প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৮ ডিসেম্বর, ২০২৫
বর্তমান বিশ্বজুড়ে যে অর্থনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে, তার ঢেউ আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকেও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ, ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির মতো সমস্যাগুলো অর্থনৈতিক স্থবিরতার স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। এই গভীর ও বহুমুখী সংকট থেকে স্থিতিশীল এবং টেকসই উপায়ে উত্তরণের পথ খুঁজতে গিয়ে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি তাই অনিবার্যভাবেই দেশের কৃষি খাতের দিকে নিবদ্ধ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কৃষি, যা ঐতিহ্যগতভাবে কেবল খাদ্য নিরাপত্তার আধার হিসেবে বিবেচিত, তাকে এখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার প্রধান ইঞ্জিন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সময় এসেছে। তবে এই রূপান্তরের ভিত্তি হতে হবে সনাতন পদ্ধতির বদলে আধুনিক, বিজ্ঞানভিত্তিক ও প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি ব্যবস্থা।
অর্থনৈতিক সংকটের মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আমদানি-নির্ভরতা। যখন দেশের খাদ্য, কাঁচামাল এবং এমনকি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের জন্য বহির্বিশ্বের ওপর নির্ভরতা অত্যাধিক হয়, তখন আন্তর্জাতিক বাজারের সামান্য অস্থিরতাও অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। বিশেষত খাদ্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি সরাসরি মুদ্রাস্ফীতিকে উসকে দেয় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে নিঃশেষ করে। এই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন অপরিহার্য, আর এর সবচেয়ে শক্তিশালী ক্ষেত্রটি হলো কৃষি। কৃষিকে কেবল শস্য উৎপাদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, এটিকে একটি শিল্প হিসেবে বিবেচনা করতে হবে, যেখানে উৎপাদনশীলতা, দক্ষতা এবং মূল্য সংযোজনের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে।
আধুনিক কৃষি বলতে কেবল উন্নত বীজ বা রাসায়নিক সারের ব্যবহার বোঝায় না। এটি হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমাহার, যা কৃষিকে আরও কার্যকর, লাভজনক এবং পরিবেশবান্ধব করে তোলে। এর মূল স্তম্ভগুলির মধ্যে রয়েছে— যথার্থতা কৃষি (Precision Agriculture), কৃষি-যন্ত্রায়ন (Mechanization), জলবায়ু সহনশীল শস্যের উন্নয়ন, টেকসই জল ব্যবস্থাপনা এবং ফসল-উত্তর ক্ষতি (Post-harvest Loss) হ্রাস। সনাতন পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করা আমাদের অর্থনীতির প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম ফলনশীল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন ড্রোন, সেন্সর এবং স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রাপ্ত ডেটা ব্যবহার করে কখন, কোথায় এবং কী পরিমাণ সার বা জল প্রয়োজন, তা নির্ভুলভাবে জানা সম্ভব। এর ফলে সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হয়, উৎপাদন খরচ কমে এবং ফলন বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। এই ধরনের কৌশল বাস্তবায়নের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।
অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য আধুনিক কৃষির প্রথম গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং খাদ্য আমদানির প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করা। খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে, যা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। একই সঙ্গে, অভ্যন্তরীণ বাজারে খাদ্যের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন থাকায় খাদ্যজনিত মুদ্রাস্ফীতির চাপ বহুলাংশে কমবে, যা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে। দ্বিতীয়ত, আধুনিক কৃষিতে মনোযোগ দিলে রপ্তানি আয়ের সম্ভাবনা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। মানসম্মত, আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী উৎপাদিত ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য বৈশ্বিক বাজারে সহজে প্রবেশাধিকার লাভ করে। উদাহরণস্বরূপ, ফল, সবজি, মশলা এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্যদ্রব্যের রপ্তানি বৃদ্ধি পেলে তা দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে শক্তিশালী করবে।
আধুনিক কৃষির অন্যতম প্রধান সুবিধা হলো মূল্য সংযোজন (Value Addition)-এর ওপর জোর দেওয়া। কেবল কাঁচা ফসল বিক্রি না করে সেগুলোকে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে উচ্চমূল্যের পণ্যে রূপান্তর করা অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কৃষি-ভিত্তিক শিল্প এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট স্থাপন করলে একদিকে যেমন কৃষিপণ্যের অপচয় কমে, অন্যদিকে তেমনি গ্রামীণ ও শহরতলির এলাকায় প্রচুর নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। এই প্রক্রিয়াকরণ শিল্পগুলো স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল সংগ্রহ করায় কৃষকদের পণ্যের ন্যায্য মূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত হয়, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে অর্থপ্রবাহ বাড়ায় এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করে। কৃষিকে ঘিরে গড়ে ওঠা এই সরবরাহ শৃঙ্খল (Supply Chain)- সংরক্ষণাগার (যেমন কোল্ড স্টোরেজ), পরিবহন, প্রক্রিয়াকরণ এবং বাজারজাতকরণ, এই সবকটি ধাপই অর্থনীতিকে গতিশীল করে।
এছাড়াও, জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান কৃষির জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, খরা এবং বন্যা ফসল উৎপাদনকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। এই প্রেক্ষাপটে, জলবায়ু সহনশীল শস্যের জাত উদ্ভাবন ও ব্যবহার এবং টেকসই জল ব্যবস্থাপনা আধুনিক কৃষির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। উন্নত সেচ ব্যবস্থা, যেমন ড্রিপ ইরিগেশন বা স্প্রিংকলার পদ্ধতি, জলের অপচয় কমায় এবং ফসলের ফলন বাড়াতে সহায়ক। ভূগর্ভস্থ জলের অতিরিক্ত ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং বৃষ্টির জল সংরক্ষণ নিশ্চিত করা টেকসই কৃষির জন্য আবশ্যক। এই ধরনের জল ব্যবস্থাপনার দক্ষতা কৃষি উৎপাদনকে আবহাওয়ার অনিশ্চয়তা থেকে রক্ষা করে, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। আধুনিক কৃষিতে রূপান্তরের জন্য নীতির ধারাবাহিকতা এবং কার্যকর বিনিয়োগ অত্যন্ত জরুরি। কৃষকদের কাছে আধুনিক প্রযুক্তির সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য সরকার ও বেসরকারি উভয় খাতকে এগিয়ে আসতে হবে। কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ানো, মানসম্পন্ন বীজ ও সার সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং কৃষি ঋণ সহজলভ্য করা অত্যাবশ্যক। পাশাপাশি, কৃষকদেরকে এই নতুন প্রযুক্তি এবং পদ্ধতির ব্যবহার সম্পর্কে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত করতে হবে। ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানকে একত্রিত করার মাধ্যমেই কৃষি খাত সত্যিকার অর্থে অর্থনৈতিক সংকটের মুখে ঢাল হিসেবে দাঁড়াতে পারে।
তবে, শুধুমাত্র উৎপাদনের দিকে মনোযোগ দিলেই হবে না; বাজার সংযোগ ও বিপণন ব্যবস্থাকে আধুনিক করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার করে কৃষকরা সরাসরি ক্রেতাদের কাছে পৌঁছাতে পারে, মধ্যস্বত্বভোগীদের নির্ভরতা কমিয়ে পণ্যের ন্যায্য মূল্য পেতে পারে। এতে করে ক্রেতারাও অপেক্ষাকৃত কম দামে পণ্য ক্রয় করতে পারে, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক চাপ কমাতে সহায়ক। কৃষক সমবায় সমিতি (Farmer Cooperatives) গঠন ও শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে কৃষকদের দর কষাকষির ক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং ছোট আকারের কৃষকদেরও আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণে উৎসাহিত করা সম্ভব।
সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়, আধুনিক কৃষি কেবল অর্থনীতির একটি খাত নয়; এটি অর্থনৈতিক সংকটের মুখে একটি শক্তিশালী রক্ষাকবচ ও প্রবৃদ্ধির সুযোগ। সঠিক কৌশল, প্রযুক্তির প্রয়োগ, এবং অনুকূল নীতিমালার মাধ্যমে কৃষি খাতকে পুনরুজ্জীবিত করা হলে তা খাদ্য নিরাপত্তা, রপ্তানি বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে। এটি আমাদের দেশকে আমদানি-নির্ভরতা থেকে মুক্তি দিয়ে একটি স্থিতিশীল, আত্মনির্ভরশীল ও শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তোলার পথে চালিত করবে। এই মহৎ লক্ষ্য অর্জনে এখন আর কালক্ষেপণের কোনো সুযোগ নেই; আধুনিক কৃষিতে বিনিয়োগ এখন কেবল একটি অর্থনৈতিক পছন্দ নয়, এটি আমাদের অর্থনীতির সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এক অপরিহার্য রণনীতি। সরকার, কৃষক এবং বেসরকারি উদ্যোগ— সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে কৃষিকে তার পূর্ণ সম্ভাবনায় বিকশিত করতে এবং দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত করতে।
সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়, আধুনিক কৃষি কেবল অর্থনীতির একটি খাত নয়; এটি অর্থনৈতিক সংকটের মুখে একটি শক্তিশালী রক্ষাকবচ ও প্রবৃদ্ধির সুযোগ।
ওসমান গনি
লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট