প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৫
পরিবেশ দূষণ, বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, শব্দ দূষণ, খাদ্যে ভেজাল কিংবা মাপে কমবেশি অর্থাৎ সমাজের নানা দূষণ নিয়ে বিস্তর কর্মযজ্ঞ বা গবেষণা হলেও মানুষের মনের দূষণ নিয়ে অতটা মাতামাতি হয় না বললেই চলে। মানুষের শরীর ও মন- দুটো ভালো থাকলেই মানুষ ভালো থাকে। তবে, এক্ষেত্রে শরীরের চেয়ে মনের গুরুত্ব বেশি। কেননা, মনের ভালো থাকার উপরই নির্ভর করে শরীরের ভালো থাকা। চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, শরীরের ৭৫ ভাগ রোগের কারণ আসলে মনের দূষণ। যে কারণে এ রোগগুলোকে বলা হয়, মনোদৈহিক রোগ। মন ঠিকঠাক থাকলে শরীর ঠিক হতে সময় লাগে না।
মন কেন ও কীভাবে দূষিত হয়-
সাধারণত কিছু নেতিবাচক আবেগের কারণে মানুষের মন দূষিত হয়। দুঃখ, হতাশা, গ্লানি থেকে শুরু করে যত নেতিবাচক আবেগ আছে, যেমন- রাগ-ক্ষোভ, ঈর্ষা-হিংসা, শঙ্কা, ভয়, নেতিচিন্তা মনকে যখন আচ্ছন্ন করে ফেলে, তখনই মানসিক দূষণের সৃষ্টি হয়। মানুষের মনের দূষণ দূর হলে সমাজের অন্যান্য দূষণও কিন্তু এমনিতেই দূর হয়ে যায়। তাই, সব ধরনের দূষণ থেকে মনকে মুক্ত করতে হবে।
মনের দূষণমুক্তির পথ কী-
মনের ভেতরের দূষণমুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে, নিজের ভেতরে ডুব দেওয়া। মনের জগতে আত্মনিমগ্ন হওয়া বা ধ্যানস্থ হওয়া। ধ্যান বা তাফাক্কুর তথা মোরাকাবা বা মেডিটেশন চর্চার মাধ্যমে বহু মানুষ মনকে দূষণমুক্ত করতে পেরেছেন। তাই, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞরাই এখন পরামর্শ দিচ্ছেন- ধ্যান, মোরাকাবা বা মেডিটেশনের।
আসলে, ধ্যান মোরাকাবা বা মেডিটেশন এখন সাধারণ বা ধর্মপ্রাণ সব মানুষের আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যিনি মেডিটেশন করেন, তিনি এখন মানুষের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। অন্যের কাছে তিনি বেশি আস্থাভাজন। তিনি কারও ক্ষতির কারণ হন না, কাউকে শারীরিক বা মানসিকভাবে আঘাত করেন না। বরং, মানুষের উপকারে নিজের অর্থ, সময় ও শ্রম ব্যয় করতে সবসময় অগ্রগামী হওয়ার চেষ্টা করেন। কারণ, তার মধ্যে শুকরিয়া রয়েছে, সুখ রয়েছে, তার মনে আনন্দ রয়েছে, প্রশান্তি রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, এগুলো নবী রাসূল মহামানবগণেরই চরিত্র। এই শুদ্ধাচার, সদাচরণ ও উত্তম চরিত্র যাদের আছে, তারাই পৃথিবীতে উত্তম মানুষ, প্রশান্ত ও সুখী মানুষ।
বৈজ্ঞানিক প্রমাণ-
এটি এখন শুধু কথার কথা নয়, গবেষণাগারেও এখন এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। ম্যাথু রিকার্ড একসময় কাজ করেছেন অণুজীব বিজ্ঞানী হিসেবে। তিনি একাধারে লেখক আলোকচিত্রী গবেষক অনুবাদক ও একজন ধর্মপ্রাণ ভিক্ষু। তার নামের পাশে যুক্ত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম সুখী মানুষের উপাধি। রীতিমতো বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এটি প্রমাণিত। ২০০৪ সালে একাধিক ল্যাবরেটরি টেস্ট ও কয়েক ধাপবিশিষ্ট গবেষণায় প্রমাণিত হয়, তার মধ্যে রয়েছে আনন্দপূর্ণ জীবনের এক অভাবনীয় ক্ষমতা। গবেষণাকালে বিজ্ঞানীরা তার পুরো মাথাটাকে মুড়ে ফেলেছিলেন ২৫৬টি ইলেকট্রোড দিয়ে।
সীমাহীন উৎসাহ নিয়ে তারা রিকার্ডের ব্রেনের ওপর মেডিটেশনের প্রভাব অনুসন্ধান, গবেষণা ও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিজ্ঞানীদের সামনে যে জিনিসটি উন্মোচিত হয়েছে, সেটি এককথায় চমকপ্রদ। রিকার্ড এবং অন্যান্য ধ্যানমগ্ন ভিক্ষুর ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, তাদের ব্রেনের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স অত্যন্ত সুতীক্ষè। মানুষের তৃপ্তি, সুখ আর আনন্দের মতো ইতিবাচক আবেগগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় ব্রেনের এ অংশটি থেকেই। ৩৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে মেডিটেশন চর্চা করা ম্যাথু রিকার্ড তাই মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে।
তার ভাষায়, মেডিটেশন স্থায়ী ও অনন্ত সুখের মূল উপাদান।’ A Guide to Developing LifeÕs Most Important Skill বইতে সুখের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে রিকার্ড লিখেছেন- ‘সুস্থ সুন্দর মন থেকে উৎসারিত এক গভীর অনুভূতিই হলো সুখ।’ রিকার্ডের ঠোঁটের কোণে একটা ছোট্ট হাসি যেন লেগেই থাকে। তিনি বলেন- ‘এর কারণ একটাই, দৈনন্দিন জীবনে নিয়মিত মেডিটেশন চর্চা।’
চিকিৎসকরা এখন মেডিটেশনকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেন। আমেরিকার অধিকাংশ ডাক্তার রোগ প্রতিরোধ, রোগের প্রকোপ কমিয়ে আনা বা রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্যে মেডিটেশনকে সহায়ক ভাবছেন। বিশেষ করে, দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা উপশম, হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ, উচ্চরক্তচাপ কমিয়ে আনা, চর্মরোগ, ক্যান্সার কিংবা বন্ধ্যাত্ব মোকাবিলায় মেডিটেশনের সহযোগিতা নিচ্ছেন। সারা পৃথিবীতে এখন মনোদৈহিক রোগের পরিমাণ বেড়েছে। যে কারণে, মনোরোগীদের সংখ্যাও বেশি। হতাশা, অমনোযোগ, অস্থিরতা, অস্বাভাবিক আচরণ, উগ্রতা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা, এসব মানসিক সমস্যা নিয়ে অনেক রোগী ডাক্তারের কাছে আসেন। ভালো বিশেষজ্ঞরা তাদের সুস্থতার জন্যে এখন মেডিটেশনকেই সফল বিকল্প ঔষুধ হিসেবে মনে করছেন এবং ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন।
আমাদের দেশেও সাধারণের মধ্যে মেডিটেশন চর্চা এখন বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে, কোয়ান্টাম মেথড মেডিটেশন চর্চা করছেন আমাদের দেশে হাজারও মানুষ দীর্ঘ প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর ধরে। এর প্রবক্তা বাংলাদেশেরই শহীদ আল বোখারী মহাজাতক। আনন্দের কথা হচ্ছে, প্রয়োজনীয় মেডিটেশনগুলোও এখন বাংলা ভাষায় সহজলভ্য। অডিও হিসেবে মনের দুঃখ দূর করতে আনন্দের মেডিটেশনসহ মনের দূষণমুক্তি, আত্ম পর্যালোচনা ও শুকরিয়ার মেডিটেশন কিংবা ভয়, নেতিচিন্তা দূর করতে এবং রাগ-ক্ষোভমুক্ত থাকার জন্যেও আলাদা মেডিটেশন রয়েছে। অর্থাৎ যার যখন যেটি প্রয়োজন, সেভাবে জীবনের সব জরুরি প্রসঙ্গে মেডিটেশন করার সুযোগ রয়েছে।
নিয়মিত প্রয়োজন অনুযায়ী বিষয়ভিত্তিক মেডিটেশন চর্চা করলে দেখা যায়, ধীরে ধীরে মনটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। মনের দূষণ কমে আসছে। নিয়মিত চর্চায় এমন একটা সময় আসে, যখন মনের নেতিবাচক অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে যায়। মনটা শক্তিশালী হয়ে উঠে ইতিবাচক শক্তিতে। ভরে উঠে আনন্দের প্লাবনে। তিব্বতীয় ধর্মগুরু দালাইলামা এবং এক দল স্নায়ুবিজ্ঞানীর কথোপকথন নিয়ে ‘ডিসট্রাকটিভ ইমোশনস’ নামক বইতে ডানিয়েল গোলম্যান বলেন- ‘গত ত্রিশ বছরে মেডিটেশন নিয়ে গবেষণায় এখন এটা স্বীকৃত যে, টেনশন বা স্ট্রেস উপশমে মেডিটেশন একটি প্রতিষেধক।’ নতুন গবেষণায় আধুনিক ইমেজিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছেন, মেডিটেশন মনকে নিয়ন্ত্রণ এবং মস্তিষ্কের কর্মকাঠামো পরিবর্তন করতে পারে।
আসলে, সহজ করে বললে, মন হচ্ছে সফটওয়্যার আর ব্রেন হচ্ছে হার্ডওয়্যার। হার্ডওয়্যার ঠিক থাকলেও একে সুন্দরভাবে পরিচালিত করার জন্যে দরকার নির্ভুল সফটওয়্যার। ব্রেনকে বেশি পরিমাণে ব্যবহার করে সাফল্য, প্রাচুর্য আর প্রশান্তি সৃষ্টির জন্যে মনকে ভালো রাখতে হবে। কারণ, মানুষের জীবনে যত সমস্যা এসেছে, মস্তিষ্ককে ব্যবহার করে সে তার সমাধান করেছে। যিনি মাথাটাকে ঠান্ডা রাখতে পারেন; তিনি যেকোনো সমস্যাকে সম্ভাবনায় রূপান্তরিত করতে পারেন। আর, মেডিটেশন মাথাটাকে ঠান্ডা রেখে, মনটাকে প্রশান্ত রেখে, মস্তিষ্ককে বেশি পরিমাণে ব্যবহার করারই পথ করে দেয়। সৌভাগ্য, সাফল্য, প্রশান্তি ও প্রাচুর্য তখন ঘিরে থাকে মানুষকে। এজন্যেই বলা হয়, মন ভালো তো সব ভালো। মূলত, রাগ ক্রোধ ক্ষোভ মনে এলে, আমরা বুদ্ধির সবচেয়ে সংকুচিত অবস্থানে চলে যাই। অথচ, রাগ করা, ভয় পাওয়া কোনো কিছুর সমাধান নয়। ঠিক একইভাবে সব ধরনের নেতিবাচক চিন্তা মনের সামর্থ্য ও সম্ভাবনাকে অনেকখানি কোণঠাসা করে ফেলে। অর্থাৎ মনের সুচিন্তা বা কুচিন্তা বাস্তবতাকে ভীষণ প্রভাবিত করে। মনকে, শরীরকে দূষিত করে।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ‘জেনে রাখ, শরীরের মধ্যে একটি মাংসের টুকরা আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন ঠিক হয়ে যায়। আর, তা যখন খারাপ হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখ, সে মাংসের টুকরোটি হলো- ক্বলব বা মন।’ (সহীহ বোখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাম্বার : ৫০, আন্তর্জাতিক নাম্বার : ৫২)।
তাই, মনকে দূষণমুক্ত রাখতে আমাদের সচেষ্ট হতে হবে সবচেয়ে বেশি। মন ও শরীরকে দূষণমুক্ত ও সুস্থ রাখতে এজন্যেই প্রয়োজন আত্মনিমগ্নতা, এজন্যেই প্রয়োজন ধ্যান, মোরাকাবা বা মেডিটেশন। মেডিটেশনের মাধ্যমে ভালো ভাবনা ভাবতে ভাবতেই সূচিত হোক আমাদের মনের দূষণমুক্তির প্রথম পদক্ষেপ। মেডিটেশন ধ্যান বা মোরাকাবার মাধ্যমে শোকরিয়া করতে করতে আমাদের হৃদয়-মন ভরে উঠুক সুশীতল প্রশান্তির পবিত্র সুখ ও আনন্দে। সবাইকে বিশ্ব মেডিটেশন দিবসের শুভেচ্ছা।