ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ব্যাংক গ্রাহকদের আরেক ভোগান্তি আঙুলের ছাপ

নিরঞ্জন রায়
ব্যাংক গ্রাহকদের আরেক ভোগান্তি আঙুলের ছাপ

সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে কয়েকজন ঋণগ্রহীতা আমার কাছে জানতে চেয়েছেন যে, ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহণ এবং ঋণ নবায়নসংক্রান্ত কাগজপত্রে আঙুলের ছাপ দিলে কোনো বাড়তি সমস্যা হতে পারে কি না। প্রত্যুত্তরে আমি বললাম, ‘দেখেন, ব্যাংক থেকে যে ঋণ নেওয়া হয়, তা যদি সময়মতো সুদসহ পরিশোধ করা যায়, তাহলে আঙুলের ছাপই দেন আর যে ধরনের কাগজপত্রই সই করুন না কেন, তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ব্যাংকের ঋণ সময়মতো পরিশোধ করতে না পারলে বা ইচ্ছাকৃত খেলাপি হলে বা অন্যত্র সেই অর্থ সরিয়ে ফেললে, আঙুলের ছাপ না দিয়ে বা সে রকম কোনো কাগজপত্রে স্বাক্ষর না করেও বিপদে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।’ যদিও সেই ঋণগ্রহীতাদের প্রশ্নের স্বাভাবিক উত্তর দিয়েছি, তার পরও আমি ভাবলাম যে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ বা ঋণ নবায়নের কাগজপত্রে স্বাক্ষর করার পাশাপাশি আঙুলের ছাপ দিতে হবে কেন? আগে তো কখনও ব্যাংকের ডকুমেন্টে গ্রাহক বা ঋণগ্রহীতার আঙুলের ছাপ দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি।

আমরা যখন ব্যাংকে যোগদান করি, তখন একটিমাত্র ক্ষেত্রে গ্রাহকদের আঙুলের ছাপ প্রদানের বাধ্যবাধকতা ছিল, তা হচ্ছে নিরক্ষর গ্রাহকদের হিসাব খোলার সময়। নিরক্ষর কোনো ব্যক্তি যেহেতু ব্যাংকের ডকুমেন্ট বা কাগজপত্রে লিখে স্বাক্ষর করতে পারে না, তাই ব্যাংকে হিসাব খোলার সময় প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে টিপসই বা বৃদ্ধাঙ্গুলির ছাপ নেওয়া হতো। তা-ও এক ব্যাংকে গ্রাহকদের আরেক ভোগান্তি আঙুলের ছাপ বিশেষ পদ্ধতিতে ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বিশেষ করে শাখা ব্যবস্থাপকের তত্ত্বাবধানে নিরক্ষর গ্রাহকদের আঙুলের ছাপ গ্রহণ করার বিধান ছিল। এ রকম বিধান থাকলেও বাস্তবে কোনো গ্রাহকের আঙুলের ছাপ নিয়ে ব্যাংকে হিসাব খোলা হয়েছিল কি না, আমার জানা নেই। আমি আমার দীর্ঘ ব্যাংকিং কর্মজীবনে কোনো গ্রাহককে আঙুলের ছাপ নিয়ে ব্যাংকে হিসাব খুলতে বা লেনদেন করতে দেখিনি। আমার পরিচিত ব্যাংকার যারা আছেন, তাঁরাও দেখেছেন এমন কথা শুনিনি। অথচ সেই রকম এক ব্যবস্থা নতুন করে ব্যাংকিং কার্যক্রমে চালু হয়েছে জেনে অবাকই হলাম।

যেহেতু আমি নিজেও বিষয়টি জানি না এবং যে কয়জন ব্যক্তি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, তারাও বিষয়টি আমাকে ভালো করে জানাতে পারেননি। তাই আমি কয়েকজন ব্যাংকারের সঙ্গে যোগাযোগ করি এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার জন্য। যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম, তাদের বেশির ভাগেরই এ ব্যাপারে সঠিক ধারণা নেই যে- কেন স্বাক্ষরের পাশাপাশি আঙুলের ছাপ দিতে হবে। ফলে তারা আমাকে বিষয়টি সেভাবে বলতে পারলেন না। দুজন ব্যাংকার আঙুলের ছাপ নেওয়ার কারণ হিসেবে জানালেন, আদালত থেকে একটি সিদ্ধান্ত এসেছে- যে এখন থেকে ব্যাংকের ঋণদান বা ঋণ নবায়নসংক্রান্ত কাগজপত্রে ঋণগ্রহীতা এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি; যেমন- পরিচালক, অংশীদার, স্বত্বাধিকারী বা নিশ্চয়তা প্রদানকারী (গ্যারান্টর) আছেন, তাদের স্বাক্ষরের পাশাপাশি আঙুলের ছাপও দিতে হবে। আমি তখন জানতে চাইলাম যে হঠাৎ করে আদালত কেন এমন সিদ্ধান্ত দেবেন।

