ঢাকা সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

রাজনৈতিক গুজব : অনলাইন বনাম বাস্তবতা

আরিফুল ইসলাম রাফি
রাজনৈতিক গুজব : অনলাইন বনাম বাস্তবতা

রাজনৈতিক গুজব আজ আর শুধু কানে কানে ছড়ানো অচেনা কথার মতো থাকে না; এটি এখন হয়ে উঠেছে এক প্রাতিষ্ঠানিক, সংগঠিত, প্রযুক্তিনির্ভর এবং বহুমাত্রিক শক্তি, যা ক্ষমতার কৌশলের অংশ হিসেবে বিশ্বজুড়েই ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। ডিজিটাল বিপ্লব যেমন মানুষের হাতে দিয়েছে তথ্য পাওয়ার স্বাধীনতা, তেমনি তথ্য বিকৃতির ক্ষমতাও দিয়েছে হাতে হাতে।

ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, ইন্সটাগ্রাম- সব প্ল্যাটফর্মই এখন রাজনৈতিক বার্তাবাহক এবং প্রায়ই সেই বার্তার সত্যতা থাকে সবচেয়ে বেশি সন্দেহজনক। এমন এক সময়ে আমরা দাঁড়িয়েছি, যখন অনলাইনে যা দেখছি, তা বাস্তবতার প্রতিফলন নাও হতে পারে; বরং বাস্তবতা কেমন হবে, তা অনলাইনের প্রতিচ্ছবি তৈরি করে দিচ্ছে। ফলে গুজব হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক অস্ত্র; আর ভোটের মাঠ থেকে ব্যক্তিগত ভাবনার ঘরে পর্যন্ত তার ছাপ অস্বীকার করার উপায় নেই।

গুজবের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এটি মানুষের আবেগকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে। রাজনৈতিক গুজব সেই আবেগকে নেয় আগুনের মতো দাউ দাউ করে জ্বালাতে। একটি জাতির আবেগের কেন্দ্রে থাকে ভয়, আশা, ঘৃণা, বিশ্বাস- এই চারটি জায়গায় আঘাত করলেই মানুষ দ্রুত উত্তেজিত হয়। রাজনৈতিক দলগুলো তা খুব ভালো করেই জানে। তাই তারা নিজের অবস্থানকে ঈশ্বরত্বের মতো উঁচু করে তুলে ধরতে এবং প্রতিপক্ষকে বিশ্বাসঘাতক, রাষ্ট্রবিরোধী বা নৈতিকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত দেখাতে গুজব-যন্ত্র ব্যবহার করে। একেকটি দলের জন্য হাজার হাজার জনবল অনলাইনে নিরলস কাজ করে; কেউ এক্সপার্ট, কেউ স্বেচ্ছাসেবক, অনেকেই হয়ত টাকার বিনিময়ে। কেউ আবার বিশ্বাস করে তার দলের প্রতিটি কথা সত্য, আর প্রতিপক্ষের সব কথা মিথ্যা। এই বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়েই একটি ডিজিটাল যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি হয়, যেখানে সত্যের কোনো নিজস্ব অস্তিত্ব থাকেই না; প্রত্যেকে নিজের তৈরি সত্যকেই পূজা করে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে, গুজব শুধু দলীয় প্রতিপক্ষকে হেয় করার জন্যই ছড়ানো হয় না; বরং জনমতকে নির্দিষ্ট দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য, ভোটের আগের পরিবেশ তৈরি করার জন্য কিংবা কোনো রাজনৈতিক ঘটনাকে আতঙ্কজনক বা রোমাঞ্চকর করে তুলতে ব্যবহার করা হয়। যেমন কোনো একটি ছোটখাটো ঘটনা ধরা যাক, স্থানীয় পর্যায়ের কোনো সংঘর্ষ, এটি মুহূর্তেই সোশ্যাল মিডিয়ায় এমনভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয় যেন পুরো দেশ অরাজকতার কিনারায় পৌঁছে গেছে। এতে যে রাজনৈতিক লাভ হচ্ছে তা হলো; মানুষ আতঙ্কিত হচ্ছে, এক পক্ষ মনে করছে দেশ শেষ হয়ে গেল, অন্য পক্ষ মনে করছে দেশের ভেতরে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। অথচ বাস্তবতা হয়তো একটিমাত্র এলাকার দুই পক্ষের ভুল বোঝাবুঝির সংঘর্ষ, যা ঘণ্টাখানেক পরেই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু ডিজিটাল মঞ্চে সেই ঘটনা মরে না; গুজব তাকে বাড়িয়ে, লম্বা করে, উত্তেজনা জাগিয়ে মানুষের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেয়।

