ঢাকা সোমবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বইমেলা কি এখনও পাঠক তৈরি করে

আরশী আক্তার সানী
বইমেলা কি এখনও পাঠক তৈরি করে

বাংলাদেশে বইমেলা এমন একটি সাংস্কৃতিক ঘটনা, যা একদিকে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি বহন করে, অন্যদিকে জাতির পাঠাভ্যাস, মনন ও চিন্তাশীলতার ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে শুরু হওয়া ছোট্ট আয়োজনটি আজ দেশের সবচেয়ে বড় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উৎসবে রূপ নিয়েছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রা বদলেছে, প্রযুক্তির প্রভাব বেড়েছে, বিনোদনের ধরন পাল্টেছে, এমনকি পড়ার ধাঁচও পরিবর্তিত হয়েছে। এর মধ্যেই মূল প্রশ্নটি আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বইমেলা কি এখনও পাঠক তৈরি করে? নাকি বইমেলা এখন শুধুই ছবি তোলা, ঘোরা, আড্ডা আর উৎসবের নাম? এই প্রশ্নের উত্তর সরল নয়, কারণ পাঠক সৃষ্টি একদিনে হয় না; এটি একটি ধীরে ধীরে তৈরি হওয়া মানসিক ও সাংস্কৃতিক অভ্যাস, যার ভিত গড়ে ওঠে সমাজে, পরিবারে, বিদ্যালয়ে, পরিবেশে এবং ব্যক্তির অভিজ্ঞতার মধ্যে। বইমেলা এই পরিবেশের একটি অংশ, কিন্তু এর প্রভাব দৃশ্যমান হয় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। তাই উত্তর খুঁজতে হলে পুরো পাঠক সমাজের বিবর্তন, বইমেলার পরিবর্তন, প্রযুক্তির ঝড়, তরুণদের মনোযোগের পরিবর্তন, প্রকাশনা শিল্পের গতি, পাঠাগারের অস্তিত্ব, পরিবারিক সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক বাস্তবতা সবকিছুই মাথায় রাখতে হবে।

বর্তমানের তরুণ প্রজন্ম দিন কাটায় স্মার্টফোন, রিল, টিকটক, গেম, ইউটিউব শর্টস এবং দ্রুতগামী কনটেন্টে ডুবে থেকে। তারা তথ্য পায় দ্রুত, ছবি দেখে দ্রুত, কিন্তু গভীর পাঠে মনোযোগ দেওয়ার ধৈর্য ক্রমেই কমছে। অনেকেই বলে এখনকার ছেলেমেয়েরা তো বই-ই পড়ে না। কিন্তু গভীরে গেলে দেখা যায়, তারা পড়ে তবে পুরোনো প্রিন্ট বই নয়; তারা পড়ে অনলাইন আর্টিকেল, ব্লগ, পিডিএফ, ওয়েবস্টোরি, ই-বুক, নিউজ ফিড, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছোট রিভিউ, এমনকি ভিডিও-এস্যের মাধ্যমেও তারা জ্ঞান গ্রহণ করছে। অর্থাৎ পাঠক হারিয়ে যায়নি; পাঠকের ধরন পাল্টেছে। এই পরিবর্তনের ধারায় বইমেলা একটি ভিন্নরকম ভূমিকা পালন করে এটি ডিজিটাল যুগে বইয়ের প্রতি নতুন করে কৌতূহল সৃষ্টি করে, বইয়ের স্পর্শ অনুভূতি ফিরিয়ে দেয়, লেখকের সঙ্গে পাঠকের মানবিক সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং বইকে নতুন করে সমাজের আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে।

বইমেলার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো এটি এক প্রকার চলমান অনুভূতি, একধরনের মানসিক উদযাপন। মানুষ যখন কোনো উৎসবে যায়, তখন সে নিজে থেকেই উৎসবের উপহার খুঁজে নেয়। বইমেলা তেমনই; সেখানে গেলে মানুষ বই কিনতে বাধ্য হয় না, কিন্তু বই হাতে নিতে কৌতূহল জন্মে। বইয়ের গন্ধ, সাদা আলোয় জ্বলজ্বলে স্টল, বইয়ের মলাটের রঙিন দুনিয়া, মানুষের ভিড়, লেখকের উপস্থিতি, নতুন বই প্রকাশের উত্তেজনা এসব মিলিয়ে এমন এক পরিবেশ তৈরি হয় যা মানুষকে বইয়ের কাছাকাছি টেনে আনে। এই অনুভূতিই একজন মানুষকে পাঠকের পথে ঠেলে দেয়। একজন তরুণ হয়তো সারাবছর বই পড়েনি, কিন্তু বইমেলায় গিয়ে তার প্রথম বই কেনা, প্রথম সই সংগ্রহ, প্রথমবার কোনো লেখকের কথা শোনা এই ক্ষুদ্র ঘটনাগুলোই তার মনে বইয়ের প্রতি এক ধরনের আবেগ তৈরি করে। পাঠক হঠাৎ করে জন্মায় না; কিন্তু সেই জন্মের প্রথম বীজটি অনেক সময় বইমেলাতেই পড়ে।

আজকের তরুণরা হয়তো মোবাইলে বেশি ব্যস্ত, কিন্তু এটাও সত্য যে বইমেলায় তাদের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি। তারা দল বেঁধে আসে, ছবি তোলে, ক্যাপশন লেখে কেউ কেউ এই আচরণকে ‘নকল সংস্কৃতি’ বলে তাচ্ছিল্য করে, কিন্তু বাস্তবে এই উপস্থিতিই বইয়ের প্রতি নীরব আকর্ষণকে বাঁচিয়ে রাখে। এমন অনেক তরুণ আছে যারা প্রথম বইটিই বইমেলা থেকে কিনেছে, প্রথমবার কোনো উপন্যাস হাতে নেওয়ার অভিজ্ঞতাটিও বইমেলার। পরিবারও এখানে বড় ভূমিকা রাখে। বাবা-মা যখন সন্তানের হাত ধরে বইমেলায় নিয়ে যায়, ছোটবেলায় সেই মেলার আনন্দ শিশুর মনে রঙিন স্মৃতি হয়ে থাকে, যা পরে বড় হয়ে বইপড়ার অভ্যাসে রূপ নেয়। শিশু-কিশোরদের জন্য বইমেলা একটি পৃথিবী বইকে খেলনা মনে হয়, ছবির বই গুলো চোখে রঙ ছড়ায়, ঢুকে যায় তারা চরিত্রের জগতে। তাই বইমেলা শিশু পাঠক তৈরিতে অমূল্য ভূমিকা রাখে।

এখন অনেক কনটেন্ট ক্রিয়েটর, ইউটিউবার, ব্লগার, সোশ্যাল মিডিয়া লেখক বই প্রকাশ করছেন। তাদের ভক্ত সংখ্যাও লাখ লাখ। ফলে যারা কখনও প্রিন্ট বই কিনেনি, তারা শুধুমাত্র প্রিয় ক্রিয়েটরের বই পাওয়ার জন্য বইমেলায় যায়। এতে প্রথমবারের মতো তারা প্রিন্ট বইয়ের স্বাদ পায়।

এভাবে বইমেলা ডিজিটালের পাঠকদের প্রিন্টের জগতে টেনে আনার দরজা হয়ে ওঠে। আর লেখকের সঙ্গে দেখা, কথা বলা, ছবি তোলা এসব অভিজ্ঞতা পাঠকের মনে লেখকের সঙ্গে একধরনের পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি করে। ফলে তারা সেই লেখকের বই পড়তে আগ্রহী হয়। বইমেলার আলোচনাসভা, কবিতা পাঠ, স্মৃতিচারণ, পুরস্কার বিতরণ, গল্প পাঠ অনুষ্ঠান এসবই পাঠকের মধ্যে সাহিত্য নিয়ে বোধ, আগ্রহ এবং আবেগ তৈরি করে। মানুষ সাহিত্যকে তখন ‘দেখতে’ পায়, ‘শুনতে’ পায় এবং ‘অনুভব’ করে। এই অনুভূতি তাকে পাঠক হওয়ার পথে এগিয়ে দেয়।

তবে শুধু ইতিবাচক দিক বললে বাস্তবতা অসম্পূর্ণ থাকে। বইমেলায় পাঠক তৈরি হওয়া কঠিন হয়ে যাওয়ার কিছু কারণ আছে। প্রথমত, মানহীন বইয়ের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, তা নতুন পাঠকের জন্য ভয়ঙ্কর। তারা যদি প্রথমবার কোনো নিম্নমানের বই পড়ে, তাহলে বইয়ের প্রতি বিরক্তি জন্মাতে পারে। দ্বিতীয়ত, বইয়ের দাম অনেক বেড়ে গেছে। ছাত্র-তরুণদের জন্য বই কেনা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তৃতীয়ত, অনলাইন পিডিএফের সহজলভ্যতা অনেককেই প্রিন্ট বই থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। চতুর্থত, সারা বাংলাদেশে পাঠাগারের অভাব। বইমেলায় যে পাঠের আগ্রহ তৈরি হয়, তা ধরে রাখার মতো কোনো জায়গা অনেকের নেই। পঞ্চমত, তরুণদের মনোযোগ খুব বিচ্ছিন্ন; দীর্ঘ উপন্যাস পড়ার মতো মানসিক প্রস্তুতি অনেকের নেই। ষষ্ঠত, সামাজিক মিডিয়ার সময়মুখী কনটেন্টের সঙ্গে বইয়ের গভীর অভিজ্ঞতার প্রতিযোগিতা খুব কঠিন।

তবুও, এই সব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও বইমেলা পড়ার অভ্যাস বাঁচিয়ে রাখে। কারণ বইমেলা এমন একটি জায়গা যেখানে বইকে উৎসব হিসেবে দেখা হয়। মানুষ উৎসবে গেলে আনন্দ খোঁজে, স্মৃতি খোঁজে, গল্প খোঁজে। বইমেলা সেই গল্পের জন্ম দেয়। এমনকি যারা বইমেলায় আসে শুধু ছবি তুলতে, তাদের মধ্যেও বইয়ের সঙ্গে এক ধরনের সম্পর্ক তৈরি হয় হয়তো তারা তখনই বই কেনে না, কিন্তু পরবর্তীতে যখন কোনো বই সামনে পায়, তখন বইমেলার স্মৃতি তাকে বই হাতে নিতে অনুপ্রাণিত করে। এভাবে বইমেলা সরাসরি নয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই পাঠক তৈরি করে।

বইমেলা পাঠক তৈরির কারখানা নয়; এটি পাঠক তৈরির পরিবেশ, দরজা, আবেগ, উৎসাহ এবং প্রথম ধাপ। এটি মানুষকে বইয়ের কাছে নিয়ে আসে, বই স্পর্শ করার অভিজ্ঞতা দেয়, লেখকের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তৈরি করে, সাহিত্যকে উৎসবে রূপ দেয়। মানুষ বই পড়ে কিনা তা নির্ভর করে পরিবার, শিক্ষা, সমাজ, ব্যক্তিগত আগ্রহ এবং পরিবেশের ওপর। কিন্তু মানুষ বই হাতে তুলে নিতে প্রথম অনুপ্রেরণা কোথায় পায়? অনেকের জন্য সেই জায়গাটি হলো বইমেলা। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় হ্যাঁ, বইমেলা এখনও পাঠক তৈরি করে; হয়তো আগের মতো দ্রুত নয়, কিন্তু আরও গভীরভাবে, আরও অভিজ্ঞতাভিত্তিকভাবে, আরও মানবিকভাবে।

আরশী আক্তার সানী

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত