ঢাকা সোমবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ফেসবুক যেন সত্য-মিথ্যার মিশেলে বয়ান তৈরির আঁতুড়ঘর

মো. শরিফুল ইসলাম
ফেসবুক যেন সত্য-মিথ্যার মিশেলে বয়ান তৈরির আঁতুড়ঘর

জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী দেশের রাজনীতিতে ন্যারেটিভ বা বয়ান বেশ আলোচিত একটি শব্দ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে রাজনৈতিক দলগুলো নিজস্ব মতাদর্শ বা রাজনৈতিক অবস্থানের পক্ষে জনমত তৈরি করতে সমসাময়িক ঘটনাকেন্দ্রিক বিভিন্ন কাহিনী বা বিবরণ অবতারণা করে থাকেন। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের কোনো বক্তব্য বা লেখাকে কেন্দ্র করে সেখানে নানা রঙ-বেরঙের উপাদান যুক্ত করে নিত্যনতুন উপাখ্যান হাজির করে থাকেন ফেসবুকে। সমর্থক থেকে শুরু করে অনেক সময় পরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও সেগুলো দেদারসে শেয়ার বা লাইক দিচ্ছে। প্রচারিত সেই তথ্যগুলো যাচাই-বাছাইয়ের কোনো অবকাশ নেই। সেটা সত্য নাকি মিথ্যা বা গুজব সেদিকে কারও ভ্রক্ষেপ নেই।

ফলে মিসইনফরমেশন, ডিসইনফরমেশন এবং ম্যালইনফরমেশন ফেসবুকে দিনকে দিন ভয়ঙ্করভাবে বাড়ছে। যেটা এই বহুল প্রচারিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সৃষ্টির প্রকৃত অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। যেখানে মিসইনফরমেশন হলো ব্যবহারকারীর অজ্ঞতা বা অসচেতনতার কারণে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া। ডিসইনফরমেশন মানে কোনো ব্যক্তি, সংগঠন বা রাষ্ট্রকে বিপদে ফেলার জন্য ভুল তথ্যের ইচ্ছাকৃত ব্যবহার। অন্যদিকে তথ্যটি সঠিক কিন্তু সেটি কোনো ব্যক্তি, সংগঠন বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ব্যবহার করাকে ম্যালইনফরমেশন বুঝায়।

বিভিন্ন বিশ্লেষণে দেখা যায়- ফেসবুকে বিকৃত বা ভুল তথ্য, খণ্ডিত ভিডিও, ভুয়া ফটোকার্ড, পত্রিকার অসত্য হেডিং কিংবা এআই বা কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার সাহায্যে অপতথ্য ছড়িয়ে দিতে অন্ত্যত দুইটি ধারার ব্যক্তিরা জড়িত। প্রথম ক্যাটাগরিতে সংযুক্ত মানুষজন প্রফেশনাল এবং রাজনৈতিক বা কোনো না কোনো মতাদর্শের। যারা দলীয় বা গোষ্ঠীস্বার্থে টার্গেট করে প্রতিপক্ষের কাঁটছাট বা অর্ধ-সত্য বক্তব্য, মাঝে মধ্যে পুরোপুরি ভুয়া বক্তব্য বা তথ্য একই সময়ে অনেকগুলো কথিত পপুলার আইডি থেকে ছড়িয়ে দেয়। তা সাময়িকভাবে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য দেশের মূলধারার গণমাধ্যমের নামে ভুয়া রেফারেন্সও ব্যবহার করে থাকে। প্রাথমিকভাবে এরাই ফেসবুকে অর্ধ সত্য-মিথ্যার ন্যারেটিভ তৈরির মূল ক্রীড়নক। দ্বিতীয় ভাগে থাকা অধিকাংশই হয় কোনো দল বা গোষ্ঠীর অন্ধসমর্থক, নয়তো তথ্যজ্ঞানে একেবারেই অজ্ঞ। আবার কিছু ব্যবহারকারী আবেগের বশবর্তী হয়েও ভুল তথ্য শেয়ার বা লাইক দিয়ে থাকে। এরা সাধারণত বিকৃত তথ্যকে ভাইরাল করতে সহায়তা করে।

যদিও সবকিছুর পেছনে একমাত্র উদ্দেশ প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করা এবং ভোটারদের সিদ্ধান্ত বা জনমতকে প্রভাবিত করা। অবশ্য বিপরীত পক্ষও বসে থাকে না। তারাও পাল্টা ন্যারেটিভ দাঁড় করায় কিংবা সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। ঠিক এভাবেই চলছে পাঁচণ্ডআগস্ট পরবর্তী ফেসবুক রাজনীতিতে বয়ান নির্মাণের কুসুমণ্ডকুসুম প্রতিযোগিতা! যেটা নিকট অতীতে কয়েকটি ক্যাম্পাসে ঘটে যাওয়া ছাত্রসংসদ নির্বাচনের আগে ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে দেখা গেছে। আসন্ন ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় এয়োদশ জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সেটা আরও প্রকট আকার ধারণ করছে। মানে মাঠের রাজনীতির পাশপাশি সমান্তরালভাবে চলছে বা চলবে ফেসবুক রাজনীতি। কাজেই ন্যারেটিভ নির্মাণের এই রাজনীতি আগামী দিনে বাড়বে, বৈকি কমবে না। তবে সমস্যাটা হচ্ছে ভুল বা বিকৃত সংবাদের অপরাজনীতি। যেটাকে রাজনীতি না বলে তথ্যগত প্রতারণা বা গুজব বলাই শ্রেয়। অনলাইনে তথ্যের সত্যতা যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, বাংলাদেশে অন্তবর্তীকালীন সরকারের এ সময়ে ভয়াবহ অপতথ্য ছড়াচ্ছে। এসব ভুয়া সংবাদ বা গুজবের কারণে মব সহিংতাও বাড়ছে উদ্বেগজনকভাবে। অনলাইনে প্রতিদিনই অজস্র ভুল তথ্য বা সংবাদ শনাক্ত করা হচ্ছে।

এর বাইরে অবশ্য তৃতীয় আরেকটি গ্রুপ আছে যারা রাজনীতি নয়, দেশে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের উস্কানি বা সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলতে চায়। তারা সংঘবদ্ধভাবে ফেসবুকে বিভিন্ন অপতথ্য, অর্ধ-সত্য কিংবা ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়। সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চায়।

মো. শরিফুল ইসলাম

শিক্ষক, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত