প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৫ নভেম্বর, ২০২৫
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ অঙ্গরাজ্যের মুর্শিদাবাদে রহিয়াছে ‘হাজারদুয়ারি’ প্রাসাদ। এই জমিদারবাড়িটি দেখিতে আমাদের দেশের অনেক মানুষ প্রতি বৎসর মুর্শিদাবাদে গমন করিয়া থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশেও যে ‘হাজারদুয়ারি’ নামে মনোরম ও ঐতিহ্যবাহী প্রাসাদ বা জমিদারবাড়ি রহিয়াছে, তাহা অনেকের অজানা। আবার যাহারা এই সম্পর্কে অবহিত ও ভ্রমণপিপাসু, তাহারা বাংলাদেশের হাজারদুয়ারি দেখিতে আসিয়া হতাশ হন। কেননা এমন একটি সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন পর্যটন স্পট পড়িয়া রহিয়াছে অবহেলা ও অনাদরে। প্রকাশিত এক খবরে বলা হইয়াছে যে, প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই জমিদারবাড়িটি সংস্কারের অভাবে আজ হারাইয়া যাইতে বসিয়াছে। বর্তমানে এই বিশাল রংচটা জমিদারবাড়িটির নাই কোনো জানালা-দরজা। প্রতিটি দেওয়ালের পলেস্তারা খসিয়া পড়িয়াছে। কোথাও কোথাও ছাদও ভাঙিয়া পড়িয়াছে। ইহা ছাড়া সেইখানকার ফাঁকা ঘরগুলিতে এখন বিভিন্ন বয়সের ছেলে মাদক সেবন করে এবং আড্ডা দেয় বলিয়া অভিযোগ রহিয়াছে।
উল্লেখ্য, আলোচ্য জমিদারবাড়ির দরজাসংখ্যা ১ হাজার। এই জন্য ইহার নামকরণ করা হইয়াছে ‘হাজারদুয়ারি’। ৫০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত এই প্রাসাদটি অবস্থিত রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার এক নিভৃত পল্লিতে। ইহা রাজশাহী, নওগাঁ ও নাটোর-এই তিন জেলার সন্নিহিত স্থান বীরকুৎসায় অবস্থিত। কিন্তু বিভিন্ন সময় স্থানীয় সংসদ সদস্যরা এই জমিদারবাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের কথা বলিলেও তাহাতে কর্ণপাত করা হয় নাই। অথচ জনগুরুত্বপূর্ণ এই প্রাসাদটিকে সংস্কারের মাধ্যমে আকর্ষণীয় ও লাভজনক পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত করা সম্ভব।
এই জমিদারবাড়িটি একটি উদাহরণ মাত্র। প্রকৃতপক্ষে সারা দেশে এমন অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা রহিয়াছে, যাহা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও উদাসীনতার শিকার। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের এক তথ্যমতে, তাহাদের আওতায় ৫৩৬টি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি রহিয়াছে। তন্মধ্যে গেজেটভুক্ত নিদর্শন মাত্র ১৭৮টি। ইহাতে প্রমাণিত হয় যে, তালিকাভুক্তির পরও বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এখনও সংরক্ষণের বাহিরে আছে। জনবল-সংকট এবং অর্থবরাদ্দ ও নজরদারির অভাবে এই সংরক্ষিত পুরাকীর্তিগুলোর অধিকাংশই রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হইতেছে না। ফলে অনেক ঐতিহ্য আজ বিলুপ্তির পথে। যেমন- খোদ রাজধানীতে অবস্থিত পুরান ঢাকার শতবর্ষী ভবনগুলোর কথা বলা যায়। এই সব ভবন দুঃখজনকভাবে গুদাম বা কারখানা হিসাবেও ব্যবহৃত হইতেছে। আবার জিঞ্জিরা প্রাসাদের মতো স্থাপনার আশপাশে গড়িয়া উঠিতেছে বহুতল ভবন। এই সব অমূল্য সম্পদ সংরক্ষণ ও গবেষণার গুরুত্ব আমরা সঠিকভাবে অনুধাবন করিতে পারিতেছি না। ইহা ছাড়া ব্রিটিশ আমলে প্রণীত পুরাতন আইন, যেমন: ‘ট্রেজারস ট্রুভ অ্যাক্ট ১৮৭৮’ বা ‘অ্যান্টিকুইটিজ অ্যাক্ট ১৯৪৭’-এর ফাঁক গলিয়া প্রত্নসম্পদ চুরি, পাচার ও দখল হইয়া যাইতেছে। যদিও ‘প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ আইন, ২০২৪’ (খসড়া)-এ প্রস্তাব করা হইয়াছে যে, প্রত্নসম্পদ ধ্বংস করিলে ১০ বৎসর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা গুনিতে হইবে। কিন্তু এই আইনটি কখন অনুমোদিত ও কার্যকর হইবে, তাহা প্রশ্নসাপেক্ষ। ফলে প্রত্নসম্পদ দখলদারিত্বের হাত হইতে রক্ষা পাইতেছে না। বিশেষ করিয়া, গত এক বৎসরে এই সব সম্পদের নিরাপত্তা বহু কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়িয়াছে।
স্থানীয় প্রভাবশালী বা ভূমি দস্যুদের দ্বারা প্রত্নসম্পদ দখল এবং দেশি-বিদেশি কুচক্রিদের হাত হইতে মূল্যবান প্রত্ন ও শিল্পসামগ্রী চুরি হওয়া প্রতিহত করিতে হইলে এই ব্যাপারে জনসচেতনতার অভাব দূর করিতে হইবে। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নসহ আধুনিক সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করিলে এই স্থানগুলি হইতে পারে আমাদের রাজস্ব আয়ের গুরুত্বপূর্ণ খাত, যাহা স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করিতে পারে। গাইড, হোটেল, পরিবহন, হস্তশিল্পসহ বিভিন্ন খাতে সৃষ্টি করিতে পারে ব্যাপক কর্মসংস্থান। তাহা ছাড়া পর্যটকদের মাধ্যমে দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে বহির্বিশ্বের সাংস্কৃতিক বিনিময় ঘটানো সম্ভব। এইগুলি ইতিহাস, স্থাপত্য ও সমাজবিজ্ঞান গবেষণার জন্যও এক মূল্যবান উৎস। তাই হাজারদুয়ারির মতো বিভিন্ন অবহেলিত প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণে আমাদের মনোনিবেশ করা একান্ত প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখিতে হইবে, প্রত্নসম্পদ একটি জাতির অহংকার। সেই অহংকার ও গর্বকে হেলাফেলায় ধ্বংস হইতে দেওয়া যাইবে না।