এখন প্রশ্ন হলো, গুজব ছড়ানো এত সহজ হলো কিভাবে?

প্রথমত, প্রযুক্তিগত কারণে। এখন প্রত্যেকের হাতে স্মার্টফোন; ক্যামেরা আছে, ভিডিও তোলার সুযোগ আছে, ইন্টারনেটে আপলোড করতে সময় লাগে দুই সেকেন্ড। ফটোশপ, ভিডিও-এডিটিং অ্যাপ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি কণ্ঠ বা মুখ- এসব কারণে বাস্তবতার ওপর নিয়ন্ত্রণ পাওয়া অনেক সহজ। একটি ছবি অন্য ঘটনার সঙ্গে যুক্ত করা গেলেই মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। কেউ যাচাই করার চেষ্টা করে না; বরং যা দেখতে চায়, তা-ই বিশ্বাস করে। রাজনৈতিক সত্য এখন আর যৌক্তিকতার ওপর দাঁড়িয়ে নেই; এটি দাঁড়িয়ে আছে আমাদের প্রত্যাশা, ভয় ও পক্ষপাতের ওপর।

দ্বিতীয়ত, এলগরিদমিক কারণ। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক- এই প্ল্যাটফর্মগুলো মানুষের মনোযোগ ধরে রাখতে চায়। তারা জানে, বিতর্কিত বা উত্তেজনাপূর্ণ কন্টেন্ট মানুষের চোখ সবচেয়ে বেশি আটকে রাখে। ফলে ভুয়া কিংবা অর্ধসত্য ভিডিও খুব সহজেই ভাইরাল হয়ে যায়। রাজনৈতিক দলগুলো তা বুঝে গেছে এবং সেই বুঝ থেকেই তারা বানিয়ে ফেলেছে নিজেদের ডিজিটাল সৈন্যদল। একটি ক্যামেরায় ধারণ করা পুরোনো ফুটেজকে বলা হয় নতুন গণহত্যা; একটি অন্য দেশের ঘটনা বলা হয় বাংলাদেশের ঘটনা; খণ্ডিত কোনো ভাষণকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন বক্তা দেশকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করছেন। এবং একদল অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তা, কর্মী, অনুসারী, অথবা ভাড়াটে ডিজিটাল যোদ্ধা ঐ ভিডিওগুলো একযোগে শেয়ার করে, কমেন্টে লিখে, একই ক্যাপশন কপি-পেস্ট করে সেটিকে একটি ‘সত্য’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। রাজনৈতিক গুজবের একটি বড় শক্তি হলো, এটি সাধারণত এমন বিষয় নিয়ে তৈরি করা হয় যা লোকেরা শুনতে আগ্রহী। যদি একটি দল নিজেকে উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে দেখাতে চায়, তাহলে তারা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে গুজব ছড়াবে, ওরা এলে দেশ অন্ধকারে ফিরে যাবে। আর প্রতিপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে ছড়াবে, ওরা রাষ্ট্র বিক্রি করে দিচ্ছে। কেউ বলবে গোপনে বিদেশী চুক্তি হয়েছে; কেউ বলবে সেনাবাহিনী বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে; কেউ বলবে নির্বাচন বাতিল হবে; কেউ বলবে রাষ্ট্রপতির বাড়ি ঘিরে রেখেছে বাহিনী। এসব কোনো খবরেরই সত্যতা থাকে না, কিন্তু প্রতিটি খবর মানুষের ভয়ের জায়গায় আঘাত করে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রকৃত কৌশল এখানেই, মানুষকে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা, যাতে তারা যাচাই করতে ভুলে যায়। এখানে একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, গুজব কখনো মানুষের কাছে অচেনা সত্য মনে হয় না। বরং যা সে আগে থেকেই বিশ্বাস করে, গুজব তাকে আরও দৃঢ় করে। যাকে রাজনৈতিক ভাষায় বলে ‘Confirmation bias’ মানুষ যা বিশ্বাস করতে চায়, তারই প্রমাণ খুঁজে। ফলে গুজবের বার্তা যতই হাস্যকর হোক, যদি সেটি তার রাজনৈতিক বিশ্বাসের সঙ্গে মিলে যায়, তবে সে তা শেয়ার করবে, প্রচার করবে, এমনকি রক্ষা করবে। এই প্রবণতাকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ডিজিটাল প্রোপাগান্ডাকে এমনভাবে সাজিয়ে ফেলে যেন প্রতিটি মিথ্যা শোনায় সত্যের মতো, আবার প্রতিটি সত্য শোনায় মিথ্যার মতো।

এখন বাস্তবতা হলো, সোশ্যাল মিডিয়া একটি অনিয়ন্ত্রিত মহাসড়ক, যেখানে ট্রাফিক পুলিশ নেই, সিগন্যাল নেই, নিরাপত্তা নেই। কেউ একটি গুজব ছড়িয়ে দিলে তাকে আটকানোর কোনো ব্যবস্থা থাকে না, যদি না কেউ সেটি রিপোর্ট করে এবং প্ল্যাটফর্ম কর্তৃপক্ষ সেটি মুছে দেয়। কিন্তু রাজনীতির গুজব এত দ্রুত ছড়ায় যে, প্ল্যাটফর্ম তা ধরার আগেই লাখো মানুষ তা দেখে ফেলে। ফলে সত্য তখন বিবেকহীন শব্দে চাপা পড়ে যায়, মিথ্যা হয়ে ওঠে একমাত্র প্রচারিত বাস্তবতা। গুজব রাজনৈতিক অস্ত্র হওয়ার পাশাপাশি হয়ে ওঠে সামাজিক রোগ, যা মানুষকে বিভক্ত করে, সমষ্টিগত আস্থা নষ্ট করে এবং গণতান্ত্রিক চরিত্রকে ভেতর থেকেই ক্ষয় করে দেয়।

গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো তথ্য। নাগরিকদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সঠিক তথ্য প্রয়োজন। কিন্তু যখন রাজনৈতিক গুজব পূর্ণদমে ছড়ানো হয়, তখন জনগণ সিদ্ধান্ত নেয় ভয়, উত্তেজনা ও বিভ্রান্তির ওপর ভিত্তি করে। এতে সমাজে এমন বিভক্তি তৈরি হয়, যা সময়ের সঙ্গে আরও গভীর হয়। পরিবারে, বন্ধুদের মধ্যে, কর্মস্থলে- সব জায়গায় রাজনৈতিক বিভাজন চরমে উঠে যায়। মানুষ যুক্তি শুনতে চায় না; চায় তার দলের পক্ষে থাকা আবেগের ধারালো ভাষা। ফলে রাজনৈতিক মতামত হয়ে দাঁড়ায় যুদ্ধের অস্ত্র; ভাবনার স্বাধীনতা কমে। এমনকি যেকোনো সত্যিকারের পরিবর্তনের সম্ভাবনাও কমে যায়, কারণ মানুষ আর নিরপেক্ষ তথ্য বিশ্বাস করে না, সে বিশ্বাস করে তার দল যা বলবে, তার নেতারা যা শেয়ার করবে।

এই প্রেক্ষাপটে বড় সমস্যা হলো, নাগরিকরা নিজেরাই ধীরে ধীরে নিজের সোশ্যাল মিডিয়া অভ্যাস দ্বারা তৈরি এক প্রকার বুদবুদের মধ্যে আটকা পড়ে। আপনি যদি কোনো একটি মতাদর্শিক কন্টেন্টে লাইক দেন, তাহলে প্ল্যাটফর্ম আপনাকে সেই ধারার আরও হাজারো ভিডিও দেখাতে থাকে। এতে আপনি মনে করতে থাকেন দেশে সবাই আপনার মতোই চিন্তা করে, আপনার মতোই বিশ্বাস করে এবং আপনার প্রতিপক্ষরা একেবারেই অসংখ্য, অস্বাভাবিক বা নিরাপত্তা-হুমকি। এই বুদবুদ রাজনৈতিক দলগুলোর সবচেয়ে বড় সম্পদ; কারণ এটি মানুষের মনে প্রতিপক্ষকে ‘শত্রু’ বানিয়ে দেয়। একবার কোনো প্রতিপক্ষকে শত্রু মনে করলে তাকে নিয়ে যে কোনো গুজব বিশ্বাস করা সহজ হয়ে যায়।

এভাবে একটি সমাজ ধীরে ধীরে বিভাজিত হতে থাকে; একটি পক্ষ দুপুরের সূর্যকে সূর্য দেখে, অন্য পক্ষ তাকে বলে এটি মিথ্যা; অন্য কোনো ভুয়া আলো। কেউ যখন সত্যের বদলে গুজবকে গ্রহণ করে, তখন তার যুক্তি হারিয়ে যায়, তার বাস্তবতা ভেঙে পড়ে। দেশে গণমাধ্যমের প্রতি আস্থাও তখন নেমে আসে। অনেকেই মনে করে সংবাদপত্র মিথ্যা বলে; টেলিভিশন মিথ্যা বলে; কেবল ফেসবুকই সত্য বলে। আবার অন্য পক্ষ বিশ্বাস করে ফেসবুক ভুয়া, টিভি সত্য। এখানে সত্য কোথায়, তা কেউ খুঁজে দেখে না; প্রত্যেকে শুধু নিজের পছন্দের সত্য খুঁজে নেয়। গুজব মানুষের চেতনা দখল করে নেয় এবং একসময়ে মিথ্যা ও সত্যের ব্যবধান এত ক্ষুদ্র হয়ে পড়ে যে মানুষ আর পার্থক্য করতে পারে না।

রাজনৈতিক গুজবের ভয়াবহতা এখানেই শেষ নয়; এটি সরাসরি সহিংসতা উস্কে দিতে পারে। ইতিহাসে বহু দেশেই দেখা গেছে ভুয়া খবরের কারণে গণপিটুনি, দাঙ্গা, ধর্মীয় উত্তেজনা কিংবা রাজনৈতিক প্রতিশোধের ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশেও বহুবার দেখা গেছে কাউকে গুজবে অপবাদ দেওয়া হলে, কিছু উৎসাহী মানুষ যাচাই না করেই তাকে অভিযুক্ত করে ফেলে। রাজনৈতিক দলগুলো যখন নিজেদের সমর্থকদের সংগঠিত করতে চায়, তখন তারা গুজবকে ব্যবহার করে একটি শত্রু তৈরি করে, যাকে ঘৃণা করা যায়, যার বিরুদ্ধে রাগ জমা রাখা যায়। এটি গণতন্ত্রকে অনেক দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।

তাহলে প্রশ্ন হলো, এই বাস্তবতা বদলানো সম্ভব কি না? অবশ্যই সম্ভব, যদি কয়েকটি বিষয় দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করা যায়। প্রথমত, গণমাধ্যম সাক্ষরতা বাড়াতে হবে নাগরিক পর্যায়ে। মানুষকে শেখাতে হবে কোনো তথ্য দেখলেই তা বিশ্বাস করতে নেই; উৎস যাচাই করতে হবে, ক্রসচেক করতে হবে, একাধিক নির্ভরযোগ্য মাধ্যম থেকে খবর তুলনা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজস্ব অভ্যন্তরীণ নৈতিকতার চর্চা বাড়াতে হবে; যদিও বাস্তবে এটি খুব কঠিন, কারণ তাদের কাছে ক্ষমতাই সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়। তবুও জনগণের চাপ, সুশীল সমাজের বক্তব্য, সাংবাদিকতার স্বাধীনতা- এসব রাজনৈতিক দলগুলোকে কিছুটা হলেও দায়িত্বশীল করে তুলতে পারে।

আরিফুল ইসলাম রাফি

শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত