প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০২ নভেম্বর, ২০২৫
আজকের শহুরে জীবন আমাদের খাদ্যাভ্যাসকে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তিত করেছে। কর্মচাপ, স্কুল-কলেজের দায়িত্ব, বাড়ির দায়িত্ব- সব মিলিয়ে মানুষ দ্রুত, সুবিধাজনক এবং সাশ্রয়ী খাবারের দিকে ঝুঁকছে। স্ট্রিট ফুড বিক্রেতা, হোম ডেলিভারি সার্ভিস, রেস্তোরাঁ এবং ফাস্ট ফুড আউটলেট এখন খাবার পরিবেশনের জন্য ব্যাপকভাবে কাগজ বা কাগজের ট্রে ব্যবহার করছে। প্রথমে এটি সুবিধাজনক মনে হয়- হালকা, বহনযোগ্য, পরিবেশবান্ধব এবং খরচ সাশ্রয়ী। কিন্তু এই সুবিধার পেছনে লুকিয়ে আছে একটি গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি, যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হলো পুরাতন এবং নতুন কাগজের ব্যবহার। অনেক ব্যবসায়ী নতুন, সার্টিফাইড কাগজ ব্যবহার না করে পুরাতন কাগজ বা ভাঙরি দোকান থেকে সংগ্রহকৃত কাগজ ব্যবহার করে। এই পুরাতন কাগজে থাকে ধুলো, ময়লা, অবশিষ্ট রঙ, প্লাস্টিক লেপ এবং অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ। যখন খাবার এই কাগজে রাখা হয়, তখন এই পদার্থগুলি সরাসরি খাবারের সঙ্গে মিশে যায়। দীর্ঘমেয়াদে এটি লিভার, কিডনি, হজমতন্ত্র এবং হরমোনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, কাগজ ও বোর্ডে থাকা ইঙ্ক, রঙ, লেপ এবং রিসাইকেলড ফাইবার খাবারে স্থানান্তরিত হতে পারে। চর্বিযুক্ত, তেলযুক্ত বা গরম খাবারে এই ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। আন্তর্জাতিক খাবার নিরাপত্তা গবেষণা নিশ্চিত করেছে যে, পুরাতন কাগজের অবশিষ্ট রঙ বা লেপ সহজেই খাবারের সঙ্গে মিশে যেতে পারে, যার ফলে পেট ব্যথা, ডায়রিয়া, হজম সমস্যা এবং সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে। রাসায়নিক ঝুঁকির পাশাপাশি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণও বড় সমস্যা। পুরাতন কাগজ আর্দ্রতা ধরে রাখে, এবং যখন তা গরম খাবারের সঙ্গে সংস্পর্শে আসে, তখন ব্যাকটেরিয়া দ্রুত বৃদ্ধি পায়। শিশু, বৃদ্ধ এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম মানুষের জন্য এটি মারাত্মক হতে পারে। স্ট্রিট ফুড এবং হোম ডেলিভারিতে ব্যবহৃত কাগজ ট্রেতে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি খুব দ্রুত হয়, বিশেষ করে যদি ট্রে পুনঃব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে এই প্রবণতা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। রেস্তোরাঁ, ফাস্ট ফুড চেইন এবং হোম ডেলিভারি সার্ভিসের প্রেক্ষাপটে দেখা গেছে, খরচ কমানোর জন্য অনেক ব্যবসায়ী পুরাতন কাগজ ব্যবহার করছে। গ্রাহক সচেতন নয়; তারা সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী খাবারকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে, সামাজিক সচেতনতা ও নৈতিক দায়বোধও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পরিবেশগত প্রভাবও গুরুতর। অনেক কাগজে প্লাস্টিক বা ওয়াক্স লেপ থাকে, যা সহজে পচে যায় না। মাটিতে বা পানিতে ফেলে রাখলে এটি দীর্ঘ সময় ধরে থাকে। পুরাতন কাগজের ব্যবহার পরিবেশ দূষণ আরও বাড়ায়। এটি শুধুমাত্র স্বাস্থ্যঝুঁকি নয়, পরিবেশগত এবং সামাজিক নৈতিকতার বিষয়ও। রিসাইকেলড কাগজ, যদিও পরিবেশবান্ধব বলে মনে হয়, কিন্তু খাদ্য সংস্পর্শের জন্য উপযুক্ত না হলে এটি স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, রিসাইকেলড কাগজে থাকা প্রিন্ট রঙ, আঠা এবং লেপ খাবারে স্থানান্তরিত হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এটি ক্যান্সার, হরমোন সমস্যা এবং অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতির কারণ হতে পারে। বাংলাদেশে একটি বাস্তব উদাহরণ হলো- স্ট্রিট ফুড বিক্রেতারা এবং ভাঙরি দোকান থেকে সংগ্রহকৃত কাগজ ব্যবহার করে খাবার পরিবেশন করছে। অনেক সময় এই কাগজ অফিস বা দোকান থেকে নেওয়া হয়, যেখানে প্রিন্ট, বিজ্ঞাপন এবং রঙের দাগ থাকে। এই কাগজ সরাসরি গরম খাবারের সঙ্গে সংস্পর্শে আসে এবং ক্ষতিকর পদার্থ খাবারে মিশে যায়।
কাগজের স্বাস্থ্যঝুঁকি শুধুমাত্র রাসায়নিক নয়, ব্যাকটেরিয়ার কারণে সংক্রমণও বৃদ্ধি পায়। উদাহরণস্বরূপ, তেলযুক্ত ভাজা খাবার কাগজ ট্রেতে রাখলে আর্দ্রতা ধরে থাকে, যা ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি বাড়ায়। শিশু, বৃদ্ধ বা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম মানুষের জন্য এটি মারাত্মক। গবেষণা দেখিয়েছে, কাগজ ট্রে থেকে রঙ, লেপ এবং অন্যান্য পদার্থ খাবারে স্থানান্তরিত হয়। চর্বিযুক্ত বা গরম খাবারে ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। আন্তর্জাতিক সমীক্ষা প্রমাণ করেছে যে, ফরমালডিহাইড, ভারী ধাতু এবং পলিসাইক্লিক অ্যারোম্যাটিক হাইড্রোকার্বন কাগজে থাকলে মানুষের শরীরে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি হতে পারে। সরকারি তদারকি এবং নীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্য নিরাপত্তা সংস্থা এবং সরকারি পর্যবেক্ষণ অপরিহার্য। কাগজে খাবার পরিবেশনের জন্য মান নির্ধারণ, রেস্তোরাঁ এবং স্ট্রিট ফুড বিক্রেতাদের নিয়মিত পরিদর্শন এবং নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিকভাবে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে কাগজ বা খাদ্য সংযোগ উপকরণের নিয়ন্ত্রণ কঠোর। উদাহরণস্বরূপ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের EFSA নির্দেশ দিয়েছে যে, খাদ্যের সঙ্গে সংস্পর্শিত কাগজে কোনো ক্ষতিকর পদার্থ থাকা উচিত নয়। গ্রাহক সচেতনতা ও দায়িত্বও অপরিহার্য। পুরাতন বা নতুন কাগজ- যেটি ব্যবহার হোক, আমাদের লক্ষ্য খাদ্য নিরাপত্তা হওয়া উচিত। গরম খাবার দ্রুত প্লেটে স্থানান্তর করা, শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য কাগজ এড়ানো, এবং খাদ্যের সঙ্গে সরাসরি সংস্পর্শ কমানো জরুরি। পরিবেশগত প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ। প্লাস্টিক লেপযুক্ত কাগজ সহজে পচে যায় না এবং মাটিতে বা পানিতে দীর্ঘস্থায়ী থাকে। রিসাইকেলড কাগজ পরিবেশবান্ধব মনে হলেও, খাদ্য পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক। সঠিক ব্যবহার ও স্বাস্থ্যসম্মত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশ দূষণ উভয়ই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বিকল্প ও সমাধান হিসেবে, ব্যবসায়ীরা ধাতু, কাচ বা সার্টিফাইড বায়োডিগ্রেডেবল ট্রে ব্যবহার করতে পারেন। গরম বা তেলযুক্ত খাবারের জন্য লিনার বা অন্তর্বাহী ব্যবহার জরুরি। গ্রাহকরা সচেতন হোন- খাবারকে সরাসরি কাগজের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখুন এবং দ্রুত প্লেটে স্থানান্তর করুন। শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য কাগজ ব্যবহার এড়ানো গুরুত্বপূর্ণ। সরকার নিয়মিত তদারকি ও নীতি প্রণয়ন করুন। খাবার পরিবেশন এখন শুধু সুবিধার বিষয় নয়; এটি স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, সামাজিক সচেতনতা এবং নৈতিক দায়বোধের সঙ্গে জড়িত। কাগজে খাবার নেওয়ার সহজ পদ্ধতি সুবিধাজনক মনে হলেও, এটি দীর্ঘমেয়াদে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। সচেতনতা, স্বাস্থ্যসম্মত বিকল্প গ্রহণ এবং সরকারি তদারকির মাধ্যমে ঝুঁকি কমানো সম্ভব। ঢাকা এবং অন্যান্য শহরে করা সাম্প্রতিক সমীক্ষা দেখিয়েছে যে, ৬০% এর বেশি স্ট্রিট ফুড বিক্রেতা খরচ কমানোর জন্য পুরাতন বা পুনঃব্যবহৃত কাগজ ব্যবহার করছে। বিভিন্ন জেলায় পর্যবেক্ষণ দেখিয়েছে, এই প্রথা উচ্চচমূল্যের রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে ছোট রাস্তার স্টল পর্যন্ত সাধারণ। এটি জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
রাসায়নিক স্থানান্তর কেবল তাত্ত্বিক নয়। Food Control Ges Journal of Food Science -এ প্রকাশিত গবেষণা নিশ্চিত করেছে যে, কাগজে থাকা অবশিষ্ট রঙ ও লেপ খাদ্যে ভারী ধাতু এবং সম্ভাব্য ক্যান্সারজনক পদার্থ স্থানান্তরিত করতে পারে। গরম, তেলযুক্ত খাবার এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। শিশুদের স্বাস্থ্য বিশেষভাবে ঝুঁকিতে। পুনরাবৃত্তি সংক্রমণের মাধ্যমে দেহে টক্সিন জমা হতে পারে, যা বৃদ্ধি, বিকাশ এবং অঙ্গের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য প্রভাবিত করে। একইভাবে, বৃদ্ধ এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম মানুষের জন্য খাবারে সংক্রমণ মারাত্মক হতে পারে। সরকারের নীতি আন্তর্জাতিক মানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত। বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তার নিয়ম সীমিত এবং প্রয়োগ অপ্রতিশ্রুত। খাদ্যের জন্য ব্যবহৃত কাগজের সার্টিফিকেশন বাধ্যতামূলক করা, এবং রেস্তোরাঁ ও স্ট্রিট ফুড বিক্রেতাদের নিয়মিত পরিদর্শন করা স্বাস্থ্যের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হবে। বায়োডিগ্রেডেবল বা পুনঃব্যবহারযোগ্য ট্রেতে উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে নিরাপদ বিকল্প প্রচার করা যেতে পারে। পরিবেশগত দায়িত্বও স্বাস্থ্য সঙ্গে জড়িত। লেপযুক্ত কাগজের অযত্নিত নিক্ষেপ মাটির ও পানির দূষণ বাড়ায়। বায়োডিগ্রেডেবল বিকল্প এবং দায়িত্বশীল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উভয় ক্ষেত্রেই সহায়ক। শিক্ষা এবং সচেতনতা কার্যক্রম অপরিহার্য। বিক্রেতা, গ্রাহক ও শিশুদের সচেতন করা- পুরাতন বা দূষিত কাগজ ব্যবহার এড়ানো, স্বাস্থ্যসম্মত বিকল্প বেছে নেওয়া, এবং হাইজিন মেনে চলা- গ্রামের স্তরেও আচরণ পরিবর্তনে সাহায্য করবে। শেষ পর্যন্ত, খাবার পরিবেশন প্রথা সমাজের অগ্রাধিকার প্রতিফলিত করে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের পাশাপাশি পরিবার, সমাজ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দায়িত্ব। এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি- সার্টিফাইড ট্রে ব্যবহার, পুরাতন কাগজ এড়ানো, এবং স্বাস্থ্যসম্মত হাইজিন বজায় রাখা। পুরাতন কাগজ, পুনঃব্যবহৃত উপকরণ বা সাশ্রয়ী ট্রে স্বল্পমেয়াদে সুবিধা দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্য খরচ অনেক বেশি। নিরাপদ কাগজ বা বিকল্প, সরকারি তদারকি, সচেতন গ্রাহক এবং পরিবেশ বান্ধব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে পারে, সংবেদনশীল জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে পারে এবং টেকসই খাবার পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারে। প্রতিটি ছোট পদক্ষেপ- খাবার দ্রুত প্লেটে স্থানান্তর, সার্টিফাইড ট্রে ব্যবহার, বিক্রেতা শিক্ষা- সবার জন্য সুস্থ, নিরাপদ ও সচেতন সমাজ গঠনে অবদান রাখবে।
মো. শামীম মিয়া
শিক্ষার্থী, ফুলছড়ি সরকারি কলেজ ও কলামিস্ট, আমদিরপাড়া জুমারবাড়ী, সাঘাটা