ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

শিশুর খেলার মাঠ যেখানে সোনার হরিণ

সুব্রত দাশ
শিশুর খেলার মাঠ যেখানে সোনার হরিণ

মাত্র কয়েক দশকের ব্যবধানে আমরা এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁছেছি যে, বিকাল বেলা খেলার মাঠের প্রতি টান অনুভব করার মতো কোনো স্মৃতি নেই অধিকাংশ শহুরে শিশুর। একটি স্বাস্থ্যকর শহরের জন্য ন্যূনতম যে পরিমাণ উন্মুক্ত জায়গা প্রয়োজন, সামগ্রিকভাবে রাজধানী ঢাকাসহ প্রায় সব শহরেই সেইরকম জায়গার প্রচণ্ড অভাব। ফলশ্রুতিতে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হারাচ্ছে সুস্থ বিনোদনের মাধ্যম, অনেকে কিশোর বয়সেই জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদ- অনুযায়ী, জনপ্রতি ৯ বর্গমিটার উন্মুক্ত সবুজ জায়গা থাকা প্রয়োজন প্রতিটি শহরে। কিন্তু আমাদের রাজধানীতে আছে এর প্রায় ১৬ ভাগের এক ভাগ। তবে প্রকৃত সংকট উপলব্ধি করতে গেলে এই সব খোলা জায়গার ধরন এবং সাধারণের প্রবেশগম্যতার বিষয়টি ভাবা প্রয়োজন।

খোলা জায়গার বেশিরভাগই হয় নিষ্ক্রিয় খোলা জায়গা অথবা নির্দিষ্ট কোনো কারণে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত। খেলাধুলা বা শরীরচর্চা করার মতো সক্রিয় খোলা জায়গা (Active Open Space) আরও অনেক কম। তদুপরি আছে শহরজুড়ে এমন উন্মুক্ত জায়গার অসম বণ্টন। বেশিরভাগ খেলার জায়গা কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা তত্ত্বাবধানে আছে। একটা সময় ছিল স্কুল মানেই ভবনের সামনে উন্মুক্ত সবুজ চত্বর, যেখানে বাচ্চারা ছুটে বেড়াত। স্কুল ছুটির পরে স্থানীয় শিশু ও তরুণেরা নিয়মিত খেলাধুলা করত।

অন্তত মফস্বল এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সীমানা দেয়াল দিয়ে মাঠ তালাবদ্ধ করে রাখার কোনো চর্চা ছিল না। কিন্তু মাত্র কয়েক দশকের ব্যবধানে স্কুলের মাঠগুলো হয় নতুন বহুতল ভবনের নিচে চাপা পড়েছে, নতুবা উঁচু সীমানা প্রাচীরের পেছনে হারিয়ে গেছে।

পরিসংখ্যানে সেই মাঠের অস্তিত্ব থাকলেও প্রতিবেশী শিশুদের চোখে তার উপস্থিতি বিলীন হয়ে গেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শহরে উন্মুক্ত পরিসর ও সহায়ক সুবিধাগুলোর (Amenities) জমির মালিকানা স্থানীয় জনপ্রশাসনের কাছে থাকলেও, তার উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব থাকে নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের কাঁধে। প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের অভাব অনেক ক্ষেত্রেই নতুন জনপরিসর সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হচ্ছে, এমনকি সরকারি মালিকানাধীন অনেক খোলা জায়গায় গড়ে উঠছে বৃহৎ বাণিজ্যিক বা প্রশাসনিক ভবন। শহরের নতুন সম্প্রসারণ এলাকায় সরকারিভাবে জমি অধিগ্রহণ করেও গড়ে তোলা হয় না নাগরিকের নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা। আর যদি কিছু জায়গা এমন থেকেও থাকে, সেখানে শিশু, নারী, বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য নিরাপদ ও ব্যবহারযোগ্য আয়োজনের উদ্যোগ কোথায়? যেসব শিশু খেলার সুযোগ পাচ্ছে, তাদের মধ্যেও অধিকাংশই বাড়ির পাশের ফাঁকা আবাসিক প্লট বা রাস্তার ওপরেই ফুটসাল কিংবা শর্টপিচ ক্রিকেট খেলছে। হয়তো কিছুদিন পরেই এইসব খালি প্লটে নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে ছোট খেলার মাঠ আর রাস্তা দখল করে নিচ্ছে নির্মাণ সামগ্রী।

বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা আবাসিক প্রকল্পে রাস্তা ও আবাসিক প্লট ছাড়া কোনো কিছুরই যথাযথ সংস্থান করা হচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি প্লট মসজিদের জন্য এবং আরও ২টি প্লট বহুতল বাণিজ্যিক ভবনের জন্য ছাড়া হচ্ছে, যার নিচতলায় সুপারশপ ও উপরে শহরের মানুষের সবচেয়ে ট্রেন্ডি ঘোরাঘুরির জায়গা হিসেবে রেস্টুরেন্ট ও বাচ্চাদের ইনডোর প্লে-জোন।

উন্মুক্ত খেলার মাঠ কিংবা বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য আরামদায়ক রোডসাইড পার্ক বরাদ্দ থাকে না কিছুই। শহরের নতুন সম্প্রসারণ এলাকায় সরকারিভাবে জমি অধিগ্রহণ করেও গড়ে তোলা হয় না নাগরিকের নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা। আর যদি কিছু জায়গা এমন থেকেও থাকে, সেখানে শিশু, নারী, বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য নিরাপদ ও ব্যবহারযোগ্য আয়োজনের উদ্যোগ কোথায়? গত শতাব্দীর শেষভাগেও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া শিশু বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে চলে যেতে পারত, নিজেদের মতো করে সামাজিক যোগাযোগ ও পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে পারত। বিশেষ করে ছোট শহরগুলোয় সহজেই সামাজিক নিরাপত্তা ও বিকাশ নিশ্চিত করা যেত। এরমধ্য দিয়ে তারা শিখত জীবন-জীবিকার গুরুত্বপূর্ণ পাঠ, দলগত কাজ, দ্বন্দ্ব সমাধান ও নিজেদের রক্ষাকবচ তৈরি করা। সামাজিকভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ হারানো, অতিনিয়ন্ত্রিত শৈশব আমাদের এমন এক সময়ে নিয়ে এসেছে, যেখানে মাধ্যমিক স্কুলের গণ্ডি পার হওয়া কিশোর-কিশোরীকেও একা বাইরে পাঠানো অনিরাপদ মনে হয়।

এই ‘অতিনিয়ন্ত্রণ’ শিশুকে বাইরের বিশ্ব সম্পর্কে অনভিজ্ঞ, সামাজিকভাবে অনিশ্চিত এবং মানসিকভাবে বেশি নাজুক করে তুলছে। শৈশবেই যেখানে মুক্ত বিচরণের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠার কথা, সেখানে চার দেয়ালের নিরাপদ কোণ থেকে হঠাৎ করে তাকে বিশাল এক বিশ্বে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এটি একটি মূলমন্ত্র, যা সিঙ্গাপুরের জীবনযাত্রায় কাজ ও সামাজিক জীবনের ভারসাম্যের বিষয়টি প্রকাশ করে। অনেক সময় আমরা বাসযোগ্য নগর গড়ে তোলার ব্যর্থতা ঢাকতে জমির অপ্রতুলতার ওপর দায় চাপাই। সিঙ্গাপুর ও হংকং-এর পরিকল্পনা নিয়ে পড়াশোনা ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, কীভাবে উন্নত পরিকল্পনার মানদ- ও স্থানিক পরিকল্পনার মাধ্যমে জনসংখ্যার ঘনত্ব ও ভূমির সীমাবদ্ধতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা হয়েছে। হংকং-এর ৭০ ভাগেরও বেশি জমি উন্মুক্ত সবুজ জায়গা এবং প্রত্যেক বাসিন্দার জন্য অন্তত ১ বর্গমিটারের খেলাধুলা বা শরীরচর্চা করার মতো সক্রিয় খোলা জায়গা (Active Open Space) এবং আরও সমপরিমাণ অনির্দিষ্ট/বহুমুখী ব্যবহারের উপযুক্ত সবুজ খোলা জায়গা (Passive Open Space) আছে। একটি শহরের সভ্যতা ও উন্নয়নের মাপকাঠি শুধু তার উঁচু অট্টালিকা বা ফ্লাইওভার নয়; বরং সেই শহরের শিশু কোথায় মুক্ত মনে দৌড়াতে পারছে, বৃদ্ধ কোথায় প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে, আর কিশোর কোথায় তার বন্ধুদের সঙ্গে নিরাপদে সময় কাটাতে পারছে তা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

সর্বোচ্চ ২০ মিনিটের হাঁটা দূরত্বের মধ্যে এমন একটি উন্মুক্ত জায়গা থাকবে, যেখানে শিশু, বয়োজ্যেষ্ঠ, যুবক-যুবতী সবার জন্য উপযুক্ত জায়গা ও পরিবেশ থাকবে, যেখানে কোনোরকম প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি অকল্পনীয়। আর সিঙ্গাপুরের নগর উন্নয়ন ও পরিকল্পনার দায়িত্বে থাকা Urban Redevelopment Authority সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের অধীনে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার নিয়ে কাজ করে। সুউচ্চ ভবন তৈরি আর অর্থনৈতিক উন্নয়নই যার মূল লক্ষ্য নয়, বরং বসবাসের জন্য বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শহর হয়ে ওঠার জন্য সবুজ আর টেকসই উদ্যোগগুলোই থাকে পরিকল্পনার মূল কেন্দ্রবিন্দুয়। কিন্তু, আমরা যখন উদাহরণ হিসেবে সিঙ্গাপুর কিংবা হংকং এর কথা বলি তখন আলো ঝলমলে সুউচ্চ ভবনগুলোই সামনে আসে, সবুজ, নিরাপদ, জনবান্ধব পরিসরগুলো থেকে যায় চোখের আড়ালে। একটি শহরের সভ্যতা ও উন্নয়নের মাপকাঠি শুধু তার উঁচু অট্টালিকা বা ফ্লাইওভার নয়; বরং সেই শহরের শিশু কোথায় মুক্ত মনে দৌড়াতে পারছে, বৃদ্ধ কোথায় প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে, আর কিশোর কোথায় তার বন্ধুদের সাথে নিরাপদে সময় কাটাতে পারছে তা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। খোলা জায়গা ও খেলার মাঠ তাই কোনো ঐচ্ছিক উপাদান নয় বরং একটি স্বাস্থ্যকর, নিরাপদ ও টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ।

আমাদের শহরগুলো যদি প্রকৃতই ‘বাসযোগ্য’ করতে হয়, তাহলে কেবল পরিকল্পনার কাগজে নয়, বাস্তবের মাটিতে প্রতিটি শিশুর জন্য খেলার জায়গা, প্রতিটি নাগরিকের জন্য নিঃশ্বাস নেওয়ার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এটি আর শুধু প্রশাসনিক দায়িত্ব নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা। স্থানিক পরিকল্পনার গুরুত্ব অনুধাবন করে এবং সবার জন্য পালনীয় টেকসই প্ল্যানিং গাইডলাইন নির্ধারণের মধ্য দিয়ে আনন্দমুখর, প্রাণচঞ্চল ও কর্মনিষ্ঠ ভবিষ্যৎ নগরী আমরা গড়ে তুলতে পারি।

সুব্রত দাশ

সহযোগী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত