ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

শহর ও গ্রামের শিক্ষার বৈষম্য

আরিফুল ইসলাম রাফি
শহর ও গ্রামের শিক্ষার বৈষম্য

শিক্ষা একটি জাতির মেরুদণ্ড। এই কথাটি আমরা বারবার শুনেছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেই মেরুদণ্ড কি আমাদের দেশে দৃঢ় ও সমানভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? বাস্তবতা বলছে, না। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী যে বৈষম্যটি বিদ্যমান, তা হলো শহর ও গ্রামের শিক্ষার ব্যবধান। স্বাধীনতার ৫০ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এই বৈষম্যের পরিধি আজও বিস্তৃত, কখনও কখনও আগের চেয়েও গভীর। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার শিকড় ঔপনিবেশিক আমল। ইংরেজ শাসনের সময়েই শহরাঞ্চলকে কেন্দ্র করে আধুনিক শিক্ষার সূচনা হয়েছিল। তখনই শিক্ষার সুবিধা ধীরে ধীরে শহরের অভিজাত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, আর গ্রামের মানুষ থেকে যায় প্রান্তিক ও অবহেলিত অবস্থায়। স্বাধীনতার পর সরকার শিক্ষা বিস্তারে অনেক উদ্যোগ নিলেও, সেই ঐতিহাসিক বৈষম্য আজও পুরোপুরি মুছে যায়নি।

শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন প্রযুক্তির যুগে প্রবেশ করেছে। আধুনিক ভবন, প্রশিক্ষিত শিক্ষক, স্মার্ট ক্লাসরুম, ডিজিটাল বোর্ড, বিজ্ঞানাগার, কম্পিউটার ল্যাব, ইন্টারনেট সংযোগ- সবই শহুরে শিক্ষার অংশ। শিক্ষার্থীরা সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ক্লাসের পাশাপাশি অংশ নেয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা, রোবোটিক্স ক্লাব, স্পেলিং বি, কিংবা গণিত অলিম্পিয়াডে।

শহরের অভিভাবকরাও শিক্ষার বিষয়ে সচেতন। তারা সন্তানদের পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যক্তিগত উন্নয়নেও মনোযোগ দেন- প্রাইভেট টিউটর, কোচিং সেন্টার, অনলাইন কোর্স এমনকি বিদেশি শিক্ষার প্রস্তুতিও শহরের শিশুদের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। ফলে তারা কেবল বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং একবিংশ শতাব্দীর বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় নিজেদের যোগ্য করে তুলছে।

তাছাড়া শহরের বিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম ও মাদ্রাসা- এই তিন ধারার বৈচিত্র্য। অনেকে আন্তর্জাতিক কারিকুলাম অনুসরণ করে পড়াশোনা করে, যা তাদের উচ্চশিক্ষার পথে বাড়তি সুবিধা দেয়। অন্যদিকে গ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও এক জটিল বাস্তবতার মধ্যে আটকে আছে। অনেক বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, যারা আছেন তাদের উপস্থিতিও অনিয়মিত। শ্রেণিকক্ষ কম, বেঞ্চ ভাঙা, ছাদ চুঁইয়ে পানি পড়ে। অনেক জায়গায় বিদ্যুৎ নেই বা খুবই অনিয়মিত। বিজ্ঞান ল্যাব বা কম্পিউটার ল্যাব নামমাত্র আছে, কিন্তু সেগুলো ব্যবহারযোগ্য নয়। ফলে শহরের শিক্ষার্থীরা যেখানে গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ডের শিক্ষা পাচ্ছে, সেখানে গ্রামের শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক পাঠই পুরোপুরি আত্মস্থ করতে পারছে না।

শিক্ষকরা শিক্ষার প্রাণ। কিন্তু শহর ও গ্রামের শিক্ষকদের মান, সুযোগ-সুবিধা ও মনোভাবের মধ্যে বিরাট পার্থক্য। শহরের শিক্ষকরা সাধারণত প্রশিক্ষিত, শিক্ষাবিদদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করেন। অন্যদিকে গ্রামের শিক্ষকরা অনেক সময় প্রশিক্ষণ থেকে বঞ্চিত, এবং নানা প্রশাসনিক জটিলতায় জড়িয়ে থাকেন। তাছাড়া, অনেক শিক্ষকই গ্রামে পোস্টিং পেলেও কিছুদিন পর বদলির মাধ্যমে শহরমুখী হন। ফলে গ্রামীণ বিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষকের আসা-যাওয়া লেগেই থাকে, যা শিক্ষার্থীদের শেখার ধারাবাহিকতা ভেঙে দেয়।

ডিজিটাল যুগে তথ্যই শক্তি। কিন্তু এই শক্তি ব্যবহার করার ক্ষেত্রেও শহর-গ্রামের মধ্যে এক বিপুল ফারাক। শহরের শিশুর হাতে ট্যাব, স্মার্টফোন, ল্যাপটপ- সবই সহজলভ্য। কিন্তু গ্রামের শিক্ষার্থীদের কাছে এসব কিছুই নেই। কোভিড-১৯ মহামারির সময় এই বৈষম্য স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। শহরের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস চালিয়ে যেতে পেরেছিল, কিন্তু গ্রামের অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। অনেকে এরপর আর বিদ্যালয়ে ফিরেও আসেনি। শিক্ষা কেবল জ্ঞানের নয়, এটি সমাজে সামাজিক ও অর্থনৈতিক শ্রেণি নির্ধারণের একটি মাধ্যম। শহরের ভালো স্কুলের শিক্ষার্থীরা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, ভালো চাকরি পায়, উচ্চ আয়ের জীবনযাপন করে। বিপরীতে গ্রামের শিক্ষার্থীরা সেই প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না।

ফলে এক প্রজন্মের বৈষম্য পরের প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয়। শহরের শিশু শহরেই বড় হয়, বিদেশে পড়তে যায়; গ্রামের শিশু হয়তো দশম শ্রেণির পরেই কাজের সন্ধানে ঢাকামুখী হয়। এই চক্র থেকে বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে নানা সময় নানান উদ্যোগ নিয়েছে- প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক, উপবৃত্তি, বিনামূল্যে বই বিতরণ, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম। এসব উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ইতিবাচক, কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা থেকেই গেছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্পের অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার হয়নি, পর্যাপ্ত তদারকি ছিল না। রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং দুর্নীতির কারণে উন্নয়ন কার্যক্রমের সুফল অনেক সময় গ্রামের প্রান্তিক বিদ্যালয়ে পৌঁছায়নি।

বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষানীতিতে শহর ও গ্রামের বৈষম্য কমানোর কথা বলা হলেও বাস্তবে কোনো পৃথক কাঠামো গড়ে তোলা হয়নি। বরং একটাই পাঠ্যসূচি, একটাই পরীক্ষাপদ্ধতি- যা শহর ও গ্রামের বাস্তবতার পার্থক্যকে উপেক্ষা করে। ঢাকায় জন্ম নেওয়া একজন শিশু ও সুন্দরবনের চরাঞ্চলের একজন শিশু একই পরীক্ষায় বসে। কিন্তু তাদের প্রস্তুতি, পরিবেশ, শিক্ষক ও সুযোগের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। ফলে সমান প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে গ্রামের শিশুরা অনিবার্যভাবে পিছিয়ে পড়ে।

এখন অনেক শহুরে পরিবার সন্তানদের বিদেশে পড়তে পাঠাচ্ছে। তারা দেশে ফিরেও শহরের জীবনেই অভ্যস্ত হয়। অন্যদিকে গ্রামের মেধাবীরা সুযোগের অভাবে বিদেশে যেতে পারে না। এই ব্যবধান সমাজে এক অদৃশ্য মনস্তাত্ত্বিক দেয়াল তৈরি করছে, যেখানে শিক্ষিত মানেই শহর, আর গ্রামীণ মানেই পিছিয়ে পড়া। ফলে গ্রামীণ শিক্ষা তার সামাজিক মর্যাদা হারাতে বসেছে। অনেক অভিভাবকই এখন সন্তানকে গ্রামের স্কুলে রাখতে চান না; যারা পারেন, শহরে পাঠিয়ে দেন। এতে গ্রামের বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি কমে যাচ্ছে, শিক্ষক কমছে, এবং এক ধরনের ‘শিক্ষাগত জনশূন্যতা’ তৈরি হচ্ছে। এই দীর্ঘস্থায়ী বৈষম্য দূর করা সহজ নয়, কিন্তু অসম্ভবও নয়। প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, ও সামাজিক ঐক্য। বৈষম্য দূরীকরণে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন- শিক্ষা বাজেটের একটি নির্দিষ্ট অংশ কেবল গ্রামীণ বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় করতে হবে। গ্রামের শিক্ষকদের জন্য বাড়তি বেতন, বাসস্থানের ব্যবস্থা এবং নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।

সরকারি উদ্যোগে ডিজিটাল ক্লাসরুম চালু করে শহরের শিক্ষকরা যেন অনলাইনে গ্রামের শিক্ষার্থীদের পড়াতে পারেন এমন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ ও স্থানীয় সমাজপতিদের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের তদারকি জোরদার করতে হবে। শিক্ষার পরিবেশ রক্ষায় সামাজিক উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোযোগী থাকতে পারে। শহর ও গ্রামের জন্য আলাদা শিক্ষানীতি নয়, বরং ভিন্নধর্মী সহায়তামূলক ব্যবস্থা তৈরি করা প্রয়োজন।

শিক্ষার আলো যদি কেবল শহরের কাচের ভবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠী চিরকাল অন্ধকারে থাকবে। শহর ও গ্রামের শিক্ষার এই ফারাক শুধু সংখ্যাগত নয়, এটি সামাজিক ন্যায়, মানবিকতা ও রাষ্ট্রীয় সমতার প্রশ্ন। একজন শহরের শিশু যখন ল্যাপটপে কোড শেখে, আর একজন গ্রামের শিশু তখন খড়ের ছাউনি তলায় পুরনো বই নিয়ে বসে থাকে- এই দৃশ্য আসলে আমাদের সময়ের এক নীরব কাব্য, যার প্রতিটি পৃষ্ঠা অন্যায়ের ইতিহাসে লেখা। শিক্ষা কেবল পাসের সংখ্যা নয়, এটি মানুষের আত্মমুক্তির উপায়। শহর ও গ্রামের শিক্ষার বৈষম্য ঘুচানো মানে কেবল সমান সুযোগ তৈরি করা নয়, বরং একটি ন্যায্য সমাজ গঠন করা। সরকার, শিক্ষক, অভিভাবক, এবং সমাজ- সবার মিলিত প্রচেষ্টাই পারে এই বৈষম্যের দেয়াল ভাঙতে। যেদিন গ্রামের শিশুরাও শহরের শিশুদের মতো একই মানের শিক্ষা, একই প্রযুক্তি, এবং একই মর্যাদা পাবে; সেদিনই আমরা বলতে পারব, বাংলাদেশ সত্যিই জ্ঞানের আলোয় আলোকিত একটি জাতি হয়ে উঠেছে।

আরিফুল ইসলাম রাফি

শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত