ঢাকা সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বুদ্ধিজীবীদের অবদান ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ অধ্যায়

নাজিয়াত আক্তার
বুদ্ধিজীবীদের অবদান ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ অধ্যায়

১৪ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক বেদনাবিধুর ও গভীর শোকের দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর আলবদর-রাজাকার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ মেধাবী সন্তানদের তুলে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। যারা ছিলেন জাতির জাগরণের অগ্রদূত, স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখানো সৃষ্টিশীল মস্তিষ্ক, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের পথপ্রদর্শক- সেই শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, লেখক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মীরাই প্রধান টার্গেট হন। উদ্দেশ্য ছিল যে জাতিকে মেধাশূন্য করে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে অচল করে দেওয়া। তাই ১৪ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগকে এবং তাদের স্মৃতির প্রতি জানায় গভীর সম্মান।

জাতির চেতনার স্থপতি বুদ্ধিজীবীরা : বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা কেবল জ্ঞানচর্চায় সীমাবদ্ধ ছিলেন না; তারা ছিলেন সমাজ-সংস্কৃতির আলোকবর্তিকা। ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে তারা ছিলেন প্রতিবাদের পথিকৃৎ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন ও ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল অগ্রণী। তাদের কলম, বচন ও লেখনী জাগিয়ে তুলেছিল জাতির আত্মপরিচয়, নিজের ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা।

শিক্ষকরা ছাত্রসমাজকে প্রস্তুত করেছিলেন ন্যায়ের পথে দাঁড়ানোর জন্য। সাংবাদিকরা সত্য তুলে ধরে মানুষকে সচেতন করেছিলেন। সাহিত্যিক ও শিল্পীরা স্বাধীনতার গান গেয়ে, নাটক লিখে, কবিতা পড়ে মানুষের মনে দেশপ্রেমের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। ডাক্তার ও বিজ্ঞানীরা যুদ্ধাহতদের সেবা দিয়ে, চিকিৎসা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অমূল্য অবদান রাখেন। তাই বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন জাতির মেরুদণ্ডস্বরূপ।

পাকিস্তান বাহিনী বুঝতে পেরেছিল যে যুদ্ধের মাঠে পরাজয় অনিবার্য। তারা জানত- একটি জাতিকে চিরতরে দুর্বল করতে হলে তার মেধাশক্তিকে ধ্বংস করতে হবে। তাই ডিসেম্বরের শেষদিকে বিজয়ের ঠিক আগে তারা পরিকল্পিতভাবে বাছাই করে তুলে নিয়ে যায় দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের। ঢাকার রায়েরবাজার, মিরপুর, নাখালপাড়া, মহাখালীসহ বিভিন্ন স্থানে তাদের চোখ বেঁধে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শহিদ হয়েছেন ড. আলীম চৌধুরী, ড. ফজলে রাব্বী, সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, নাট্যকার জহির রায়হান, শিক্ষক জোতির্ময় গুহঠাকুরতা, গণিতজ্ঞ আনোয়ার পাশার মতো অসংখ্য ক্ষণজন্মা বুদ্ধিজীবী। তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি। তাদের হারানোর বেদনা আজও জাতিকে কাঁদায়।

জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান

বুদ্ধিজীবীরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান- এই কথার পেছনে রয়েছে অগাধ সত্য। কারণ তারা ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতির কল্যাণে কাজ করেছেন। জ্ঞান, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও মানবিক মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিয়েছেন সমাজে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস দেখিয়েছেন। তারা জানতেন শত্রুরা টার্গেট করবে, তারপরও দেশপ্রেমের কারণে পিছিয়ে যাননি। একটি জাতির অগ্রগতিনির্ভর করে তার বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তির ওপর। তারা ছিলেন সেই অগ্রগতির চালিকা। স্বাধীনতার চেতনা, মুক্তচিন্তা ও আত্মমর্যাদার বোধ তারা মানুষের মনে জাগিয়ে তুলেছিলেন। ডাক্তাররা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিয়েছেন, সাংবাদিকরা সত্য তুলে ধরেছেন- যা এক বিশাল মানবিক দৃষ্টান্ত। তাই তারা শুধু শহীদ নন, তারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, যাদের রক্তে রচিত হয়েছে স্বাধীনতার ভিত্তি।

১৪ ডিসেম্বর শুধু শোকের দিন নয়; এটি আত্মমর্যাদা, কৃতজ্ঞতা এবং প্রতিজ্ঞার দিনও। এই দিনে আমরা উপলব্ধি করি মেধার মূল্য কতটা। আমরা চিন্তা করি- যে জাতি তার বুদ্ধিজীবীদের সম্মান করে, সেই জাতি এগিয়ে যায়। নতুন প্রজন্মকে ইতিহাস জানিয়ে তাদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগানোই আজকের প্রধান উদ্দেশ্য।

নাজিয়াত আক্তার

ফিচার, কলাম অ্যান্ড কনটেন্ট রাইটার্স

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত