বেশি জনপ্রিয়। এই মানসিকতা ভয়ংকর। আমাদের সমাজ একসময় ‘গুরুজনকে সম্মান’, ‘মিথ্যা না বলা’, ‘অন্যের প্রতি সহমর্মিতা’ এসব মূল্যবোধের ওপর দাঁড়িয়েছিল। এখন সেই জায়গাগুলো শূন্য।
নৈতিকতার অবক্ষয় শুরু হয় ক্ষুদ্র জায়গা থেকে একটু মিথ্যা বলা, অন্যের প্রতি অসম্মান, অন্যায়ের প্রতিবাদ না করা। আর এই ছোট ছোট অবক্ষয় একত্রে তৈরি করে বড় বিপর্যয়। একজন শিক্ষক শুধু পাঠদানকারী নন, তিনি শিক্ষার্থীর চিন্তার দিশারি। কিন্তু আজ অনেক শিক্ষক নৈতিক ও বৌদ্ধিক দায়িত্ব থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক চাপ, প্রশাসনিক অসহযোগিতা, কিংবা নিজস্ব নিরাপত্তা- সব মিলে তারা ‘নীরব শিক্ষক’-এ পরিণত হয়েছেন। শিক্ষকরা যদি নৈতিকতার মানদ- না দেখান, তাহলে শিক্ষার্থীরা অনুসরণ করবে কাকে? একজন সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও মানবিক শিক্ষক পুরো শ্রেণিকক্ষের মানসিকতা বদলে দিতে পারেন। তাই শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও মূল্যবোধভিত্তিক পাঠদান এখন সময়ের দাবি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর এই সহিংসতা শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নয়; এটি গোটা সমাজের প্রতিফলন। আমরা এক এমন যুগে বাস করছি, যেখানে নৈতিকতা এখন বাজারজাত পণ্য, যার দাম আছে শুধু ব্যবহারিক প্রয়োজনে। সামাজিক অসমতা, বেকারত্ব, রাজনৈতিক বিভাজন এবং প্রযুক্তির বিভ্রম- সবকিছু মিলে তরুণদের মধ্যে জন্ম দিয়েছে বিভ্রান্তি ও হতাশা। যখন কোনো শিক্ষার্থী বিশ্বাস হারায় ‘ন্যায় করে কিছু পাওয়া যায় না’, তখন সে সহিংসতার পথে হাঁটে।
এই অবক্ষয় ঠেকাতে এখনই বড় ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষাক্রমে ‘নৈতিক শিক্ষা’কে পাঠ্যবইয়ের একটি অংশ নয়, বরং প্রতিদিনের চর্চার অংশ করতে হবে। স্কুলে সকাল সমাবেশে মানবিক গল্প, অনুকরণযোগ্য উদাহরণ, বিতর্ক ও সংলাপ আয়োজন করতে হবে। অভিভাবকদের বুঝতে হবে, সন্তানের আচরণই তার আসল শিক্ষা। তাই পরিবারে সহানুভূতি, দায়িত্ববোধ ও ভালোবাসার চর্চা বাড়াতে হবে। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ নয়, কিন্তু সেটিকে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও নেতৃত্বের প্রশিক্ষণমুখী করতে হবে। ক্যাম্পাসে দলীয় প্রভাবের পরিবর্তে নীতিনিষ্ঠ নেতৃত্ব গঠনের সুযোগ তৈরি করতে হবে। প্রতিটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মনো-পরামর্শক ইউনিট থাকা জরুরি। তরুণদের রাগ, হতাশা বা মানসিক চাপে সহায়তা করার মতো পরিবেশ তৈরি করতে হবে। যুবসমাজের জন্য অনলাইন আচরণবিধি তৈরি ও বাস্তবায়ন করতে হবে। মিডিয়া লিটারেসি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত। যে প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত সহিংসতা হয়, সেখানে শিক্ষক-প্রশাসনের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের নৈতিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিও সময়ের দাবি।
আমরা হয়তো উন্নয়নের কথা বলি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি; কিন্তু যদি শিক্ষার্থীরা মানুষ হওয়ার শিক্ষা না পায়, তাহলে সেই স্বপ্ন কাগজে আটকে থাকবে। শিক্ষা মানে কেবল পাস করা নয়; শিক্ষা মানে সহনশীল হওয়া, ন্যায়পরায়ণ হওয়া, অন্যকে সম্মান করা। আজ সময় এসেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আবার মানুষ গড়ার কারখানায় পরিণত করার। নৈতিকতার আলো নিভে গেলে শুধু শ্রেণিকক্ষ অন্ধকার হয় না, অন্ধকার হয় একটি জাতির ভবিষ্যৎও।
তরুণ প্রজন্ম আমাদের ভবিষ্যৎ। তাদের হাতে বইয়ের বদলে যদি অস্ত্র, জ্ঞানের বদলে যদি হিংসা চলে আসে, তবে সেটা শুধু একটি প্রজন্ম নয়, একটি জাতির পতন। তাই এখনই প্রয়োজন নতুন এক নৈতিক জাগরণ, যেখানে শিক্ষা শুধু পেশার পথ দেখাবে না, দেখাবে মানুষ হওয়ার পথও।