প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৫
রাজনীতি মূলত সম্পূর্ণরূপে একটি নীতিনির্ভর প্রক্রিয়া। এর কেন্দ্রে অবস্থান করে জনগণের কল্যাণ ও দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা- ক্ষমতা অর্জনের উন্মুত্ত প্রতিযোগিতায় নীতি ক্রমেই হারাতে বসেছে। যেটি সুস্থ রাজনীতি চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করছে। আজকে দেশের তরুণ সমাজ এমন নোংরা পরিবেশ থেকে দূরে থাকতে রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়ছে। স্বাধীনতার পর থেকে এই প্রবণতা লক্ষ্য করা গেলেও, সাম্প্রতিক সময়ে তা আরও প্রকট হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের আদর্শের জায়গাটি নষ্ট করে কাদা ছোড়াছুড়িতে লিপ্ত হচ্ছে। যেটি দেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠছে- ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা ক্ষমতায় থাকা। ফলে জনগণের স্বার্থ অনেক ক্ষেত্রেই গৌণ হয়ে পড়ছে। তাদের ইশতেহারে জনগণের স্বার্থকে মুখ্য করে দেখালেও বাস্তবে কোনো মিল নেই। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটছে। যা তাদের রাজনৈতিক ভিত্তিকে নষ্ট করে দিচ্ছে। যেখানে নৈতিকতা লোপ পায়, সেখানে রাষ্ট্রের কল্যাণ তো কথার কথা। সহনশীলতার অভাবই বলে দেয় তারা নীতিহীন প্রতিযোগিতায় মত্ত।
সোশ্যাল মিডিয়ায় একে অপরের প্রতি আক্রমণাত্মক কথা ছোড়া যেন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হচ্ছে। মতের বাইরে গেলে সেটা শত্রুতায় রূপান্তরিত হচ্ছে। নীতিনির্ভর সমালোচনার জায়গাটি ব্যক্তিগত আক্রমণ আর প্রতিহিংসায় পূর্ণ হচ্ছে। সমাজে রাজনীতি পরিণত হচ্ছে বিভাজনের হাতিয়ার রূপে। গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখব পরিবারে আপন ভাইয়ের মধ্যে সমঝোতার সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। রাজনীতি নীতিহীন প্রতিযোগিতায় পর্যবসিত হওয়ার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয় স্বার্থে কাজ করছে। যা দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে কলঙ্কিত করছে। গত ১৬ বছর আওয়ামী সরকারের আমলে আমরা দেখেছি- পুলিশ, প্রশাসন, এমপি, মন্ত্রী, সচিব কিংবা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সবাই হাসিনা সরকারের প্রভাবের আওতায় চলে এসেছিল। ফলে সম্পূর্ণরূপে গণতন্ত্র তার ভারসাম্য হারিয়েছিল। দীর্ঘ ১৬ বছর তাদের ইচ্ছামতো দেশ পরিচালনা করায় জনগণ ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। আজকে রাজনীতিতে নীতিহীনতার কারণে জনগণ রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়ছে।
সাধারণ মানুষ রাজনীতি মানে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, স্বার্থান্বেষী ও দলাদলি মনে করে থাকে। অথচ গণতন্ত্রের প্রাণই হলো নাগরিক সমাজ। দলগুলোর ভেতর গণতান্ত্রিক চর্চা নেই বললেই চলে। বিধায় আজকে গোটা দেশে গণতন্ত্র চর্চা ক্রমশ লোপ পাচ্ছে। রাজনীতি স্বাভাবিক ভাবেই নীতিহীন হয়ে পড়ছে। কারণ নেতৃত্ব, নির্বাচন ও মত প্রকাশ সবকিছু কেন্দ্রীভূত ও একমুখী। আমাদের দেশে রাজনৈতিক সংকট দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার পেছনে আরও একটি কারণ হলো দলের মধ্যে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নেই। এর প্রভাব গোটা দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সমাজের উপর পড়ছে। পুনর্জাগরনের মাধ্যমে এসকল সংকট থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব। আমরা গত বছর জুলাই আন্দোলন দেখেছি। আসলে এটা সম্ভব হয় রাজনৈতিক সদিচ্ছার জন্য। আমরা যদি ক্ষমতার বাইরে দাঁড়িয়ে নীতির পক্ষে অবস্থান নিতে পারি, তবেই রাজনীতিতে নীতিনির্ভর মানসিকতা গড়ে তুলতে সক্ষম হবো। আমাদের সমাজ যদি দায়িত্বশীল হয় তাহলে প্রতিনিয়ত নীতিহীন আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ হবে। যেটি রাজনীতিতে নীতি-নৈতিকতা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় রাজনৈতিক নীতি শিক্ষার চরম অভাব রয়েছে। ফলে একটি নাগরিক ছাত্র অবস্থা থেকেই রাজনীতিতে নৈতিকতা দেখাতে সক্ষম হন না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে লক্ষ্য করলে দেখব কিছু হীন মানসিকতা নিয়ে ছাত্র রাজনীতি চলে আসছে। তাই আমাদের খেয়াল রাখা উচিত ছাত্র-রাজনীতি যেন নীতিহীন প্রতিযোগিতার ময়দানে পরিণত না হয়।
ছাত্র-ছাত্রীরা দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তারা যদি নীতিহীন রাজনীতি চর্চায় অভ্যস্ত হয় তাহলে এর ফল গোটা জাতিকে ভোগ করা লাগবে। স্বাধীনতার পর থেকে অনেক দল ক্ষমতায় আসলেও, খুব কম দলই নীতি-নৈতিকতা নিয়ে রাজনীতি করেছেন। আমরা দিন দিন রাজনৈতিক দর্শনের মৌলিক ধারণা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। জনগণের স্বার্থে কাজ না করে ক্ষমতার অপব্যবহার করছি। দেশে আজকে দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ার কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- রাজনৈতিকভাবে নীতিহীন হয়ে পড়া। রাজনৈতিক দলগুলো নৈতিক সীমারেখা ভেঙে যা ইচ্ছা তাই করছে। রাজনীতি জাস্ট সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। যেটি দেশের উন্নয়নে সরাসরি প্রভাব ফেলছে। নীতিহীন প্রতিযোগিতায় পড়ে রাজনীতি নিজেকে দুর্বল করে ফেলে। রাজনীতি যখন নীতি আর আদর্শের কাছে পরাজিত হয়, তখন রাজনীতি অস্থিরতা ছাড়া কিছুই উপহার দিতে পারে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার এই সংকট দীর্ঘদিনের ফসল। এটি ব্যক্তিগত নয় বরং দলীয়ভাবে নীতিহীন হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় এখানে নীতিনির্ভর রাজনীতি ছাড়া টেকসই রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব নয়। নীতিনির্ভর রাজনীতি করতে হলে আমাদের বেশ কয়েকটি দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যেমন নিরপেক্ষ ভোট গ্রহণ, প্রাতিষ্ঠানিক নিরপেক্ষতা ও নাগরিকদের অংশগ্রহণ ইত্যাদি। রাজনীতিকে নীতিহীন গণ্ডি থেকে বের করে আনার দায়িত্ব কী শুধু রাজনৈতিক দলের? এটি আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব। নীতিকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরিয়ে সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরির পথে চলাই উত্তম।