প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫
হৃদযন্ত্র মানুষের শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটি রক্ত সঞ্চালন এবং অক্সিজেন সরবরাহের মাধ্যমে শরীরের প্রতিটি কোষকে কার্যক্ষম রাখে। হৃদযন্ত্রে সামান্য ত্রুটিও জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ এবং শারীরিক নিষ্ক্রিয়তার কারণে হৃদরোগ এখন নিত্যদিনের বাস্তবতা। একসময় এটি শুধু মধ্যবয়সী বা বৃদ্ধদের রোগ হিসেবে ধরা হতো; কিন্তু বর্তমানে শিশু, তরুণ এবং নারী-পুরুষ-সবার জন্যই ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দৈনন্দিন জীবনে দীর্ঘসময় কম শারীরিক পরিশ্রম, ভেজাল ও অতিমিষ্ট খাবার, ফাস্টফুড এবং মানসিক চাপ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি আমাদের জীবনধারা পরিবর্তন না হয়, তবে পরবর্তী ১০-২০ বছরে হৃদরোগে মৃত্যুর হার দ্বিগুণ হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে ওপেন হার্ট সার্জারি রোগীদের জন্য জীবন রক্ষাকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যারা হৃদরোগে গুরুতর ঝুঁকিতে রয়েছেন, তাদের জন্য এটি এক ধরনের ‘শেষ আশ্রয়’। তবে সার্জারির সঙ্গে জড়িত ঝুঁকি এবং পরে দীর্ঘমেয়াদি জীবনধারার পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা সব সময় মনে রাখতে হয়।
বিশ্বে হৃদরোগ ও ওপেন হার্ট সার্জারির চিত্র : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১৭ লাখ মানুষ হৃদরোগ এবং স্ট্রোকে মারা যাচ্ছে।
এটি মোট বৈশ্বিক মৃত্যুর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের কারণে মৃত্যু শুধু বৃদ্ধদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; যুবক এবং শিশুদের মধ্যেও হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়েছে। বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর আনুমানিক ৫০-৬০ লাখ ওপেন হার্ট সার্জারি করা হয়। পুরুষদের মধ্যে করোনারি আর্টারি ডিজিজ বেশি হওয়ায় বাইপাস সার্জারির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। নারীদের ক্ষেত্রে রোগ শনাক্তে দেরি হওয়ায় চিকিৎসা জটিল হয়ে যায়। অনেক নারী বুকব্যথা, শ্বাসকষ্ট বা ক্লান্তিকে সাধারণ সমস্যা মনে করে উপেক্ষা করেন। ফলে চিকিৎসকের কাছে পৌঁছানোর সময় রোগ অনেকটাই জটিল হয়ে ওঠে।
শিশুদের মধ্যে জন্মগত হৃদরোগও উদ্বেগজনক, কারণ প্রতি বছর আনুমানিক ১৩ লাখ শিশু জন্মগত হৃদরোগ নিয়ে জন্মায়। এর মধ্যে ৩-৪ লাখ শিশুর জীবনের প্রথম কয়েক বছরের মধ্যে ওপেন হার্ট সার্জারি প্রয়োজন হয়। উন্নত দেশে এসব শিশুর বেশিরভাগই সময়মতো চিকিৎসা পায়, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে হাজার হাজার শিশু চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে অকালেই মারা যায়। এই বাস্তবতা আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতার দিকে ইঙ্গিত করে।
বাংলাদেশে হৃদরোগ নীরব মহামারি : বাংলাদেশে হৃদরোগ এখন নীরব মহামারির আকার নিয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি গবেষণার অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর প্রায় ২ লাখ মানুষ হৃদরোগে মারা যায়, যা মোট মৃত্যুর প্রায় ৩০-৩৫ শতাংশ। বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ মানুষ কোনো না কোনো হৃদরোগে আক্রান্ত।
শহরে জীবনযাত্রা, ভেজাল খাদ্য, ধূমপান, উচ্চ রক্তচাপ এবং অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস এই সংকটকে আরও তীব্র করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দেশের জীবনধারা যদি পরিবর্তন না হয়, তবে আগামী দুই দশকে হৃদরোগে মৃত্যুর হার আরও বাড়তে পারে। এছাড়াও মানসিক চাপ ও জীবনধারার অনিয়ম হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
বাংলাদেশে ওপেন হার্ট সার্জারির চিত্র : দেশে বছরে আনুমানিক ৩০-৩৫ হাজার ওপেন হার্ট সার্জারি সম্পন্ন হয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে প্রকৃত চাহিদা রয়েছে ১ লক্ষেরও বেশি রোগীর। অর্থাৎ, প্রয়োজনের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ রোগীই সার্জারি পাচ্ছেন। পুরুষ রোগীর হার বেশি- প্রায় ৭০ শতাংশ পুরুষ, ২৫ শতাংশ নারী এবং ৫ শতাংশ শিশু ও কিশোর। নারীর চিকিৎসা অনেক সময় সামাজিক ও পারিবারিক কারণে পিছিয়ে যায়। তারা শেষ পর্যায়ে হাসপাতাল আসে, ফলে সার্জারির ঝুঁকি ও মৃত্যুহার দুটোই বেড়ে যায়।
শিশু রোগীদের করুণ বাস্তবতা আরও দুঃখজনক। দেশে প্রতি বছর প্রায় ৭০-৭৫ হাজার শিশু জন্মগত হৃদরোগ নিয়ে জন্মায়। এর মধ্যে ২০-২৫ হাজার শিশুর ওপেন হার্ট সার্জারি প্রয়োজন, কিন্তু বাস্তবে বছরে মাত্র ৬-৭ হাজার শিশুই সার্জারি পায়। পর্যাপ্ত শিশু কার্ডিয়াক কেন্দ্র, দক্ষ জনবল এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতা হাজার হাজার শিশুকে চিকিৎসার বাইরে রাখে।
ওপেন হার্ট সার্জারি কী এবং কেন প্রয়োজন : ওপেন হার্ট সার্জারি হলো- এমন একটি অস্ত্রোপচার যেখানে রোগীর বুকের হাড় কেটে হৃদযন্ত্রে সরাসরি চিকিৎসা করা হয়। এটি সাধারণত প্রয়োজন হয়- হার্টে রক্তনালীর ব্লক হলে (বাইপাস সার্জারি), হার্টের ভাল্ব নষ্ট বা লিক হলে, জন্মগত হৃদযন্ত্রের ছিদ্র বা গঠনগত ত্রুটিতে এবং জটিল হার্ট ফেইলিউরের ক্ষেত্রে এই সার্জারি ছাড়া অনেক রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই সীমিত। অপারেশনের সফলতা সত্ত্বেও রোগীকে সার্জারির পরে আজীবন নিয়মিত চিকিৎসা, জীবনধারার পরিবর্তন এবং ওষুধ সেবনের ওপর নির্ভর করতে হয়।
বাংলাদেশে খরচ এবং বৈষম্য, সরকারি হাসপাতাল : ৪০-৮০ হাজার টাকা (ভর্তুকির কারণে কম, তবে দীর্ঘ অপেক্ষা এবং সীমিত সুযোগ)।
বেসরকারি হাসপাতাল : সাধারণ সার্জারি ৩-৮ লাখ টাকা, জটিল ক্ষেত্রে ১০ লাখ বা তার বেশি।
বিশ্বের অন্য দেশে খরচের পার্থক্য বিশাল : ভারত: ৭-১৫ লাখ টাকা, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর: মাঝারি খরচ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ: প্রায় ১ কোটি টাকা বা তার বেশি। এই ব্যবধান চিকিৎসা পর্যটনের জন্ম দিয়েছে। উন্নয়নশীল দেশের রোগীরা প্রায়ই উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাচ্ছেন।
ঝুঁকি ও সার্জারির পর জীবন : ওপেন হার্ট সার্জারি একটি বড় অস্ত্রোপচার। এতে ঝুঁকি রয়েছে যেমন- রক্তক্ষরণ, সংক্রমণ, স্ট্রোক, কিডনি বা ফুসফুসের জটিলতা। সফল সার্জারির পরও রোগীকে দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, নিয়মিত ব্যায়াম, ওষুধ সেবন এবং মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ আজীবনের দায়িত্ব।
শিশুদের হৃদরোগ উদ্বেগজনক বাস্তবতা : বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৭০-৭৫ হাজার শিশু জন্মগত হৃদরোগ নিয়ে জন্মায়। এর মধ্যে ২০-২৫ হাজার শিশুর ওপেন হার্ট সার্জারি প্রয়োজন, কিন্তু বাস্তবে বছরে মাত্র ৬-৭ হাজার শিশু সার্জারি পায়। পর্যাপ্ত শিশু কার্ডিয়াক কেন্দ্র, দক্ষ জনবল এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতা অনেক শিশুকে চিকিৎসার বাইরে রাখে। শিশুদের চিকিৎসা সঠিকভাবে না হলে, তাদের জীবনের মান এবং আয়ু কমে যায়। এজন্য শিশু কার্ডিয়াক সেন্টারের সম্প্রসারণ এবং দক্ষ চিকিৎসক প্রয়োজন।
প্রতিরোধ, সবচেয়ে বড় চিকিৎসা: বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রায় ৮০ শতাংশ হৃদরোগ প্রতিরোধযোগ্য। নিয়মিত ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর খাবার, ধূমপান ও মাদক পরিত্যাগ, রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ- এই অভ্যাসগুলো হাজার হাজার মানুষকে ওপেন হার্ট সার্জারির প্রয়োজন থেকে বাঁচাতে পারে।
প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যচর্চা শুধু জীবন রক্ষা করে না, বরং চিকিৎসার খরচ কমায় এবং রোগীদের মানসিক চাপও হ্রাস করে। এজন্য সরকার, পরিবার এবং সমাজের প্রতিটি স্তরের সচেতনতা অপরিহার্য।
পরিশেষে বলতে চাই, ওপেন হার্ট সার্জারি আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক অসাধারণ অর্জন। এটি জীবন বাঁচাতে সক্ষম, কিন্তু শুধুমাত্র সার্জারি দিয়ে হৃদরোগের সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়। আমাদের স্বাস্থ্যনীতি, পরিবার, সমাজ এবং ব্যক্তির সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। বাংলাদেশে প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যনীতি শক্তিশালী করা, নারীর স্বাস্থ্য এবং শিশুদের কার্ডিয়াক পরিচর্যা অগ্রাধিকার দেওয়া, দক্ষ চিকিৎসক এবং কার্ডিয়াক কেন্দ্র বৃদ্ধি করা, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং জীবনধারার পরিবর্তন অপরিহার্য।
হৃদযন্ত্র সুস্থ না থাকলে ব্যক্তি, পরিবার বা রাষ্ট্রের কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না। প্রতিটি জীবন গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রতিটি হৃদয়কে সুস্থ রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার। আমাদের উচিত শুধুমাত্র চিকিৎসা নয়, প্রতিরোধ ও সচেতনতার মাধ্যমে হৃদরোগকে প্রকৃত অর্থে নিয়ন্ত্রণ করা। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা তখনই অর্থপূর্ণ হবে, যখন হার্ট সুস্থ থাকবে, শিশুরা নিরাপদ জন্ম নেবে এবং যুবা জনগণ স্বাস্থ্যবান জীবন যাপন করবে। একক সার্জারি নয়, বরং সুস্থ জীবনধারাই টেকসই সমাধান।
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
কলাম লেখক ও জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষক , প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি