প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৮ ডিসেম্বর, ২০২৫
দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন আমরা উদ্বিগ্ন হই, তখন অনিবার্যভাবেই প্রথমে চোখে পড়ে শিক্ষার ভিত্তি প্রাথমিক শিক্ষা। এই স্তরেই শিশুর হাতে তুলে ধরা হয় চিন্তার প্রথম বীজ, শেখানো হয় প্রশ্ন করতে, বুঝতে, স্বপ্ন দেখতে। প্রাথমিক শিক্ষা হলো যেকোনো জাতির মেরুদণ্ড, যা নির্ধারণ করে দেয় সেই জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞান, অর্থনীতি ও মানবিকতার দৌড়ে কতদূর এগিয়ে যাবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশের এই ভিত্তি আজ সংকটের মুখে। প্রায় ২ কোটি শিশু যাদের হাত ধরে দেশ আগামীতে এগিয়ে যাবে, তাদের শিক্ষাদান করছেন যে শিক্ষকরা, তারাই আজ হতাশা, ক্ষোভ ও বঞ্চনার এক অন্ধকার গহ্বরে নিমজ্জিত। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের অঙ্গীকার থাকা সত্ত্বেও, মাঠপর্যায়ের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। শিক্ষকের মানসিক চাপ, প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলা এবং আর্থিক বৈষম্য পুরো শিক্ষাব্যবস্থাটাকে আস্তে আস্তে দুর্বল করে দিচ্ছে।
শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে যে স্বপ্ন আমরা দেখি, তা শিক্ষকের মনোবেদনা ও অবহেলার মধ্যে কখনোই বাস্তবে রূপ পাবে না। এই সত্য এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ভাবনার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, একজন অসন্তুষ্ট শিক্ষক কখনও পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে পাঠদান করতে পারেন না। যখন একজন শিক্ষক জানেন যে তার পেশার কোনো সামাজিক মর্যাদা নেই, যখন তাঁকে জীবনধারণের জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়, তখন তার পক্ষে কেবল কর্তব্যবোধের কারণে শিশুদের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। প্রাথমিক শিক্ষার এই ধস শুধু ফলাফলের অবনতি নয়, এটি আমাদের জাতীয় অগ্রগতির প্রতি এক গভীর হুমকি।
বৈষম্যের দহন শিক্ষকের মনে জমে ওঠা ক্ষত : প্রাথমিক শিক্ষকতা আজ দেশের অন্যতম বৈষম্যপূর্ণ পেশা। এই বৈষম্য শুধু শিক্ষকদের কর্মস্পৃহাকে নষ্ট করছে না, এটি মেধাবী তরুণদেরও এই পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করছে। একই মন্ত্রণালয়ের অধীনে, অর্থাৎ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে, সমমানের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে যারা শিক্ষকতা শুরু করেন, তাদের মধ্যে বেতনের গ্রেডিং-এ আকাশ-পাতাল পার্থক্য। যেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পান ১৩তম গ্রেড, সেখানে পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পান ১০ম গ্রেড। এটি একটি অগ্রহণযোগ্য দ্বিচারিতা। একই শিক্ষানীতি, একই কারিকুলাম অনুসরণ করে, শিশুদের একই রকম দায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও এই ভিন্নতা চরম হতাশাজনক। এই বৈষম্য শুধু বেতনে নয়, সমাজের দৃষ্টিতেও গভীর রেখাপাত করে।
একজন শিক্ষক যখন জানেন ‘আমারই মন্ত্রণালয়ের অন্য শিক্ষক একই কাজের জন্য তিন গ্রেড এগিয়ে’, তখন তার মনোক্ষোভ শ্রেণিকক্ষ পেরিয়ে পুরো পেশাকে নেতিবাচকভাবে আঘাত করে। তারা নিজেদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করতে শুরু করেন। এই বঞ্চনা শুধুই আর্থিক নয় এটি মর্যাদা, আত্মসম্মান এবং ভবিষ্যৎ পেশাজীবনের উপর এক কঠিন আঘাত। শিক্ষকদের মনে দগদগে ক্ষতের সৃষ্টি করে এই বৈষম্য। তাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করার মাধ্যমে সকল শিক্ষকের জন্য সমমর্যাদা এবং সমবেতন নিশ্চিত করা। কিন্তু সেই দাবি এখনও উপেক্ষিত। গ্রেড বৈষম্যের ফলে শিক্ষকদের মধ্যে এক ধরনের হীনমন্যতা তৈরি হচ্ছে, যা সরাসরি ক্লাসরুমের পরিবেশ এবং পাঠদানের গুণগত মানকে প্রভাবিত করছে। যখন একজন শিক্ষক মানসিক শান্তি নিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করতে পারেন না, তখন শিক্ষার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। এই বৈষম্য যত দ্রুত দূর করা হবে, তত দ্রুত প্রাথমিক শিক্ষায় স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।
পদোন্নতিহীন জীবন : শিক্ষক সমাজের আরেক দীর্ঘস্থায়ী যন্ত্রণা হলো পদোন্নতিহীন দীর্ঘ পথচলা ও বকেয়া টাইমস্কেল। শিক্ষকদের পেশাগত জীবনের একটি স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা থাকে পদোন্নতি, যা তাঁদের কর্মদক্ষতার স্বীকৃতি দেয় এবং নতুন উদ্যমে কাজ করতে উৎসাহিত করে। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষকদের ক্ষেত্রে পদোন্নতি যেন এক সোনার হরিণ। ১০ বছর, ১৬ বছর পূর্তির পর যে আর্থিক সুবিধা পাওয়ার কথা, অর্থাৎ টাইমস্কেল সেটি বছরের পর বছর ধরে ঝুলে থাকা অমানবিক।
এই বকেয়া বেতন-ভাতা শিক্ষকদের পারিবারিক জীবনেও চরম আর্থিক চাপ সৃষ্টি করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আদালতের জটিলতা, যা পুরো পদোন্নতি ব্যবস্থা অচল করে রেখেছে। বহু বছর ধরে চলমান মামলা-মোকদ্দমার কারণে পদোন্নতির ফাইলগুলো আটকে আছে, আর শিক্ষকরা বছরের পর বছর একই পদে থেকে অবসরের দিকে এগোচ্ছেন।
একজন শিক্ষক ১৫-২০ বছর একই পদে থাকলে তার পেশার প্রতি উৎসাহ কীভাবে বজায় থাকে? একটি পদে বছরের পর বছর আটকে থাকলে স্বাভাবিকভাবেই কর্মক্ষেত্রে এক ধরনের স্থবিরতা চলে আসে। শিক্ষকরা দেখেন যে তাদের জুনিয়র সহকর্মীরা অন্য পেশায় দ্রুত পদোন্নতি পাচ্ছে, অথচ তারা বছরের পর বছর একই জায়গায় থমকে আছেন। রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ গড়ার দায়িত্ব যাদের, তাদের জীবনই যদি স্থবির হয়ে যায়, তবে শিক্ষার ভবিষ্যৎও নিশ্চয়ই থমকে যাবে। পদোন্নতির সুযোগ না থাকায় শিক্ষকরা নতুন কিছু শেখার বা উদ্ভাবনী উদ্যোগ নেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এই অচলাবস্থা শুধু শিক্ষকের ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, এটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য একটি মারাত্মক দুর্বলতা। অবিলম্বে পদোন্নতির জটিলতা নিরসন এবং বকেয়া টাইমস্কেল প্রদান করে শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের জমানো ক্ষোভ প্রশমিত করা জরুরি।
শিক্ষক সংকট : যেখানে ভবন আছে, শিক্ষক নেই: সারা দেশে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি দেখানোর জন্য নতুন ভবন, নতুন কক্ষ, নতুন দালান তৈরি হচ্ছে- অবকাঠামোগত উন্নয়নে খরচ হচ্ছে হাজার কোটি টাকা। কিন্তু অনেক স্কুলেই নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক। এই ভারসাম্যহীন উন্নয়ন একটি বিপরীতমুখী চিত্র তৈরি করেছে। একদিকে দৃষ্টিনন্দন ভবন, অন্যদিকে শূন্য শিক্ষক পদ। এই শিক্ষক সংকটের কারণে বহু বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষককে দুই-তিনটি শ্রেণির পাঠদান করতে হচ্ছে। এর ফলে পাঠদান রূপ নিচ্ছে শুধু আনুষ্ঠানিকতায়, শেখা রূপ নিচ্ছে যান্ত্রিকতায়। গুণগত মান সেখানে গৌণ হয়ে যাচ্ছে।
একজন শিক্ষকের পক্ষে একই সময়ে একাধিক শ্রেণির ভিন্ন ভিন্ন বিষয় দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করা অসম্ভব। এই চাপ শিক্ষকদের শুধু ক্লান্ত করে তোলে না, বরং তারা শিশুদেরকে প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হন। শিশুর প্রাথমিক ভিত্তি যে যত্ন, সময় ও মনোযোগের দাবি করে, এই সংকটের কারণে তার কিছুই নিশ্চিত করা যায় না।
ফলে প্রাথমিক স্তরেই শিশুদের শিখন ঘাটতি তৈরি হয়, যা পরবর্তীকালে উচ্চশিক্ষার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সরকারের উচিত, অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াকে দ্রুত ও স্বচ্ছ করা। যেখানে একজন শিক্ষককে অতিরিক্ত দায়িত্ব নিতে হচ্ছে, সেখানে দ্রুততম সময়ের মধ্যে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে এই সংকট মোকাবিলা করা প্রয়োজন। শিক্ষক সংকটের এই গভীরতা ভবিষ্যতের প্রজন্মকে এক দুর্বল ভিত্তির ওপর দাঁড় করাচ্ছে।
উপকরণের অভাব- প্রশিক্ষণ আছে, প্রয়োগ নেই : শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য সরকার বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে। কিন্তু প্রশিক্ষণে অর্জিত জ্ঞান শ্রেণিকক্ষে প্রয়োগের জন্য যে উপকরণের প্রয়োজন, সেগুলোর অধিকাংশ বিদ্যালয়েই অভাব রয়েছে। যথেষ্ট প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও বেশিরভাগ বিদ্যালয়ে নেই চার্ট, মডেল, শিক্ষা-বস্তু বা উপযুক্ত ডিজিটাল কনটেন্ট। ফলে শিক্ষক প্রশিক্ষিত হলেও সেই প্রশিক্ষণের ফল শ্রেণিকক্ষে বাস্তবায়িত হতে পারে না। এই বৈপরীত্য শিক্ষার অগ্রযাত্রাকে এক অদৃশ্য দেয়ালের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। শিক্ষকরা শিখেছেন কীভাবে হাতে-কলমে শিক্ষা দিতে হয়, কিন্তু উপকরণ না থাকায় তারা পুরোনো বক্তৃতানির্ভর পদ্ধতিতে ফিরে যেতে বাধ্য হন।
প্রশিক্ষণে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেও যদি ক্লাসরুমে তার প্রতিফলন না ঘটে, তবে সেই অর্থ ব্যয় প্রায় বৃথা। আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতি শিশুদের খেলাচ্ছলে এবং ব্যবহারিক উপায়ে শেখার উপর জোর দেয়। ডিজিটাল কনটেন্ট, বিজ্ঞানের মডেল, মানচিত্র, খেলার সরঞ্জাম, এগুলোর মাধ্যমে শিশুরা সহজে এবং আনন্দের সঙ্গে শেখে। উপকরণের অভাবে শিক্ষকরা তাদের সৃজনশীলতা প্রয়োগ করতে পারেন না। এটি শুধু শিক্ষকের হতাশা বাড়ায় না, শিশুদের শিখনেও একঘেয়েমি চলে আসে। প্রশিক্ষণের সার্থকতা নিশ্চিত করতে প্রতিটি বিদ্যালয়ে যেন প্রয়োজনীয় শিক্ষামূলক উপকরণ ও ডিজিটাল সুবিধা নিশ্চিত করা হয়, সেদিকে মনোযোগ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত এই উপকরণের ঘাটতি দ্রুত পূরণ করা।
অভিভাবকের ভূমিকা- উপেক্ষিত অথচ অত্যন্ত জরুরি : প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসনের পাশাপাশি অভিভাবকের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই অভিভাবকদের অজ্ঞতা বা অবহেলাও প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতিতে বড় বাধা। অনেকে মনে করেন, স্কুলে পাঠিয়ে দিলেই শিক্ষকের সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। কিন্তু শিশুর শেখার প্রক্রিয়া শুধু শ্রেণিকক্ষের চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। হোমওয়ার্ক তদারকি, স্কুলের নিয়ম মানা, শিক্ষকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ, শিশুর সমস্যা নিয়ে আলোচনা, এসবের অভাব শিশুর শিক্ষাকে স্থবির করে রাখে। অনেক অভিভাবকই জানেন না যে তাঁদের শিশুর শেখার অগ্রগতি নিশ্চিত করতে বাড়িতে কী ধরনের পরিবেশ তৈরি করা দরকার।
কমপ্লিট শাটডাউন- এখনকার সংকটের চূড়ান্ত সতর্কবার্তা : দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে অবশেষে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বার্ষিক পরীক্ষা বর্জন এবং পূর্ণাঙ্গ শাটডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। এটি কোনো হঠাৎ সিদ্ধান্ত নয়, বরং এটি বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা ক্ষোভ, বঞ্চনা ও হতাশার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। ডিসেম্বরের চূড়ান্ত মূল্যায়নকে সামনে রেখে এমন সিদ্ধান্ত বিশাল চাপ তৈরি করেছে শিক্ষাব্যবস্থার উপর। এর মধ্যেই এক ধরনের অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। স্কুলে তালা, শিশুরা বাড়িতে, অভিভাবকের আতঙ্ক, জাতীয় পরীক্ষাপদ্ধতিতে অনিশ্চয়তা। এই পরিস্থিতি আসলে শিক্ষকের নয়, রাষ্ট্রের জন্য একটি কঠোর সতর্কবার্তা।
শিক্ষকের ন্যায্য দাবি দীর্ঘদিন অস্বীকৃত থাকলে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ভরাডুবির দিকেই ধাবিত হবে এটাই ছিল পূর্বাভাস, যা আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। শিক্ষকরা যখন নিজেদের মৌলিক দাবি আদায়ের জন্য শ্রেণিকক্ষ ছেড়ে রাস্তায় নামতে বাধ্য হন, তখন বুঝতে হবে এই সংকটের শিকড় কত গভীরে। এই শাটডাউন শুধু শিক্ষা কার্যক্রমকে ব্যাহত করছে না, এটি লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সরকারের দ্রুততম সময়ে শিক্ষকদের সাথে আলোচনায় বসে তাদের গ্রহণযোগ্য দাবিগুলো মেনে নিয়ে এই অচলাবস্থা নিরসন করা উচিত। শিক্ষার মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে দীর্ঘস্থায়ী ধর্মঘট জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি।
বর্তমান সংকট নিরসনে শিক্ষকদের প্রধান তিনটি দাবিগুলো- ১. দশম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ। ২. ১০০ ভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি। ৩. বকেয়া ১০ ও ১৬ বছরের টাইমস্কেল প্রদান।
এসব দাবি শুধু কারও ব্যক্তিগত চাওয়া নয়, এগুলো শিক্ষককে ক্লাসমুখী করার পূর্বশর্ত, শিক্ষার মান উন্নয়নের মূল কাঠামো এবং জাতীয় উন্নতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। দশম গ্রেড শিক্ষকের সামাজিক ও আর্থিক মর্যাদা বাড়াবে, যা মেধাবীদের এই পেশায় আকৃষ্ট করবে। ১০০ ভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি শিক্ষকদের মধ্যে পেশাগত প্রতিযোগিতা এবং কাজের স্পৃহা বাড়াবে, স্থবিরতা কাটবে। আর বকেয়া টাইমস্কেল শিক্ষকদের আর্থিক দুশ্চিন্তা কমিয়ে তাদের শ্রেণিকক্ষে পূর্ণ মনোযোগ দিতে সহায়তা করবে।
এই দাবিগুলো পূরণ করাকে সরকার যদি শুধু আর্থিক বোঝা হিসেবে বিবেচনা করে, তবে তা হবে একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এই বিনিয়োগ হলো- জাতির ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানবসম্পদ উন্নয়নের বিনিয়োগ। যখন শিক্ষকের মন ভালো থাকবে, তখনই তারা আনন্দের সঙ্গে পাঠদান করবেন এবং শিশুরা মানসম্মত শিক্ষা পাবে। এই দাবিগুলো জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত; কারণ একটি মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়া কোনো দেশের স্থায়ী উন্নতি সম্ভব নয়।
প্রশিক্ষণে হাজার কোটি টাকা ব্যয় যথেষ্ট নয়
অবকাঠামো, প্রশিক্ষণ, ডিজিটালাইজেশন : এসবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সবচেয়ে জরুরি হলো- শিক্ষকের মন ভালো থাকা।
আধুনিক ভবন, ডিজিটাল ক্লাস এবং উচ্চমানের প্রশিক্ষণ শুধু একটি ভালো শিক্ষকের সহায়ক উপকরণ হতে পারে, কিন্তু সেই শিক্ষকের মনের শান্তি না থাকলে কোনো উপকরণই কাজে আসবে না। মনোবেদনা, বঞ্চনা ও মানসিক চাপ নিয়ে কোনো শিক্ষকই তার সর্বোচ্চ দিতে পারেন না। তাঁদের মনে যখন ক্ষোভ আর বঞ্চনার অনুভূতি প্রবল থাকে, তখন সেই মানসিক চাপ শ্রেণিকক্ষেও প্রতিফলিত হয়। একজন অসন্তুষ্ট শিক্ষক কখনও শিশুদের আবেগিক সমর্থন বা পরিপূর্ণ মনোযোগ দিতে পারেন না।
তাই শিক্ষকের মর্যাদা নিশ্চিত করাই প্রাথমিক শিক্ষার প্রকৃত উন্নয়নের প্রথম এবং মৌলিক শর্ত। আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করে শিক্ষকের মনে সন্তুষ্টি ফিরিয়ে আনা গেলে প্রশিক্ষণে দেওয়া জ্ঞান আপনা-আপনিই শ্রেণিকক্ষে প্রবাহিত হবে। উন্নত বেতন কাঠামো এবং সম্মানজনক সামাজিক অবস্থান শিক্ষককে পেশাগতভাবে উৎসাহিত করবে। প্রশিক্ষণে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের আগে শিক্ষকের মনের এ গভীর ক্ষত নিরাময় করা অত্যাবশ্যক।
অতএব, শিক্ষকের সম্মান রক্ষা মানে ভবিষ্যৎ রক্ষা। আমরা যদি সত্যিই উন্নত জাতি হতে চাই-তবে প্রাথমিক শিক্ষককে অবহেলা করার সুযোগ নেই। কারণ তারা শুধু পাঠ শেখান না, তারা চরিত্র গড়েন, স্বপ্ন জাগান। তাই এখনই সময়- শিক্ষকের ন্যায্য দাবি পূরণ করে প্রাথমিক শিক্ষায় স্থিতি ফিরিয়ে আনা। সরকারের উচিত দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি কার্যকর ও বাস্তবসম্মত সমাধান নিয়ে আসা, যা শিক্ষকদের আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করবে। এটাই জাতীয় স্বার্থ, এটাই সামাজিক দায়িত্ব, এটাই আগামী প্রজন্মের প্রতি আমাদের হোক অঙ্গীকার।
আসাদুজ্জামান খান মুকুল
শিক্ষক, কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক