ঢাকা সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

লাভজনক সরিষা : তেল আমদানি কমাতে কৃষি খাতে বিপ্লবের সম্ভাবনা

ওসমান গনি
লাভজনক সরিষা : তেল আমদানি কমাতে কৃষি খাতে বিপ্লবের সম্ভাবনা

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির ভূমিকা অনস্বীকার্য হলেও, কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে আত্মনির্ভরশীলতার পথে এখনও কিছু বড় চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। এর মধ্যে অন্যতম হলো ভোজ্যতেলের জন্য আমদানিনির্ভরতা। প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয় এই খাতে, যা দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এই প্রেক্ষাপটে, শীতকালীন ফসল সরিষা চাষ শুধু একটি গতানুগতিক কৃষিকাজ নয়, বরং এটি দেশের অর্থনীতিকে আমদানিনির্ভরতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে এক নতুন কৃষি বিপ্লবের সূচনা করতে পারে। সরিষার লাভজনক দিকগুলো এবং এর সম্প্রসারণের মাধ্যমে কীভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা আজ সময়ের দাবি।

সরিষা, যা মূলত তেল উৎপাদনকারী বীজ হিসেবে পরিচিত, এর বহুমুখী উপকারিতা রয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে সরিষার তেল এ দেশের রন্ধনশিল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু এর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা কেবল এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। সরিষা দ্রুত বর্ধনশীল একটি ফসল, যা বোরো ধান রোপণের আগে স্বল্প সময়ের মধ্যে আবাদ করা যায়। এর ফলে পতিত জমিকে উৎপাদনশীল করে তোলা যায় এবং কৃষকরা একই জমিতে বছরে তিনটি ফসল ফলানোর সুযোগ পান। এটি জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে এবং কৃষকের বার্ষিক আয় বৃদ্ধি করে। সরিষা চাষে তুলনামূলকভাবে কম সেচ ও সারের প্রয়োজন হয়, যা উৎপাদন খরচ কম রাখে এবং পরিবেশের ওপর চাপ হ্রাস করে। এই স্বল্প ব্যয়ের চাষ পদ্ধতি একে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য অত্যন্ত লাভজনক করে তুলেছে। কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে, সরিষা চাষের ফলে জমির উর্বরতাও বাড়ে, কারণ এর পাতা দ্রুত পচে গিয়ে মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করে, যা পরবর্তী ধান ফসলের জন্য উপকারী। এটি একটি টেকসই কৃষি পদ্ধতির উদাহরণ, যা পরিবেশবান্ধব চাষাবাদে উৎসাহ যোগায়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি আমাদের দেশের অর্থনীতিকে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো বৈশ্বিক অস্থিরতা সরবরাহ শৃঙ্খলকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করেছে, যার ফলস্বরূপ দেশীয় বাজারেও তেলের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। এই পরিস্থিতি দেশের নীতিনির্ধারক ও কৃষি বিজ্ঞানীদের বাধ্য করেছে স্থানীয়ভাবে তেলবীজ উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করতে। আর এই প্রচেষ্টার কেন্দ্রে রয়েছে সরিষা। দেশের চাহিদা মেটাতে ভোজ্যতেলের সিংহভাগ আমদানি করা হলেও, যদি সরিষা উৎপাদনকে একটি শক্তিশালী জাতীয় আন্দোলনে রূপ দেওয়া যায়, তবে এই আমদানিনির্ভরতা দ্রুত কমানো সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের মোট আবাদযোগ্য জমির একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে পরিকল্পিতভাবে সরিষা চাষের আওতায় আনতে পারলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ভোজ্যতেলের দেশীয় চাহিদা ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত মেটানো সম্ভব। এই লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বিত উদ্যোগ।

সরকার এবং কৃষি বিভাগ এরই মধ্যে সরিষা চাষের সম্প্রসারণে বেশ কিছু যুগান্তকারী উদ্যোগ নিয়েছে। উচ্চফলনশীল জাতের সরিষা বীজ, বিশেষত বারি-১৪, বারি-৯ এবং বিনা-৪-এর মতো জাতগুলোর উদ্ভাবন ও মাঠ পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই নতুন জাতগুলো প্রচলিত দেশি জাতের চেয়ে অনেক বেশি তেল দেয় এবং ফলনও বেশি হয়। এর ফলে অল্প জমিতেও কৃষকরা অধিক লাভের মুখ দেখছেন। এই উচ্চ ফলনশীল জাতগুলো রবি মৌসুমের বিরতিকে কাজে লাগিয়ে বোরো ধানের ক্ষতি না করেই সফলভাবে চাষ করা যায়। কৃষকদের মধ্যে উন্নত জাতের বীজ বিতরণ, বিনামূল্যে সার ও প্রয়োজনীয় কৃষি সরঞ্জাম সরবরাহ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে সরিষা চাষে উৎসাহিত করা হচ্ছে। কৃষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদে উৎসাহিত করা হচ্ছে, যাতে প্রতি হেক্টরে ফলন আরও বাড়ানো যায়।

তবে সরিষা চাষের বিপ্লবকে সফল করতে হলে শুধু উৎপাদন বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়; এর সাথে সম্পর্কিত শিল্পগুলোকেও শক্তিশালী করতে হবে। তেল নিষ্কাশন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থাকে আরও আধুনিক এবং বিকেন্দ্রীভূত করা জরুরি। গ্রামাঞ্চলে ছোট ছোট তেল কল বা মিল স্থাপন করা যেতে পারে, যাতে কৃষকরা ন্যায্যমূল্যে নিজেদের উৎপাদিত সরিষা সরাসরি বিক্রি করতে পারে অথবা নিজেরাই তেল তৈরি করে স্থানীয় বাজারে সরবরাহ করতে পারে। এতে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমবে এবং কৃষকরা তাদের ফসলের সঠিক মূল্য পাবেন। একই সাথে, সরিষা থেকে তেল বের করার পর যে খৈল (উপজাত) অবশিষ্ট থাকে, তা পশু খাদ্য হিসেবে অত্যন্ত পুষ্টিকর। এই খৈলকে কেন্দ্র করে দুগ্ধ ও পশু পালন শিল্পেও নতুন সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, যা কৃষি অর্থনীতির বহুমুখীকরণে সহায়তা করবে। সরিষা তেলের স্বাস্থ্যগত দিকটিও গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহ্যবাহী সরিষার তেলে থাকা মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। তাই দেশীয় সরিষা তেলের উৎপাদন বাড়লে সাধারণ মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা উন্নত হবে, যা একটি সুস্থ জাতি গঠনের পূর্বশর্ত।

এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা অবশ্যম্ভাবী। এর মধ্যে অন্যতম হলো কৃষকদের ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা। অনেক সময় ফলনের ভরা মৌসুমে ব্যবসায়ীরা দাম কমিয়ে দিলে কৃষকরা আগ্রহ হারান। তাই সরকারকে একটি সুনির্দিষ্ট শস্য সংগ্রহ নীতি প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে সরিষার একটি ন্যূনতম সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা থাকবে। এছাড়া, সরিষা বীজের মান নিয়ন্ত্রণ, সংরক্ষণের জন্য আধুনিক হিমাগার স্থাপন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে গুণগত মান বজায় রাখার জন্য কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। কৃষকদের ঋণ সুবিধা ও বীমার আওতায় আনাটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে অপ্রত্যাশিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বাজার অস্থিরতা তাদের ক্ষতি করতে না পারে।

সর্বোপরি, সরিষা চাষকে শুধু একটি সাময়িক উদ্যোগ হিসেবে দেখলে চলবে না। এটিকে জাতীয় খাদ্য ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার একটি দীর্ঘমেয়াদী কৌশল হিসেবে দেখতে হবে। ভোজ্যতেলের আমদানি কমাতে পারলে দেশের কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে, যা অন্য গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন খাতে ব্যবহার করা যেতে পারে। সরিষার মাধ্যমে কৃষি খাতে বিপ্লবের সম্ভাবনা কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি গ্রামীণ অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং প্রান্তিক কৃষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নেও ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। এক্ষেত্রে, সরকারি কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও উন্নত ও রোগ প্রতিরোধী সরিষা জাত উদ্ভাবনে মনোযোগ দিতে হবে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম হবে। বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলোকেও উন্নত বীজ উৎপাদনে উৎসাহিত করতে হবে এবং কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। সমন্বিত বাজারজাতকরণ কৌশল, শক্তিশালী বিপণন ব্যবস্থা এবং দেশীয় সরিষা তেলের গুণগত মান নিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি এই বিপ্লবের গতিকে আরও ত্বরান্বিত করবে।

সরিষার হলুদ রং যেমন শীতের মাঠে এক সতেজতা নিয়ে আসে, তেমনি এর সফল আবাদ দেশের অর্থনীতিতে এক নতুন আশার আলো নিয়ে আসতে পারে। সরকার, কৃষি বিজ্ঞানী, কৃষক এবং সংশ্লিষ্ট শিল্প উদ্যোক্তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ‘লাভজনক সরিষা’ হতে পারে বাংলাদেশের কৃষিখাতের এক নতুন পরিচয় এবং তেল আমদানিনির্ভরতা কমানোর এক নিশ্চিত পথ। এই বিপ্লব সফল হলে বাংলাদেশ শুধু স্বাবলম্বী হবে না, আঞ্চলিক কৃষি অর্থনীতিতেও এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। আমাদের প্রয়োজন সঠিক নীতি, নিবেদিত কর্মপ্রচেষ্টা এবং এই হলুদ বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক দৃঢ় সংকল্প। সরিষা চাষে মনোযোগ দেওয়া এখন শুধু কৃষকদের আয়ের প্রশ্ন নয়, বরং এটি জাতীয় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ভোজ্যতেলের আমদানিনির্ভরতা কমানোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। উচ্চফলনশীল জাতের সরিষা চাষ এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে ফলন পাওয়ার সুবিধা এটিকে কৃষকদের কাছে লাভজনক করে তুলেছে। সরিষার উৎপাদন বাড়লে একদিকে যেমন বহু মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে, তেমনি গ্রামীণ অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত হবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সরকারের নীতিগত সহায়তা, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে এই ‘হলুদ বিপ্লব’ সফল করা সম্ভব। সরিষার এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ দ্রুত স্বাবলম্বী হওয়ার পথে এগিয়ে যেতে পারে।

ওসমান গনি

সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত