প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০১ নভেম্বর, ২০২৫
পঞ্চান্ন বছর ধরে বাংলাদেশ শাসিত হয়েছে নানা আদর্শের মাধ্যমে যেমন- মুজিববাদ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, কিংবা সামরিক জাতীয়তাবাদ। কিন্তু সাধারণ নাগরিকদের জীবনে পরিবর্তন এসেছে খুব সামান্যই। ক্ষমতা একদল অভিজাত থেকে আরেকদলের হাতে ঘুরে বেড়ালেও, গরিব মানুষের দৈনন্দিন সংগ্রাম একই রয়ে গেছে। বেকারত্ব, বৈষম্য, পরিবেশের অবক্ষয়, শহর-গ্রামের বিভাজন সবই রয়ে গেছে কারণ প্রতিটি রাজনৈতিক যুগ শুরু হয়েছে আদর্শ দিয়ে, নাগরিক দিয়ে নয়।
দলগুলো বিশ্বাস ও মতবাদের লড়াইয়ে ব্যস্ত থেকেছে, আর জনগণ অপেক্ষা করেছে কখন খাদ্যের দাম কমবে, চাকরি মিলবে, স্কুলগুলো ঠিকমতো চলবে, আর ন্যায়বিচার সত্যিই অর্থবহ হবে। দীর্ঘ অস্থিরতা, সংস্কার ও অবশেষে ‘জুলাই সনদ’ স্বাক্ষরের পর বাংলাদেশ এখন এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে অবশেষে একটি সত্যিকারের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য, যা জনগণ বহুদিন ধরে অপেক্ষা করছে।
এই জাতি দেখেছে রাজনীতির প্রায় সব অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবাদ, সামরিক শাসনের কঠোরতা, বংশানুক্রমিক রাজনীতির প্রভাব, একদলীয় আধিপত্যের দমবন্ধ অবস্থা। প্রত্যেকেই নবজাগরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু শেষ হয়েছে হতাশায়। আজকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নিয়ন্ত্রিত যুগে রাজনৈতিক দলগুলোকে আদর্শের গণ্ডি ছাড়িয়ে যেতে হবে। এখন যা দরকার তা হলো সমস্যার সমাধান, মানুষের পেটে ভাত, তরুণদের জন্য কাজ, গরিবের জন্য ন্যায়বিচার, এবং সবার জন্য কার্যকর শাসনব্যবস্থা। গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ একক ও কঠোর মতাদর্শে দেশ চালিয়েছে যেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করা হয়েছে আস্থা গড়ার বদলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য। বিরোধী কণ্ঠকে স্তব্ধ করা হয়েছে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো খোলসসার হয়েছে, আর ক্ষমতার মূল মুদ্রা হয়ে উঠেছে আনুগত্য।
২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে সেই কর্তৃত্ববাদী কাঠামোর পতন ঘটেছে; কিন্তু তা কোনো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর হাতে নয় বরং জনগণের হাতে। ছাত্র, শ্রমিক ও সাধারণ নাগরিকদের হাতে, যারা সরকার ও বিরোধী উভয়ের প্রতিই আস্থা হারিয়েছিল। যখন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন, তা অনেকের কাছে ছিল প্রতীকী ও কাব্যিক মুহূর্ত একজন ব্যক্তি যিনি সারাজীবন দরিদ্রদের ক্ষমতায়নের প্রতীক হিসেবে পরিচিত, তিনি যেন নতুন এক নৈতিক নবজাগরণের বার্তা নিয়ে এলেন। কিন্তু ১৫ মাস পর সেই আশার জোয়ার কিছুটা নিস্তেজ হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার এখন যেন ক্লান্ত, সতর্ক ও উদ্দেশ্যহীন দেখাচ্ছে। যে ছাত্র আন্দোলন একসময় ইউনূসের নেতৃত্বকে স্বাগত জানিয়েছিল, তারাই এখন তার প্রশাসনকে অভিযুক্ত করছে দ্বিধা ও এলিটবাদের জন্য।
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে নির্বাচনের যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা এখন অনিশ্চিত। সরকার নিশ্চয়তার আশ্বাস দিলেও, জনগণের আস্থা ক্রমেই ক্ষয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ খুব ভালোভাবেই জানে যখন রাজনীতি স্থবির হয়, তখন কী ঘটে। ইতিহাসে দেখা গেছে, যতবারই ‘অস্থায়ী’ অনির্বাচিত শাসন বাড়ানো হয়েছে তা সামরিক হোক বা তত্ত্বাবধায়ক শেষ পর্যন্ত তা কৌশলী ক্ষমতা দখলে পরিণত হয়েছে। একবার ক্ষমতা দখল করলে, তা সহজে ছাড়া যায় না। যদি নির্বাচন ২০২৬ সালের পর বিলম্বিত হয়, তবে নতুন করে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন হলে, তা শুধু সরকার গঠন করবে না পুনরুদ্ধার করবে রাজনৈতিক জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ।
এই নির্বাচন নতুন রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসও আনবে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ থাকলেও তাদের নেটওয়ার্ক এখনো সক্রিয়। বিএনপি ফিরে আসতে পারে, যদি তারা সত্যিই পরিবর্তনের প্রমাণ দিতে পারে, যদিও তাদের নেতাকর্মীদের অনেক বিতর্কিত কর্মকাণ্ড জনগণের বিশ্বাসকে দুর্বল করেছে। এদিকে নতুন শক্তিগুলো ছাত্র আন্দোলন, নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, ক্ষুদ্র সংস্কারবাদী দল রাজনৈতিক মানচিত্রে নতুন রূপ আনতে আগ্রহী। তারা হয়তো সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে না; কিন্তু তাদের উপস্থিতি রাজনীতিকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রতিনিধিত্বমূলক করবে।
তবু নির্বাচনই গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার একমাত্র উপায় নয়। বাংলাদেশের গভীর সংকট ভোটের অনুপস্থিতিতে নয়, বরং শাসনব্যবস্থার দুর্বলতায়। প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও পক্ষপাতদুষ্ট, দুর্বল এবং নির্ভরশীল। গত ১৫ বছরে মানুষ দেখেছে, পুলিশ আইনের নয়, ক্ষমতার অনুগত; বিচার বিভাগ চাপের কাছে নতি স্বীকার করেছে; আমলাতন্ত্র টিকে আছে যোগ্যতার নয়, আনুগত্যের ভিত্তিতে। যদি নতুন সরকার একই ব্যবস্থা উত্তরাধিকারসূত্রে পায়, তবে গণতন্ত্র শুধু হাতে বদলাবে, অভ্যাসে নয়। তাই সত্যিকারের সংস্কার শুরু করতে হবে স্বচ্ছতা, বিকেন্দ্রীকরণ এবং নাগরিকদের সেবায় নিয়োজিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠান গঠনের মাধ্যমে। গণতন্ত্র নিজে কোনো পবিত্র বস্তু নয়। এটি তখনই অর্থবহ হয় যখন তা জনগণের সেবা করে ন্যায়, জবাবদিহিতা ও অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে। এগুলো অনুপস্থিত থাকলে, গণতন্ত্র কেবল কিছু বছরের ব্যবধানে ভোটের এক খালি আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়, যেখানে ক্ষমতা অপরিবর্তিত থাকে।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে যারা জীবন বাজি রেখে রাস্তায় নেমেছিল, তারা আরেকটি এলিট শাসন বা প্রযুক্তিবিদ সরকারের জন্য নয় তারা মর্যাদার জন্য লড়েছিল। তারা চেয়েছিল তাদের কথা শোনা হোক, পরিচালিত না হোক। যদি রাজনীতি আবার শুধু ক্ষমতাধরদের খেলায় পরিণত হয়, তবে তাদের সেই ত্যাগ বৃথা যাবে। গণতন্ত্র কোনো শাসকের দান নয়; এটি নাগরিকদের সহনশীলতার এক অনুশাসন। বাংলাদেশিরা সহ্য করেছে অনেক কিছু বন্যা, দুর্নীতি, গুম, সেন্সরশিপ, বিশ্বাসঘাতকতা তবুও তারা কখনও তাদের ভোটাধিকারের দাবি ছাড়েনি। এই দৃঢ় তাই জাতির সবচেয়ে বড় শক্তি, কোনো মতাদর্শ নয়। তবে গণতন্ত্র একা ক্ষুধার্ত পেট ভরাতে পারে না বা দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থা সারাতে পারে না। গণতন্ত্রকেও পুষ্টি দিতে হয় ন্যায়বিচার, ন্যায্যতা ও সুযোগের মাধ্যমে। তা না হলে, ইতিহাস যেমন প্রমাণ করেছে, গণতন্ত্র শুকিয়ে যায় লোকদেখানো জনতাবাদে। গণতন্ত্র শূন্যতায় জন্মায় না; এটি জন্মায় জনগণের কোল থেকে। যদি রাজনীতিবিদরা জনগণকে না খাওয়ায়, তবে গণতন্ত্র মৃতপ্রায় শিশুর মতো জন্ম নেবে।
এখন বাংলাদেশকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সে কি আবারও ভাঙা প্রতিশ্রুতির গল্প বলবে, নাকি বলবে এক নতুন কাহিনি যেখানে জনগণ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ গণতন্ত্রকে অর্থবহ করে তুলতে, বিদেশি মডেল হিসেবে নয়, বরং রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে জীবন্ত এক সামাজিক চুক্তি হিসেবে। যে-ই আগামী সরকার গঠন করুক না কেন, মনে রাখা উচিত এই দেশ কোনো দলের নয়, কোনো গোষ্ঠীর নয়; এটি জনগণের। যখন একটি দেশে বিভিন্ন দলের বিভিন্ন আদর্শ থাকে এবং প্রতিটি দল তাদের আদর্শ পুরো জাতির ওপর চাপিয়ে দিতে চায়, তখন সৃষ্ট হয় বিশৃঙ্খলা। ভিন্ন ভিন্ন আদর্শ থাকা সুস্থতার লক্ষণ, কারণ তা মানুষকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে শেখায়। রাজনৈতিক দলগুলোকে এখন গভীর সমস্যা সমাধানে মনোযোগ দিতে হবে এবং জনগণকেন্দ্রিক নীতি গ্রহণ করতে হবে, কারণ শেষ পর্যন্ত কোনো আদর্শ নয়, মানুষই একটি জাতিকে টিকিয়ে রাখে।
সাদিয়া সুলতানা রিমি
শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়