আমার এমন প্রশ্নের উত্তরে সেই ব্যাংকার যা বললেন, তা এ রকম যে এর আগে যেসব ঋণগ্রহীতা এবং নিশ্চয়তা প্রদানকারী ব্যক্তি ব্যাংকের ঋণসংক্রান্ত কাগজপত্র ও নিশ্চয়তাপত্রে স্বাক্ষর করেছেন, তাদের বেশির ভাগ এখন আদালতে গিয়ে অস্বীকার করছে, যে তারা এই ঋণের ব্যাপারে অবগত না এবং এসংক্রান্ত কাগজপত্রে তারা কখনোই স্বাক্ষর করেনি। তাদের বক্তব্য সঠিক হলে ধরে নিতে হবে যে ব্যাংক যেসব কাগজপত্র আদালতে উপস্থাপন করেছে, সেগুলো জ্বাল স্বাক্ষরসংবলিত। এ রকম হাস্যকর অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগে অতিষ্ঠ হয়েই আদালত এমন সিদ্ধান্ত দিয়েছেন বলে ধরে নেওয়া যায় এবং এটি খুবই স্বাভাবিক। আর আদালতের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক উচ্চ আদালতে বা আপিল বিভাগে গিয়ে এর একটি সন্তোষজনক সমাধান না করে এই সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে একটি সার্কুলার জারি করেছে সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রতি। ফলে ব্যাংকের ঋণ প্রদানসংক্রান্ত সব কাগজপত্রে স্বাক্ষরের পাশাপাশি দুই হাতের আঙুলের ছাপ প্রদান করাও এক বিধানে পরিণত হয়েছে।

সত্যি বলতে কি, ব্যাংকের কাগজপত্রে স্বাক্ষর করে, তা অস্বীকার করার সুযোগ খুবই কম। এই সুযোগ মূলত কিছু ব্যাংকারই করে দিয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকের গ্রাহক, ঋণগ্রহীতা বা নিশ্চয়তা প্রদানকারী ব্যক্তি ব্যাংকে এসে দুজন ব্যাংকারের উপস্থিতিতে কাগজপত্রে স্বাক্ষর করবেন এবং উপস্থিত দুজন ব্যাংকার সেখানে সাক্ষী হবেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এই নিয়ম না মেনে যেসব কাগজপত্রে স্বাক্ষর করতে হবে, সেগুলো একটি প্যাকেটে ভরে ঋণগ্রহীতার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয় স্বাক্ষর করে ফেরত পাঠানোর জন্য। এভাবে স্বাক্ষর করার কারণেই কিছু অসৎ ঋণগ্রহীতা ব্যাংকের কাগজপত্রে স্বাক্ষর করার কথা অস্বীকার করতে সাহস দেখান।

ব্যাংকের ঋণ প্রদান এমন একটি পদ্ধতি, যা কয়েকটি স্বাক্ষর দেওয়া না দেওয়ার সঙ্গে কিছু যায় আসে না। বেশ কিছু ধাপ এবং পদ্ধতি অনুসরণ করে ব্যাংক ঋণ বিতরণ করে থাকে। যেমন- ঋণের আবেদন, ঋণ প্রস্তাব বিশ্লেষণ, সুপারিশ ও অনুমোদন। ঋণ অনুমোদনপত্রে সম্মতি এবং সর্বোপরি ঋণের টাকা ঋণগ্রহীতার ব্যাংক হিসাবে জমা করা হয় এবং সেখান থেকে গ্রাহক প্রয়োজনমতো টাকা উত্তোলন করে থাকেন। এর প্রতিটি ধাপ ও পদ্ধতির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ থাকে, যা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। তাই কয়েকটি স্বাক্ষরের কথা অস্বীকার করলেই যে ঋণগ্রহণের দায়দায়িত্ব এড়ানো যাবে, তেমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। বিষয়গুলো সঠিকভাবে আদালতে উপস্থাপন না করতে পারার কারণেই আদালত বিরক্ত হয়ে আঙুলের ছাপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকবেন নিশ্চয়ই।

এই আঙুলের ছাপ নিলেই যে প্রদত্ত ঋণ আদায় হবে এবং আর ঋণখেলাপি হবেন না—এমনটি ভাবার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। যেসব কারণে একজন ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধ করতে পারেন না বা ঋণখেলাপি হন, তা বন্ধ করতে না পারলে কোনোভাবেই খেলাপি ঋণ সংস্কৃতি বন্ধ করা সম্ভব হবে না। যে ব্যক্তি ঋণ নিয়ে পরিশোধ করবেন না, তিনি স্বাক্ষর প্রদান করুন আর আঙুলের ছাপ দিন, এই একই কাজ করবেন। পক্ষান্তরে যে ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধ করতে বদ্ধপরিকর, তিনি কোনো রকম কাগজপত্রে স্বাক্ষর বা আঙুলের ছাপের কথা বিবেচনা না করেই এই ঋণ পরিশোধ করে দেবেন। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, কেউ যদি কাগজপত্রে স্বাক্ষর করে অস্বীকার করতে পারেন, তাহলে তিনি আঙুলের ছাপ দিয়েও অস্বীকার করতে পারবেন।

তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, স্বাক্ষর প্রত্যায়ন বা ভেরিফাই করার জন্য যেখানে পাঠাতে হবে, সেই একই স্থানে আঙুলের ছাপ প্রত্যয়নের জন্য পাঠাতে হবে। ফলে আঙুলের ছাপ নিলেই যে সেই প্রত্যয়নকারী অফিসের কাজের চাপ কমে যাবে, তেমনটি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। মাঝখান থেকে ব্যাংকের গ্রাহক ও সাধারণ ঋণগ্রহীতাদের ভোগান্তি বেড়ে গেছে। একজন ঋণগ্রহীতা দুঃখ করে বলছিলেন যে ‘আমার নিজের জমানো টাকা, স্থায়ী আমানতের বিপরীতে ঋণ নিয়েছি, যা শতভাগ নিরাপদ। তার পরও ব্যক্তিগত নিশ্চয়তাপত্রসহ অসংখ্য কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেছি, আর এখন দিতে হচ্ছে আঙুলের ছাপ।’ এমনিতেই ব্যাংকে গ্রাহক ভোগান্তির শেষ নেই।

নিরঞ্জন রায়

সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত