ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সাময়িক শান্তি নাকি আগামীর যুদ্ধবিরতি

এমএ হোসাইন
সাময়িক শান্তি নাকি আগামীর যুদ্ধবিরতি

কূটনীতি, যখন আড়ম্বর আর করমর্দনের আচ্ছাদন সরিয়ে দেখা হয় তখনই এর প্রকৃত ক্ষমতার ভারসাম্যের যে খেলা তা বের হয়ে আসে। আর এই সপ্তাহে কুয়ালালামপুরে এসে ডোনাল্ড ট্রাম্প যেন তার সেই পুরনো কূটনৈতিক কৌশল প্রথমে চাপে ফেলে তারপর সহযোগিতা আদায়ের পুনরাবিষ্কার করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, যিনি আবারও নিজেকে ‘মূখ্য মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে পারস্পরিক আস্থার ঘাটতি ও উচ্চ প্রত্যাশা নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর (আসিয়ান) সঙ্গে সপ্তাহব্যাপী সফর শুরু করেছেন।

ট্রাম্পের উপদেষ্টারা এটিকে বিজয় হিসেবে প্রচার করতে আগ্রহী। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট বেসান্ট ঘোষণা দিয়েছেন, ‘শুধু শতভাগ শুল্কের হুমকিই চীনকে আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে এনেছে।’ এটা ট্রাম্প প্রশাসনের একটি পরিচিত কৌশল- হুমকি দাও, ভয় দেখাও, তারপর আলোচনায় বসো’। গাছ নাড়া দাও, ফল আপনাতেই পড়বে এই যুক্তিই তার রাজনীতি।

কিন্তু ইতিহাস বলে, জবরদস্তিমূলক কৌশল কখনই দীর্ঘ মেয়াদি হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শিল্প থেকে শুরু করে স্মার্টফোন পর্যন্ত সবকিছু যে ‘রেয়ার আর্থ মিনারেল’-এর উপর নির্ভরশীল, সেটি গোপন নয়। আর সেই গুরুত্বপূর্ণ খনিজের প্রায় ৭০ শতাংশই আসে চীন থেকে। ফলে বেইজিংয়ের হাতে রয়েছে বিশাল কূটনৈতিক হাতিয়ার যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা শিল্পের প্রায় ৭৮ শতাংশ এই খনিজের উপর নির্ভরশীল। ট্রাম্প যখন শুল্ক দ্বীগুণ করার হুমকি দেন, চীন পাল্টা হুমকি দেয় রপ্তানি সীমিত করার। এই স্নায়ুযুদ্ধের খেলায় শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষই এক ধাপ পিছু হটে।

এর ফলাফল হলো, চীনের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা এক বছরের জন্য স্থগিত। যুক্তরাষ্ট্রও তার শুল্কবৃদ্ধির কিছু অংশ প্রত্যাহার করছে। একে কেউ শান্তিচুক্তি বলছে না, তবুও এটিকে এক ধরনের মূল্যবান বিরতি হিসেবে দেখা যেতে পারে।

ওয়াশিংটন সব সময়ই নিজেদের অন্যের উপর নির্ভরশীলতাকে অস্বীকার করে থাকে। বিচ্ছিন্নতার যতই কথা বলা হোক, মার্কিন অর্থনীতি এখনও গভীরভাবে চীনা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। রেয়ার আর্থ খনিজই তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক অস্বস্তিকর বাস্তবতা হলো পেন্টাগনের সবচেয়ে উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর উপকরণগুলো চীনের শিল্পাঞ্চল থেকেই সরবরাহ করা হয়।

চীন এই অসমতা অনেক আগেই টের পেয়েছিল। কঙ্গোর কোবাল্ট থেকে মিয়ানমারের টিন অর্থাৎ বিশ্বজুড়ে খনিজ খাতে তারা দীর্ঘদিন ধরেই বিনিয়োগ করে যাচ্ছে। তাই যুক্তরাষ্ট্র যখন চীনের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ বিলম্বিত করছে, এতে মূলত তারা বিকল্পের সন্ধানে সময় কিনছে।

ট্রাম্পের সমর্থকরা এটিকে কূটনৈতিক সাফল্য বলছেন, সমালোচকরা বলছেন ‘লেনদেন নির্ভর নাটক।’ হয়তো দুটোই সত্য। ট্রাম্পের কূটনীতি বরাবরই তাৎক্ষণিক অগোছালো হলেও কখনও কখনও ফলপ্রসূ হয়েছে। সংঘর্ষে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলেও চুক্তির পথে ফিরতে জানেন।

খনিজ ও শুল্কের বাইরে আলোচনায় উঠে এসেছে কৃষি ও প্রযুক্তি খাত। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষকরা যারা সয়াবিন রপ্তানি কমে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ ছিলেন তারা চীনের এই ক্ষুদ্র প্রতিশ্রুতিতে খুশি। জানা যায় চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন আমদানি বাড়াতে রাজি হয়েছে, যা ট্রাম্পের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ কিছুটা লাঘব করবে। তারপর আছে টিকটক। একসময় তরুণ সংস্কৃতির প্রতীক এই অ্যাপ এখন ভূরাজনৈতিক দাবার গুটি। নতুন চুক্তি অনুযায়ী, টিকটককে এমন একটি নতুন কোম্পানিতে রূপান্তর করা হবে যার বেশিরভাগ মালিকানা থাকবে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের হাতে। ট্রাম্প, যিনি একসময় অ্যাপটি নিষিদ্ধ করার হুমকি দিয়েছিলেন, এখন এটিকে নিজের সাফল্য হিসেবে দেখাচ্ছেন। চীনের জন্যও বড় স্বার্থ রক্ষার্থে এটি এক ধরনের ছোট ছাড়।

২০১৯ সালের পর দক্ষিণ কোরিয়ায় ট্রাম্প ও শি জিনপিং প্রথমবারের মতো মুখোমুখি বসবেন। বছরব্যাপী উত্তেজনা কমাতে এটি এক সচেতন প্রয়াস। এর ফলে উভয়েরই লাভের সুযোগ আছে। ট্রাম্প চান নিজেকে এমন নেতা হিসেবে উপস্থাপন করতে যেখানে তিনি চীনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন এবং তার সঙ্গে জাতীয় অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলাও রোধে সক্ষম। অন্যদিকে, শি চান মর্যাদাহানি ছাড়া স্থিতিশীলতা। বাণিজ্যিক উত্তেজনা হ্রাস চীনের জন্য কিছুটা স্বস্তি বয়ে আনবে, বিশেষত যখন চীনের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ধীরগতিতে চলছে এবং যুক্তরাষ্ট্র প্রযুক্তি রপ্তানিতে বাধা দিচ্ছে। তবে, অতীত ইতিহাস কিন্তু বেশ সুখকর নয়। ১৯৭২ সালে নিক্সনের বেইজিং সফরকেও বলা হয়েছিল নতুন যুগের সূচনা, কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাতে শেষ হয়নি, শুধু নতুন রূপ পেয়েছিল। আজকের ট্রাম্প-শি শীতলতা হয়তো উত্তেজনা কমাবে, কিন্তু প্রতিযোগিতার মূল কাঠামো অপরিবর্তিত থাকবে। দুই দেশ আর পুরোনো অর্থে বাণিজ্য অংশীদার নয় তারা এখন প্রয়োজনীয়তায় জড়িয়ে পড়া কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী।

চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম একে কোনোভাবে ‘শান্তি চুক্তি’ বলতে সতর্ক ছিল। অধিকন্তু, আমেরিকান কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি চুরি, সাইবার নিরাপত্তা বা প্রযুক্তি হস্তান্তর এই জটিল বিষয়গুলো এখনও চীনের সঙ্গে অমীমাংসিত আছে।

তবুও, কূটনীতিতে সুরটাই মুখ্য। মাসের পর মাস কঠোর বক্তব্য ও শুল্ক হুমকির পর এখন ওয়াশিংটন ও বেইজিং ‘পারস্পরিক শ্রদ্ধা’-র সুরে কথা বলছে। অর্থাৎ উভয় পক্ষই এখন শব্দচয়নে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করছে।

ইতিহাস শেখায়, বৃহৎ শক্তিগুলোর সংঘাত কখনও এক স্বাক্ষরে শেষ হয় না। তা ক্লান্তি, বাস্তবতা আর পারস্পরিক স্বীকৃতির মাধ্যমে স্থিতিশীল হয়। ট্রাম্প শিবির বলছে, ‘চীন ও আমেরিকা দুজনেই একত্র হতে চায়।’ হয়তো ঠিকই। কিন্তু শান্তির ভাষণ আর বাস্তব শান্তি এ দুটিই আলাদা বিষয়। বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিশ্বশক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দু। কুয়ালালামপুরে আসিয়ান সম্মেলন আয়োজনকে কেন্দ্র করে এই কূটনৈতিক পদক্ষেপটি কোনো কাকতালীয় বিষয় নয়। মালয়েশিয়া বরাবরই আসিয়ান কূটনীতিতে সক্রিয় এবং নিজেকে পূর্ব-পশ্চিমের সেতুবন্ধন হিসেবে দেখাতে পছন্দ করে। ছোট শক্তিরাও যে বিশ্বরাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে, এই সম্মেলন তারই প্রমাণ। আসিয়ান দেশগুলো কোনো পক্ষ নিতে চায় না। তারা চীনের বিনিয়োগ ও আমেরিকার নিরাপত্তা দুদিক থেকেই লাভবান হতে আগ্রহী। তাদের বার্তা স্পষ্ট : প্রতিযোগিতা করো, কিন্তু তা যেন সভ্যতার সীমা ছাড়িয়ে না যায়। ট্রাম্প-শি কতোগুলো চুক্তি সম্পাদন করলেন, তা কোনো বিষয় নয়। প্রশ্ন হলো, দেশে ফিরে গিয়ে তারা কি প্রতিদ্বন্দ্বিতার টান থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারবেন? দুই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এই সংঘাতকে কেবলই উস্কে দেয়, যেখানে আপোস কাম্য নয়। ট্রাম্পের সমর্থকরা তার ‘চীনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান’-এর ভাবমূর্তিতে মুগ্ধ। অন্যদিকে, শির বৈধতা নির্ভর করে জাতীয় শক্তি ও বিদেশি চাপের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানের উপর।

তাই কুয়ালালামপুর কাঠামোকে শান্তিচুক্তি নয়, বরং যুদ্ধবিরতি হিসেবেই দেখা উচিত। এর ফলে, উভয় নেতাকেই এক ধরনের রাজনৈতিক সুবিধা এনে দেয়, কূটনীতিকদের জন্য সময় কেনে, আর বাজারের জন্য স্বস্তি আনে। কিন্তু পর্দার আড়ালে চলতে থাকে গভীর প্রতিযোগিতা প্রযুক্তি, মতাদর্শ, আর বৈশ্বিক প্রভাবের উপর আধিপত্যের লড়াই।

এমএ হোসাইন

রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত