ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

এনইআইআরের আড়ালে রাষ্ট্রের নতুন চোখ

মো. শামীম মিয়া
এনইআইআরের আড়ালে রাষ্ট্রের নতুন চোখ

বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাত এখন এক নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ১৬ ডিসেম্বর থেকে চালু হচ্ছে ন্যাশনাল ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (এনইআইআর)-একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেস বা প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে দেশের প্রতিটি মোবাইল হ্যান্ডসেটের আইএমইআই নম্বর জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও ব্যবহৃত সিম নম্বরের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। অর্থাৎ, কে কোন ফোন ব্যবহার করছে, সেটি এখন থেকে রাষ্ট্রের জানা থাকবে। সরকারের ভাষায় এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যা টেলিযোগাযোগ খাতে স্বচ্ছতা আনবে, অবৈধ হ্যান্ডসেটের ব্যবহার বন্ধ করবে এবং নিরাপত্তা বাড়াবে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এই উদ্যোগ কি সত্যিই নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, নাকি নাগরিক স্বাধীনতার ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের নতুন অধ্যায় খুলে দেবে?

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, এনইআইআর চালুর মাধ্যমে দেশের টেলিকম খাত এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করবে। এটি এমন একটি ব্যবস্থা, যা প্রতিটি ফোনের আইএমইআই নম্বরকে ব্যবহারকারীর জাতীয় পরিচয়পত্র ও সিমের সঙ্গে যুক্ত করবে। ফলে বৈধ ও অবৈধ ফোন সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব হবে। সরকার আশা করছে, এই ব্যবস্থা চালু হলে অবৈধভাবে আমদানিকৃত বা নকল ফোনের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে, সরকার রাজস্ব ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে, দেশীয় মোবাইল উৎপাদন শিল্প সুরক্ষিত হবে, এবং চুরি বা অপরাধমূলক কাজে ব্যবহৃত ফোন সহজে ব্লক করা যাবে।

সরকারি যুক্তিতে এই পদক্ষেপের সুফল অনেক। প্রথমত, অবৈধ মোবাইল আমদানির কারণে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারায় রাষ্ট্র। এই উদ্যোগে তা বন্ধ করা গেলে রাষ্ট্রীয় আয় বৃদ্ধি পাবে। দ্বিতীয়ত, এটি অপরাধ দমনে সহায়ক হবে- কারণ চুরি করা ফোন বা অপরাধে ব্যবহৃত ডিভাইসের তথ্য দ্রুত শনাক্ত করা যাবে। তৃতীয়ত, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের জালিয়াতি, সিম প্রতারণা বা স্ক্যাম কার্যকরভাবে রোধ করা সম্ভব হবে। চতুর্থত, এনইআইআর চালুর ফলে দেশীয় মোবাইল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন- ওয়ালটন, সিম্ফনি, টেকনো ইত্যাদি নতুন করে প্রতিযোগিতার সুযোগ পাবে, কারণ বিদেশ থেকে অবৈধভাবে আনা ফোন তখন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে।

অর্থাৎ, সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এটি শুধু একটি প্রযুক্তিগত আপগ্রেড নয়, বরং একটি অর্থনৈতিক সুরক্ষা বলয়। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) বলছে, চারটি অপারেটর- গ্রামীণফোন, রবি আজিয়াটা, বাংলালিংক ও টেলিটক-এর ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (ইআইআর) সিস্টেমকে কেন্দ্রীয় এনইআইআরের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে, যাতে সব ফোনের তথ্য এক জায়গায় থাকে। এতে করে প্রতিটি ফোনের অবস্থান, ব্যবহার ও মালিকানা ট্র?্যাক করা সম্ভব হবে। তবে এর ইতিবাচক দিকের পাশাপাশি রয়েছে বেশ কিছু গুরুতর উদ্বেগের বিষয়ও। নাগরিকের গোপনীয়তার সংকট। এনইআইআর চালু হলে প্রতিটি ফোন, তার ব্যবহারকারী, অবস্থান, কল ইতিহাস, ইন্টারনেট ব্যবহার- সব তথ্য সরকারের একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেসে সংরক্ষিত থাকবে। প্রশ্ন হলো, এই তথ্যগুলো কতটা নিরাপদ থাকবে এবং কে এই ডাটার এক্সেস পাবে? বাংলাদেশে অতীতের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, সরকারি ডাটাবেসে তথ্য ফাঁস বা অপব্যবহার প্রায়ই ঘটে। যদি এনইআইআরের তথ্য কোনোভাবে অপব্যবহার হয়, তবে নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও স্বাধীনতা ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রাজনৈতিক অপব্যবহারের আশঙ্কা। সরকারের হাতে থাকা এমন শক্তিশালী নজরদারি ব্যবস্থা ভবিষ্যতে রাজনৈতিক বিরোধী, সাংবাদিক বা মানবাধিকারকর্মীদের ওপর নজরদারির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। একটি কল, একটি মেসেজ বা ফোনের অবস্থান বিশ্লেষণ করে যে কোনো ব্যক্তিকে পর্যবেক্ষণে রাখা সম্ভব হবে। এটি যদি রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হয়, তবে সেটি হবে নাগরিক স্বাধীনতার ওপর এক অদৃশ্য দমননীতি।

আর্থিক বৈষম্য ও প্রযুক্তিগত বঞ্চনা। বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ এখনও পুরোনো বা আনঅফিসিয়াল ফোন ব্যবহার করে, বিশেষ করে নিম্নআয়ের মানুষ বা বিদেশফেরত শ্রমিকরা। তাদের অনেকেই বিদেশ থেকে ফোন এনে ব্যবহার করেন। এনইআইআর চালু হলে এসব ফোন হঠাৎ নেটওয়ার্কে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। ফলে সাধারণ মানুষ নতুন ফোন কিনতে বাধ্য হবে, যা তাদের জন্য অতিরিক্ত আর্থিক চাপ তৈরি করবে। প্রযুক্তিগত ত্রুটির ঝুঁকি। বিটিআরসি বা অপারেটরদের সিস্টেম যদি সঠিকভাবে সিঙ্ক্রোনাইজ না হয়, তবে বৈধ ফোনও ভুলক্রমে ব্লক হয়ে যেতে পারে। এমনটা হলে জনগণের ভোগান্তি অসীম হবে।

ডাটা নিরাপত্তা ও জবাবদিহির প্রশ্ন। বাংলাদেশে এখনও কোনো শক্তিশালী ডাটা প্রাইভেসি আইন নেই। অর্থাৎ, এনইআইআরের মতো বিশাল ডাটাবেস চালু হলে তার নিরাপত্তা, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ কীভাবে হবে, তা স্পষ্ট নয়। যদি কোনো হ্যাকার বা অসাধু ব্যক্তি এই তথ্য চুরি করে, তবে তা নাগরিক নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হবে। অন্যদিকে, অর্থনৈতিক দিক থেকে এই পদক্ষেপটি এক ধরনের ভারসাম্য সৃষ্টি করবে। বৈধ আমদানিকারক ও দেশীয় ফোন উৎপাদকরা লাভবান হবেন, কারণ অবৈধভাবে আনা ফোনের বাজার বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হবে ছোট ব্যবসায়ী ও সাধারণ ব্যবহারকারী। সরকার রাজস্ব পাবে, কিন্তু জনগণকে নতুন করে বৈধ ফোন কিনতে হবে। এই ভারসাম্যটিই এখন প্রশ্নবিদ্ধ- রাষ্ট্রের আর্থিক স্বার্থের বিপরীতে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সুবিধা কোথায় দাঁড়াবে?

এনইআইআরের প্রযুক্তিগত বাস্তবায়নে আরও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। চারটি অপারেটরের সিস্টেমকে কেন্দ্রীয় ডাটাবেসে যুক্ত করতে গেলে বিপুল পরিমাণ টেকনিক্যাল ইন্টিগ্রেশন, সার্ভার নিরাপত্তা ও ডাটার নির্ভুলতা নিশ্চিত করতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় সামান্য ভুল বা ত্রুটি হলে, সেটি লাখ লাখ ব্যবহারকারীর সংযোগ বন্ধ করে দিতে পারে। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জনসচেতনতা। অনেকেই জানেন না তাদের ফোন বৈধ কি না, কীভাবে তা নিবন্ধন করতে হয়, বা কোন ওয়েবসাইটে আইএমইআই যাচাই করা যায়। সরকার যদি পর্যাপ্ত প্রচারণা না চালায়, তবে ১৬ ডিসেম্বরের পর বিপুলসংখ্যক মানুষ হঠাৎ নেটওয়ার্কবিহীন হয়ে পড়বেন।

অতএব, এটি স্পষ্ট যে এনইআইআর একটি দ্বিমুখী তলোয়ারের মতো- একদিকে এটি জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারে, অন্যদিকে এটি নাগরিক স্বাধীনতা ও গোপনীয়তার জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। রাষ্ট্রকে এই ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নামে যেন নাগরিকদের জীবনে নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি বেড়ে না যায়, তা নিশ্চিত করা জরুরি। এই পরিস্থিতিতে কয়েকটি সুপারিশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, শক্তিশালী ডাটা প্রাইভেসি আইন প্রণয়ন করতে হবে, যাতে এনইআইআরের তথ্য কোনোভাবেই ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা না যায়। দ্বিতীয়ত, এনইআইআরের কার্যক্রমে একটি স্বাধীন পর্যবেক্ষণ বোর্ড থাকতে হবে, যেখানে নাগরিক সমাজ, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তৃতীয়ত, জনগণকে পর্যাপ্ত সময় ও সহায়তা দিতে হবে ফোন নিবন্ধনের জন্য। হঠাৎ সংযোগ বন্ধ না করে ধাপে ধাপে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। চতুর্থত, ভুলক্রমে ব্লক হওয়া ফোনের জন্য সহজ অনলাইন অভিযোগ ও পুনরুদ্ধার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। বাংলাদেশ ডিজিটাল অগ্রযাত্রার পথে এগিয়ে যাচ্ছে, এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক বিষয়। কিন্তু সেই অগ্রযাত্রা যদি নাগরিক স্বাধীনতাকে সীমিত করে ফেলে, তবে সেটি অগ্রগতি নয়, বরং নিয়ন্ত্রণের রূপান্তর। এনইআইআর সেই সীমারেখাতেই দাঁড়িয়ে আছে।

রাষ্ট্রকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে- সে কি সত্যিই নিরাপদ নেটওয়ার্ক চায়, নাকি এমন এক ‘সর্বদর্শী’ ব্যবস্থা, যেখানে প্রতিটি ফোন, প্রতিটি নাগরিক ও প্রতিটি কথোপকথন পর্যবেক্ষণের আওতায় থাকবে? ১৬ ডিসেম্বর যদি বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তির প্রতীক হয়, তবে সেই দিন থেকেই যেন নাগরিক স্বাধীনতার নতুন শৃঙ্খল না বোনা হয়- এই সতর্কতাই আজ সবচেয়ে প্রয়োজন। নিরাপত্তা দরকার, কিন্তু স্বাধীনতার বিনিময়ে নয়। এনইআইআর যদি সত্যিই স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তার হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তবে সেটি হবে বাংলাদেশের টেলিকম ইতিহাসে এক নতুন বিজয়। আর যদি এটি রাষ্ট্রীয় নজরদারির হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তবে সেটি হবে এক নীরব পরাধীনতার সূচনা।

মো. শামীম মিয়া

সম্পাদক, সরল কণ্ঠ পত্রিকা, জুমারবাড়ী, সাঘাটা, গাইবান্ধা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত