প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫
সফলতা- শব্দটি যেন আলোকবৃত্তের মতো। বাইরে থেকে চকচক করে, ভেতরে থাকে অন্ধকারের বহু স্তর। সমাজ সাধারণতভাবে, প্রতিষ্ঠা পাওয়া মানেই সুখের পূর্ণতা; খ্যাতি, অর্থ, সম্মান- এসব যেন মানসিক শক্তির প্রতীক। কিন্তু সত্য হলো, সফল মানুষের ভেতরটায় থাকে নিঃশব্দ ঝড়, থাকে এমন চাপ যা দৃশ্যমান নয়, অথচ গভীরভাবে ক্ষয় করে মনকে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়েই দেখা যাচ্ছে- যেসব মানুষ নিজের ক্ষেত্রকে আলোকিত করেছেন, তারাই অনেক সময় একাকিত্ব, চাপ ও মানসিক ক্লান্তিতে ভুগে মারাত্মক সিদ্ধান্তের দিকে চলে যাচ্ছেন। এই বিরোধাভাসই আজকের সমাজকে নতুন প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে।
সফলতার সবচেয়ে বড় বিপদ হলো- এটি মানুষকে সবসময় ভালো থাকার এক অঘোষিত বাধ্যতায় ফেলে। তাদের হাসি হতে হবে উজ্জ্বল, কথায় হতে হবে আত্মবিশ্বাস, আর মানসিক যন্ত্রণাকে রাখতে হবে কঠোর মুখের আড়ালে। তারা যদি সামান্য দুর্বলতার কথাও প্রকাশ করেন, সমাজ ভাবে- ‘সফল মানুষ হলে এত কষ্ট কেন?’ এই ভুল ধারণাই তাদের আরও একাকী করে তোলে। ফলে আত্মার ব্যথা আর কাউকে বলা হয় না; চাপ জমতে থাকে, মনস্তাপ গভীর হয়।
এছাড়া সফল মানুষদের জীবনে তুলনার চাপও থাকে প্রবল। যারা সবসময় সামনে থাকে, তারা অনুভব করেন- এক ধাপ পিছিয়ে পড়লেই তারা হয়তো আর গ্রহণযোগ্য হবে না। জনপ্রিয়তা, আয়ের স্থিতি বা সামাজিক অবস্থান- সবকিছুই একধরনের প্রতিযোগিতার মানদ-ে বাঁধা। এই অব্যাহত প্রতিযোগিতা মানুষের মনে জন্ম দেয় ভয়, অনিশ্চয়তা এবং আত্মসন্দেহ- যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রূপ নেয় মানসিক অবসাদে। আরও একটি বড় কারণ হলো- সফল মানুষের চারপাশে মানুষ থাকে অনেক, কিন্তু ঘনিষ্ঠভাবে মন খুলে বলার সুযোগ থাকে খুব কম। সবাই তাদের কাছ থেকে আশা করে শক্তি, আশা করে নেতৃত্ব; কিন্তু তাদের ভেতরের দুর্বলতা বোঝার মতো মানুষ থাকে না বললেই চলে। বাইরে করতালি, ভেতরে শূন্যতা- এই বৈপরীত্যই সবচেয়ে বিপজ্জনক।
আত্মহত্যার প্রবণতা কোনো দুর্বলতা নয়; এটি মানসিক যন্ত্রণার চূড়ান্ত রূপ, যেখানে মানুষ আশাহীনতার অন্ধকারে আটকে যায়। তাই সফল মানুষদেরও প্রয়োজন সহানুভূতি, সংলাপ, মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সহজপ্রাপ্যতা এবং এমন এক পরিবেশ যেখানে তারা নিজেদের দুর্বলতাকে স্বীকার করতে লজ্জা না পান। কারণ মানুষ যতো উঁচুতেই উঠুক, তার মনও ততোই গভীর যত্ন দাবি করে। বিশ্বজুড়ে আত্মহত্যা আজ এক গভীর নীরব মহামারির রূপ নিয়েছে। প্রতি বছর প্রায় সাত থেকে সাড়ে সাত লাখ মানুষ নিজের জীবন শেষ করে, অর্থাৎ গড়ে প্রতি চল্লিশ সেকেন্ডে একজন মানুষ পৃথিবীকে বিদায় জানায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব বলছে, ২০২১ সালে বৈশ্বিক আত্মহত্যার হার ছিল প্রতি এক লাখে গড়ে ৯ জন। গত তিন দশকে মোট হার কিছুটা কমলেও সামাজিক চাপ, মানসিক অবসাদ, একাকিত্ব এবং মানসিক স্বাস্থ্যের অবহেলা এখনও মৃত্যুর এই পথকে ভয়াবহভাবে ত্বরান্বিত করছে।
বাংলাদেশও এই বৈশ্বিক প্রবণতা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। ২০১৯ সালের তথ্যে দেখা যায়, দেশে আত্মহত্যা হার ছিল প্রতি এক লাখে প্রায় ৩.৭ জন। কিন্তু বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে হার কম হলেও আসল সংখ্যা অনেক বেশি। বিভিন্ন প্রতিবেদন বলছে, দেশে প্রতিবছর দশ থেকে চৌদ্দ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। উদ্বেগের বিষয় হলো- শিক্ষার্থী ও তরুণদের ভেতর আত্মহত্যার প্রবণতা দ্রুত বাড়ছে; ২০২৪ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু এক বছরেই অন্তত তিন শতাধিক শিক্ষার্থী এই পথ বেছে নিয়েছে। এই পরিসংখ্যান কেবল সংখ্যার বিবরণ নয়- বরং এক গভীর মানসিক, সামাজিক এবং পারিবারিক সংকটের ছবি। উন্নয়ন যতই বাড়ুক, মানুষের অন্তর্গত যন্ত্রণা, চাপ, ভয় এবং অসহায়ত্বের কারণে আত্মহত্যা আজও আমাদের সমাজের এক অমোচনীয় বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আত্মহত্যা কখনই আকস্মিক কোনো সিদ্ধান্ত নয়; এটি দীর্ঘ সময় ধরে জমে থাকা যন্ত্রণা, চাপ ও অসহায়তার স্তরগুলোর শেষ পরিণতি।
সানিয়া তাসনিম লামিয়া
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