প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৮ নভেম্বর, ২০২৫
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম-খুনের যে অন্ধকার অধ্যায় রচিত হয়েছিল, জনগণের প্রত্যাশা ছিল অন্তর্বর্তী বা গণতান্ত্রিক সরকার সেই ধারা থেকে দেশকে মুক্ত করবে। কিন্তু গত মঙ্গলবার এক সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত ১০ মাসে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ৫৩৪টি অজ্ঞাতপরিচয় লাশ বেওয়ারিশ হিসাবে দাফন করা হয়েছে, যাদের অধিকাংশই হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, দুর্ঘটনা বা রহস্যজনক মৃত্যুর শিকার হয়েছেন। এদিকে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে রাজধানীর রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ৩৮৬টি এবং জুরাইন কবরস্থানে ৭৭টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়েছে। এছাড়া সনাতন ধর্মাবলম্বীদেরও কয়েকটি অজ্ঞাতপরিচয় লাশের সৎকার করা হয়েছে পোস্তগোলা শ্মশানে। এসব পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যা নয়, এটি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির অব্যাহত অবনতির ইঙ্গিত দেয়। এটি ঠিক, বিগত সরকারের আমলে যেসব কায়দায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটত, বর্তমানে সেভাবে ঘটছে না। তবে এখনও যে বিভিন্ন জায়গায় লাশ পাওয়া যাচ্ছে, এটি উদ্বেগের বিষয়।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলতে মূলত আদালতের রায়ের বাইরে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকে, সেগুলো বোঝায়। এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের দায় সরকার এড়াতে পারে না। আমাদের মনে আছে, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কিছুদিন পর আইন উপদেষ্টা বলেছিলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। সরকার এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবে। আইনের মাধ্যমে তদন্তসাপেক্ষে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করবে। কোনোভাবে পার পাওয়ার সুযোগ থাকবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি।
আমাদের সংবিধান প্রত্যেক নাগরিককে জীবন ও স্বাধীনতার মৌলিক অধিকার দিয়েছে। আইনের চোখে একজন অভিযুক্ত ততক্ষণ নির্দোষ, যতক্ষণ না আদালতে তার দোষ প্রমাণিত হয়। রাষ্ট্রের কোনো বাহিনী, সে পুলিশ হোক বা যৌথ বাহিনী-নিজেদের হাতে বিচার তুলে নেওয়ার অর্থ হলো- দেশের সংবিধান, বিচারব্যবস্থা এবং মৌলিক মানবাধিকারকে সরাসরি অস্বীকার করা। এটি একটি সুস্থ ও সভ্যসমাজের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার ও আইনের শাসনের প্রতি অঙ্গীকার রক্ষার্থে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত এ প্রবণতা কঠোরভাবে দমন করা।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ না হলে নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি কখনোই সুদৃঢ় হবে না। সরকারকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাই একটি সভ্যদেশের পরিচয় বহন করে। কাজেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সরকারের নির্লিপ্ত থাকার সুযোগ নেই। আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান না নিলে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সাফল্য প্রশ্নের মুখে পড়বে। ভুলে গেলে চলবে না, বিনা বিচারে কাউকে আটক বা বন্দি রাখা বা নির্যাতনের মাধ্যমে মেরে ফেলা সম্পূর্ণ বেআইনি। একই সঙ্গে তা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনসহ মানবতা ও মানবাধিকারের পরিপন্থি। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বেশকিছু পদক্ষেপও নিয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের গুম ও নির্যাতনবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনেও স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। কাজেই গুম-খুনের বিরুদ্ধে এ সরকারের অবস্থান যে দৃঢ়, তা স্পষ্ট। এর প্রমাণ সরকারের কাজে মিলবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা।