প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১২ নভেম্বর, ২০২৫
‘প্রতিবন্ধী’ শব্দটি আমাদের মানসপটে যে ছবি আঁকে, তা প্রায়শই একটি লাঞ্ছিত ও অবহেলিত গোষ্ঠীর। সাধারণত যারা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা, কথা বলা বা দৈনন্দিন কাজকর্মে অন্যদের সমান সামর্থ্য রাখে না, শারীরিক গঠনে কিছুটা ভিন্ন, তাদেরই ‘প্রতিবন্ধী’ বলা হয়। ফলে, তারা সমাজের বিভিন্ন স্তরে অবহেলা, দুর্ব্যবহার ও সহানুভূতির আড়ালে লাঞ্ছনার শিকার হন। এভাবে নিজের প্রতি তাদের নিজেদেরই হীনম্মন্যতা ও গ্লানির জন্ম হয়।
কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি মোটেও সঠিক নয়। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি প্রতিটি মানুষই নিজস্বতায় অনন্য ও সুন্দর। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও আমাদের এই সমাজেরই অংশ। তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্বশীল আচরণ এবং তাদের পূর্ণাঙ্গ অধিকার নিশ্চিত করাটা এখন সময়ের দাবি।
প্রথমেই আমাদের স্থানীয় পর্যায়ে এই জনগোষ্ঠীকে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে হবে। তাদের বয়স ও প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী চাহিদা নির্ণয় করতে হবে। একটি প্রতিবন্ধী শিশুর চাহিদা যেমন একজন প্রাপ্তবয়স্ক শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির চাহিদা থেকে ভিন্ন, তেমনি একজন বাকপ্রতিবন্ধীর প্রয়োজনীয়তা একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর থেকে আলাদা। এই ভিন্নতাকে বুঝেই সেবার পরিকল্পনা করতে হবে।
এরপর আসে তাদের মৌলিক অধিকার- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা-এর চাহিদা পূরণের বিষয়টি। রাষ্ট্র ও স্থানীয় সরকারকে এই দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের জন্য অবাধ ও সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। প্রতিটি উপজেলা বা ওয়ার্ডে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে দক্ষ প্রশিক্ষকের ব্যবস্থা করতে হবে। তারা যাতে কোনোভাবেই শিক্ষা ও দক্ষতায় পিছিয়ে না থাকে, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যেও সুপ্ত প্রতিভা ও অসাধারণ ক্ষমতা লুকিয়ে থাকে, এ কথা বলাবাহুল্য। আমাদের দায়িত্ব হলো সেই প্রতিভাকে চিহ্নিত করে তাকে বিকশিত করার পরিবেশ ও প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দেওয়া। বিশ্বজুড়ে অসংখ্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তি তাদের মেধা, অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও সৃজনশীলতার কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাফল্যের পরিচয় দিচ্ছেন এবং দেশের মুখ উজ্জ্বল করছেন। আমাদেরও স্থানীয় পর্যায় থেকে এমন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যাতে এ দেশের প্রতিবন্ধীরাও নিজ নিজ ক্ষেত্রে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে পারে। এক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজের ভূমিকা অপরিসীম। পরিবারকে হতে হবে, তাদের প্রধান সহায়ক। পাশাপাশি, তাদের জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা ও থেরাপি নিশ্চিত করতে হবে। অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি প্রয়োজনীয় বাসস্থান ও পারিবারিক সহায়তার অভাবে রাস্তায়-ফুটপাতে জীবন কাটান, যেখানে ঋতুভিত্তিক দুর্যোগ, বিশেষ করে শীতকাল, তাদের জন্য ভয়াবহ যন্ত্রণা বয়ে আনে। স্থানীয় সরকার, সামাজিক সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ে তাদের জন্য সাময়িক আশ্রয়, বস্ত্র ও খাদ্য বিতরণের মতো কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। কর্মক্ষেত্রেও তাদের জন্য বিশেষ কোটা সংরক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। শুধু সহানুভূতি নয়, তাদের সামর্থ্যের প্রতি আস্থা রেখেই এগিয়ে আসতে হবে।
একটি সভ্য, উন্নত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ তখনই গড়ে ওঠে, যখন তার সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষটিকেও সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানো হয়। আসুন, আমরা সবাই মিলে এই অবহেলিত শ্রেণির মানুষের পাশে দাঁড়াই। তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করে একটি সত্যিকারের সুন্দর, সমতাভিত্তিক ও মানবিক সমাজ গঠন করি, যেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও হবে আমাদের অহংকারের অংশ।
আল ইমরান
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়