প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৩ নভেম্বর, ২০২৫
বাংলাদেশের কৃষির দিকে তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানখেত আমাদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার প্রতীক। ফসলের বাম্পার ফলন আমাদের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। এই সাফল্য অর্জনের পেছনে রয়েছে কৃষকের অক্লান্ত শ্রম, বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন আর আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার। কিন্তু এই উজ্জ্বল চিত্রের আড়ালে একটি অন্ধকার দিক ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তা হলো কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত এবং মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে আমরা কি একটি বিষাক্ত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি? যে কৃষক আমাদের অন্ন জোগান তিনি নিজেই কি আজ সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে নেই? এবং যে ভোক্তা হিসেবে আমরা বাজার থেকে সবজি চাল বা ফল কিনছি, আমরা কি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে আমাদের প্লেটে বিষ উঠে আসছে না?
এই প্রশ্নগুলো আজ আর অমূলক নয়। এটি একটি জাতীয় উদ্বেগের বিষয়। বাংলাদেশের কৃষিতে কীটনাশকের ব্যবহার একটি চক্রাকার সংকটে পরিণত হয়েছে। যা মাটির স্বাস্থ্য, পরিবেশের ভারসাম্য এবং সর্বোপরি জনস্বাস্থ্যকে এক ভয়াবহ হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক কীটনাশকের সঠিক পরিমাপ জানে না। যা জমি, ফসল ও তার পাশাপাশি ভোক্তার স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য সংস্থান করা। সত্তরের দশকে সবুজ বিপ্লবের হাত ধরে উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান ও গমের আবাদ শুরু হয়। নতুন জাতের ফসলের সঙ্গে আসে নতুন নতুন রোগবালাই ও পোকামাকড়ের উপদ্রব। এই উপদ্রব দমনে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হয়।
শুরুতে এর ব্যবহার ছিল সীমিত। কিন্তু, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই নির্ভরতা বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে একটি ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায়। ১৯৭২ সালের দিকেও যেখানে দেশে কীটনাশকের ব্যবহার ছিল মাত্র কয়েক হাজার টন, ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় চল্লিশ হাজার মেট্রিক টনে। অর্থাৎ গত পাঁচ দশকে কীটনাশকের ব্যবহার বেড়েছে প্রায় দশগুণ। বর্তমানে দেশে কীটনাশকের বাজার ৫০০ বিলিয়ন টাকারও বেশি।
এই বিপুল পরিমাণ রাসায়নিকের একটি বড় অংশই অত্যন্ত ক্ষতিকর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) কীটনাশকগুলোকে তাদের বিষাক্ততার মাত্রার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করেছে। বাংলাদেশ সরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ মেনে অত্যন্ত বিপজ্জনক শ্রেণি-১ (Class I) এর কীটনাশক যেমন ডিডিটি, ডাইএলড্রিন, মনোক্লোটোফস ইত্যাদি নিষিদ্ধ করেছে। এটি একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। এর ফলে কীটনাশক পানে আত্মহত্যার হারও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
কিন্তু, সংকট এখানেই শেষ নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, নিষিদ্ধ না হলেও আন্তর্জাতিকভাবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কীটনাশক বা হাইলি হ্যাজার্ডাস পেস্টিসাইড (HHP) হিসেবে বিবেচিত এমন অনেক রাসায়নিক বাংলাদেশে দেদারসে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (weGBD) এক গবেষণায় দেশে ব্যবহৃত এমন ২৫টি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কীটনাশক শনাক্ত করা হয়েছে। এসব রাসায়নিক প্রায় আট হাজার বাণিজ্যিক নামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ক্লোরপাইরিফস, প্যারাথিয়ন, গ্লাইফোসেট, কার্বেনডাজিম এবং অ্যাবামেকটিনের মতো ভয়ঙ্কর সব নাম।
এই রাসায়নিকগুলোর ব্যবহার বৃদ্ধির পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। কৃষকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব কীটনাশক কোম্পানির আগ্রাসী বিপণননীতি এবং অল্প সময়ে অধিক ফলনের লোভ এই ব্যবহারকে অনিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে নিয়ে গেছে। কোথাও কোথাও ব্যাংকগুলো লোন দেওয়ার আগে লিয়াজু করে এসব কোম্পানির সঙ্গে। ফলে কৃষক এসব কীটনাশক ব্যবহার করতে বাধ্য হয়।
যে কৃষক রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে আমাদের জন্য ফসল ফলান এই রাসায়নিক বিষের প্রথম এবং প্রধান শিকার তিনিই। বাংলাদেশের কৃষকদের কীটনাশক ব্যবহারের পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করলে যে কেউ আতঙ্কিত হবেন। দেশের সিংহভাগ কৃষকই কোনো প্রকার ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম যেমন মাস্ক, গ্লাভস বা বিশেষ পোশাক ছাড়াই কীটনাশক স্প্রে করেন। অনেকে খালি গায়ে বা লুঙ্গি পরেই এই বিষাক্ত রাসায়নিকের সরাসরি সংস্পর্শে আসেন।
এর ফলে তাৎক্ষণিক বিষক্রিয়া একটি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় ২৭ শতাংশ কৃষক প্রতি বছর কীটনাশকজনিত স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন। প্রায় ৩৫ শতাংশেরও বেশি কৃষক বিষ প্রয়োগের সময় বা পরে নানা রকম শারীরিক জটিলতা অনুভব করেন।
এই তীব্র বিষক্রিয়ার লক্ষণগুলো হলো- মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব, চোখে ঝাপসা দেখা, ত্বকে জ্বালাপোড়া ও চুলকানি এবং তীব্র শ্বাসকষ্ট। অনেক সময় কৃষক বুঝতেই পারেন না যে তার এই অসুস্থতার কারণ হলো জমিতে ছিটানো বিষ। সঠিক চিকিৎসার অভাবে বা বিষক্রিয়ার মাত্রা বেশি হয়ে কৃষক মৃত্যুর খবর খুব অপরিচিত নয়।
কৃষকের এই স্বাস্থ্যঝুঁকি একটি পারিবারিক ও সামাজিক বিপর্যয়। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন পুরো পরিবার অর্থনৈতিক সংকটে নিপতিত হয়। চিকিৎসার খরচ জোগাতে গিয়ে তারা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এভাবে কীটনাশক কেবল স্বাস্থ্যই কেড়ে নিচ্ছে না গ্রামীণ অর্থনীতির বুনিয়াদকেও দুর্বল করে দিচ্ছে।
কীটনাশকের তীব্র বিষক্রিয়া দৃশ্যমান। কিন্তু, তার চেয়েও ভয়ঙ্কর হলো এর নীরব ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব। এই বিষ ধীরে ধীরে আমাদের শরীরে জমা হয় এবং একসময় ক্যান্সার, নিউরোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার বা বন্ধ্যাত্বের মতো দুরারোগ্য ব্যাধি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
কীটনাশক শুধু কৃষকের ত্বকের মাধ্যমেই শরীরে প্রবেশ করে না। এটি বাতাস পানি এবং খাদ্যচক্রের মাধ্যমে আমাদের সবার শরীরে প্রবেশ করছে। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বহুমাত্রিক।
ক্যান্সার : অনেক কীটনাশক বিশেষত অর্গানোফসফেট এবং গ্লাইফোসেটের মতো হার্বিসাইডকে আন্তর্জাতিক ক্যান্সার গবেষণা সংস্থা (IARC) ‘সম্ভাব্য ক্যান্সার সৃষ্টিকারী’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, কীটনাশকের সংস্পর্শে দীর্ঘসময় ধরে থাকা কৃষকদের মধ্যে নন-হজকিন লিম্ফোমা, লিউকেমিয়া, প্রস্টেট এবং ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি।
স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি (Neurological Disorders): অর্গানোফসফেট এবং কার্বামেট জাতীয় কীটনাশক সরাসরি মানুষের স্নায়ুতন্ত্রে আঘাত হানে। এগুলো অ্যাসিটাইলকোলিন নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ নিউরোট্রান্সমিটারের কাজে বাধা দেয়। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে পারকিনসন্স ডিজিজ, অ্যালঝাইমার এবং শিশুদের মধ্যে অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার (ADHD) এর মতো স্নায়ুবিক রোগের সম্পর্ক পাওয়া গেছে। ক্লোরপাইরিফস নামক কীটনাশকটি শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশে বাধা দেয় বলে প্রমাণিত হওয়ায় অনেক দেশেই নিষিদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশে এটি বহুল ব্যবহৃত।
প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা : কীটনাশককে এন্ডোক্রাইন ডিসরাপ্টর বা হরমোন বিঘ্নকারী বলা হয়। অর্থাৎ এগুলো শরীরে প্রবেশ করে প্রাকৃতিক হরমোনের কাজে বাধা দেয়। এর ফলে পুরুষদের মধ্যে শুক্রাণুর সংখ্যা কমে যাওয়া বন্ধ্যাত্ব এবং নারীদের গর্ভপাত গর্ভকালীন জটিলতা ও অপরিণত শিশু প্রসবের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।
জন্মগত ত্রুটি : গর্ভবতী মা কীটনাশকের সংস্পর্শে এলে বা কীটনাশক মিশ্রিত খাদ্য গ্রহণ করলে গর্ভের শিশুর মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, কীটনাশকের উচ্চ ব্যবহারের এলাকায় জন্মগত ত্রুটি বিশেষত স্পাইনা বিফিডা (মেরুদণ্ডের ত্রুটি) এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিকলাঙ্গতা নিয়ে শিশু জন্মের হার বেশি।
দীর্ঘমেয়াদী কিডনি রোগ: কিছু কীটনাশক ও হেভি মেটাল কিডনির কোষকে সরাসরি ধ্বংস করে। দীর্ঘসময় ধরে কীটনাশকযুক্ত পানি পান করলে বা খাদ্যের মাধ্যমে তা শরীরে প্রবেশ করলে কিডনি ফেইলিওরের মতো মারাত্মক রোগ হতে পারে।
এই দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকিগুলো কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কৃষক থেকে শুরু করে শহুরে ভোক্তা সবাই এই ঝুঁকির আওতায়। শিশুরা সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত কারণ তাদের শরীরের প্রতি কেজি ওজনে তারা তুলনামূলক বেশি বিষ গ্রহণ করে এবং তাদের বিকাশমান অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিষের প্রতি অধিক সংবেদনশীল।
কীটনাশকের ব্যবহার শুধু মানবস্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে না, এটি আমাদের পুরো পরিবেশ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। যে মাটি আমাদের ফসল দেয়, সে মাটিই আজ মৃতপ্রায়। বাংলাদেশের প্রায় ৬১ শতাংশ আবাদি জমিতে জৈব পদার্থের ঘাটতি রয়েছে। এর অন্যতম কারণ হলো মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার। এই রাসায়নিকগুলো মাটির উপকারী অণুজীব ও কেঁচোকে মেরে ফেলে মাটিকে অনুর্বর করে তোলে। ফলে একই জমিতে পরবর্তী ফসল ফলাতে আরও বেশি রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয়।
জমিতে ছিটানো কীটনাশকের একটি বড় অংশ বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে নদী-নালা, খাল-বিল ও ভূগর্ভস্থ পানিতে মিশে যায়। এর ফলে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর মৃত্যু ঘটে। একসময় যে বাংলাদেশে মাছে ভাতে বাঙালি প্রবাদ ছিল, আজ সেই মাছের অনেক দেশীয় প্রজাতিই বিলুপ্তির পথে। এই কীটনাশক জলজ উদ্ভিদের মাধ্যমে মাছের শরীরে এবং সেই মাছ খাওয়ার মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে যা বায়োম্যাগনিফিকেশন বা জৈব বিবর্ধন নামে পরিচিত।
কীটনাশক উপকারী ও অপকারী পোকার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। ফলে ফসলের পরাগায়নে সহায়তাকারী মৌমাছি, বোলতা বা বন্ধু পোকাগুলোও কীটনাশকের প্রভাবে মারা যায়। পরাগায়নকারী পোকা কমে যাওয়ায় ফসলের উৎপাদনশীলতাও দীর্ঘমেয়াদে হ্রাস পায়। এই ভয়াবহ সংকট থেকে উত্তরণের পথ কি তবে বন্ধ? আমরা কি রাসায়নিকের ওপর নির্ভরশীলতা কমালে আবারও খাদ্য সংকটে পড়ব? উত্তর হলো না। আধুনিক কৃষি বিজ্ঞান আমাদের টেকসই এবং নিরাপদ উপায়ে ফসল উৎপাদনের পথ দেখাচ্ছে। দরকার শুধু সদিচ্ছা এবং সঠিক নীতির বাস্তবায়ন।
আল শাহারিয়া
পরিবেশবাদী লেখক, সংগঠক ও কলামিস্ট