প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫
বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের নৌসীমায় ভারতীয় জেলেদের অনুপ্রবেশ, মাছ চুরি ও দস্যুতা বেড়েই চলেছে। বছরের পর বছর ধরে এ ধারা অব্যাহতভাবে চলছে। বিগত সরকারের সময় ভারতের সঙ্গে বিশেষ বশ্যতামূলক সম্পর্কের কারণে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বিএসএফ যেভাবে গুলি করে সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যা করত; একইভাবে সমুদ্রসীমায়ও ভারতীয় কোস্ট গার্ডের পাহারায় সে দেশের জেলেরা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে বেপরোয়া মাছ চুরি, দস্যুতা, ট্রলারসহ জেলেদের অপহরণ এবং নাশকতার ঘটনা ঘটাতো, যা উদ্বেগজনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল। সে সময় বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের হাতে শত শত ভারতীয় জেলে ধরা পড়লেও উপরের নির্দেশে এবং আইনের ফাক-ফোঁকড়ে তারা সহজেই ছাড়া পেয়ে যাওয়ার কারণে তাদের বেপরোয়া তৎপরতা কখনও বন্ধ হয়নি। জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তিতে ভারতের সঙ্গে সমতাভিত্তিক সম্পর্কের বার্তা দিলেও সমুদ্রসীমা ও সমুদ্রসম্পদ সুরক্ষায় তাদের তেমন কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যায়নি। সরকারের সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টারা সেন্টমার্টিন দ্বীপের পরিবেশ ও কোরাল রক্ষায় যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করলেও দেশের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র সম্পদ আহরণ, মৎস্য সম্পদ ও জেলেদের সুরক্ষায় তাদের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। গতকাল প্রতিনিধির পাঠানো এক প্রতিবেদনে বঙ্গোবসাগর এবং সুন্দরবন এলাকায় ভারতীয় জেলেদের অনুপ্রবেশ, অপতৎপরতা ও দস্যুতার যে বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে, তা খুবই উদ্বেগ ও হতাশাজনক। সমুদ্রসীমার নিরাপত্তা দেশের সার্বভৌমত্ব, হাজার হাজার জেলে পরিবারের নিরাপত্তা, খাদ্য, পুষ্টি ও জ্বালানি নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত।
দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমুদ্রসীমা ইস্যু বিগত সরকারের আমলে আন্তর্জার্তিক আদালতের মাধ্যমে নিরসন হওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে বিশাল জয়ের উৎসব ও প্রচারণা চালানো হয়, যদিও সেই রায় কতটা আমাদের পক্ষে-বিপক্ষে গেছে, তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। সমুদ্রসীমা বিজয়ের পর ব্লু-ইকোনমি তথা সমুদ্র সম্পদ আহরণের মধ্য দিয়ে বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথা বিশাল আড়ম্বরে প্রচার করা হলেও একযুগেও সমুদ্রের তেল-গ্যাস আহরণে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেনি পতিত সরকার। উপরন্তু সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ার পরও বাংলাদেশের নৌসীমায় ভারতীয় জেলেদের অনুপ্রবেশ, মাছ চুরি ও দস্যুতা আগের চেয়েও বেড়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশি জেলেদের ট্রলারসহ অপহরণ, মাছ লুটে নেয়া, জেলেদের মেরে সাগরে ফেলে দেয়ার ঘটনার কারণে জেলেদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি হয় এবং অনেক জেলে পরিবার সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া ছেড়ে দেয়ার খবরও প্রকাশিত হয়। অন্যদিকে ভারত ও মিয়ানমারের জেলেরা সাগরে অবাধে মাছ ধরার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের তেল-গ্যাস ব্লকগুলো ইজারা দিয়ে এক দশক আগে থেকেই গ্যাস উত্তোলন করছে। দেশের স্থলভাগের গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মজুদ দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। সমুদ্রের সম্ভাব্য গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে জ্বালানি উত্তোলনের মাধ্যমে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা, বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এক নতুন উচ্চতায় উড্ডীন হবে, এমনটাই ছিল প্রত্যাশিত। মূলত ভারতীয় আধিপত্যবাদী রাজনীতির এজেন্ডায় পতিত সরকার দেশের সমুদ্র সম্পদসহ প্রতিটি অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় খাতকে অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকার বিগত সরকারের সে ধারা থেকে বের হয়ে সমুদ্রসম্পদ আহরণ ও রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। এটা নিছক, গতানুগতিক ব্যর্থতা নয়, দেশের অভ্যন্তরে ভারতীয়দের অনুপ্রবেশ ও সম্পদ লুণ্ঠন জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
ভারতীয় জেলে এবং নৌদস্যুরা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করছে। উপরন্তু ভারতীয় কোস্ট গার্ড বাংলাদেশের জেলেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় জেলেরা উন্নততর প্রযুক্তি ও উচ্চ হর্সপাওয়ারের ফিশিং ট্রলার, ফিশ ডিটেকটর ও জিপিএস সুবিধা ব্যবহার করে একসঙ্গে বহুসংখ্যক ট্রলার নিয়ে বাংলাদেশের নৌসীমার অনেক ভেতরে প্রবেশ করে মাছ ধরে নিয়ে যাওয়ার কারণে দেশীয় জেলেরা সেখানে যেতে ভয় পায়। দেশের মৎস্য সম্পদের বিশাল সম্ভাবনার উপর ভারতীয় জেলেদের অপতৎপরতা বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। ফিশ ডিটেক্টর, কারেন্টজাল, ফাঁসের জাল ব্যবহার করে সুন্দরবন উপকূলের মৎস্যভাণ্ডারে হানা দিয়ে রেণুপোনাসহ ছোটবড় মাছ ধরে বাংলাদেশের এলাকাকে পরিকল্পিতভাবে মৎস্যশূন্য করে তোলা হচ্ছে।
ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে যে সময়ে সাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে, সে সময়ে ভারতীয় জেলেরা দলবেঁধে এসে জাটকা, মা ইলিশসহ সব মাছ ছেকে তুলে নিয়ে যায়। এর ফলে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা আমাদের তেমন কোনো কাজে আসছে না বলে সংশ্লিষ্ট জেলেরা মনে করছেন। আমাদের নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ড গভীর সমুদ্রে টহল দিলেও জেলে ও মৎস্যসম্পদের নিরাপত্তায় তাদের নজরদারি বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। অনুপ্রবেশকারী জেলেদের আটকের পর আইনি মারপ্যাঁচে ছাড়া পেয়ে তারা আবারও একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। কোস্ট গার্ডের টহল বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশি জেলেদের উন্নততর ট্রলার, ফিশিংবোটসহ আধুনিক প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। সমুদ্র সম্পদের বিশাল সম্ভাবনা কাজে লাগাতে অনতিবিলম্বে সাগরে সীমান্ত এলাকার গ্যাস ব্লকগুলোর ত্রিমাত্রিক জরিপ, ম্যাপিং ও ইজারা সম্পন্ন করে জ্বালানি সম্পদ আহরণ শুরু করতে হবে। বিদেশি কোম্পানির পাশাপাশি অফ-শোরে দেশীয় কোম্পানি বাপেক্সকে আরও শক্তিশালী করে দেশীয় জ্বালানি সম্পদ আহরণ নিশ্চিত করতে হবে।