ঢাকা রোববার, ১৮ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

গাজায় যুদ্ধের দামামা : প্রস্তুত হামাস

শক্ত অবস্থানে ফিলিস্তিন মিসর সৌদি জর্ডান ইয়েমেন
গাজায় যুদ্ধের দামামা : প্রস্তুত হামাস

ফিলিস্তিনের গাজায় আবার যুদ্ধ শুরুর তোড়জোড় শুরু হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের মদতে আবার আগ্রাসন শুরুর হুমকি দিয়েছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী। যুদ্ধের প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে হামাসও। বন্দিবিনিময় স্থগিত রাখার অবস্থানে অটল রয়েছে হামাস। গাজাবাসীদের বাস্তুচ্যুত করা নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের লাগাতার হুমকিকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে সৌদি আরব, মিসর, জর্ডান ও ইয়েমেন।

আলজাজিরা জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করায় হামাস গাজায় আটক বন্দিদের মুক্তি ‘অনির্দিষ্টকালের’ জন্য স্থগিত করার পর গাজায় আবার যুদ্ধ শুরু করার হুমকি দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। হামাস চূড়ান্তভাবে পরাজিত না হওয়া পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনী যুদ্ধ করবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। গাজায় ১৯ জানুয়ারি থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর রয়েছে। শর্ত অনুযায়ী শনিবার তিন ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার কথা ছিল হামাসের। কিন্তু, ইসরায়েল অব্যাহতভাবে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করায় মুক্তি স্থগিত করার কথা জানায় হামাস। এরপর এক্সে দেওয়া এক পোস্টে নেতানিয়াহু বলেন, ‘যদি শনিবার হামাস আমাদের বন্দিদের ফিরিয়ে না দেয়, তাহলে যুদ্ধবিরতি শেষ হয়ে যাবে এবং হামাস শেষ পর্যন্ত পরাজিত না হওয়া পর্যন্ত ইসরায়েলি সেনাবাহিনী লড়াইয়ে ফিরে যাবে।’ নেতানিয়াহু মঙ্গলবার একের পর এক টুইট বার্তায় হামাসকে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের জন্য দোষারোপ করে বলেন, তিনি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে গাজা উপত্যকার অভ্যন্তরে এবং চারপাশে জড়ো হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

হামাস বলেছে, ইসরায়েলি যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে এটি নিয়ে আর দরকষাকষির সুযোগ নেই। এ-কারণে ইসরায়েলি বন্দিদের আসন? মুক্তি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছেন তারা। সংগঠনটি বলেছে, তারা সব বাধ্যবাধকতা পূরণ করলেও ইসরায়েল প্রতিনিয়ত চুক্তি লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। তারা আমাদের জনগণের ওপর গুলি চালাচ্ছে, ত্রাণ সহায়তার গাড়ি প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে এবং বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা নিজ ঘরবাড়িতে ফিরতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন। গাজার শাসক দলটি বলেছে, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্তাবলী পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং এ-নিয়ে যে-কোনো জটিলতা বা বিলম্বের জন্য তারাই দায়ী। এরপরও হামাস বলেছে, ইসরায়েল সব বাধ্যবাধকতা ঠিক মতো মেনে চললে বন্দি বিনিময়ের দরজা খোলা থাকবে। চুক্তির অংশ হিসেবে ইসরায়েলি কারাগারে বন্দি শত শত ফিলিস্তিনির মুক্তির বিনিময়ে হামাস এ-পর্যন্ত ২১ বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে। যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপে গাজা থেকে মোট ৩৩ বন্দির মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জর্ডানের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লাহ বলেছেন, গাজা দখল ও ফিলিস্তিনিদের জাতিগতভাবে বাস্তুচ্যুত করার বিতর্কিত পরিকল্পনার বিরোধিতায় আরব দেশগুলো একজোট। মঙ্গলবার হোয়াইট হাউজে বৈঠকের পর রাজা আবদুল্লাহ সোশ্যাল মিডিয়ায় এক পোস্টে বলেন, গাজা ও পশ্চিমতীরের ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করার বিরুদ্ধে জর্ডানের দৃঢ় অবস্থান আমি পুনর্ব্যক্ত করেছি। এটি সমগ্র আরব বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান। তিনি বলেন, ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত না করে গাজা পুনর্গঠন এবং সেখানে মানবিক সংকট মোকাবিলাই অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। জর্ডানের রাজা বলেন, দুই রাষ্ট্রের ভিত্তিতে একটি ন্যায়সঙ্গত শান্তি অর্জনই এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার একমাত্র উপায়। তিনি বলেন, গাজায় যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে ট্রাম্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আমরা আশা করি, যুক্তরাষ্ট্র এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ এটিকে বজায় রাখতে কাজ করবে। ট্রাম্প বৈঠকে বলেন, তিনি গাজাকে মার্কিন কর্তৃত্বের অধীনে নেবেন, গাজার মালিকানা নেওয়ার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করবেন এবং গাজাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করবেন। জর্ডানের রাজা আবদুল্লাহকে গাজা দখল এবং এটিকে ভূমধ্যসাগরীয় রিসোর্টে পরিণত করার ট্রাম্পের পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রশ? করা হলে তিনি এ-বিষয়ে স্পষ্ট মন্তব্য এড়িয়ে যান। তবে তিনি বলেন, গাজায় ক্যান্সার বা অন্যান্য রোগে আক্রান্ত দুই হাজার শিশুকে জর্ডান অবিলম্বে গ্রহণ করতে প্রস্তুত।

সৌদি প্রেস এজেন্সি জানিয়েছে, ফিলিস্তিনি জনগণের বাস্তুচ্যুতির বিষয়ে ইসরায়েলের বিবৃতিকে স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে সৌদি মন্ত্রিসভা। ফিলিস্তিনি ইস্যুতে রিয়াদের দৃঢ় অবস্থানের কথাও পুনর্ব্যক্ত করেছেন তারা। ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদের অধিবেশনের পর এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। বৈঠকে মন্ত্রীরা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন? বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন বলে জানায় প্রেস এজেন্সি। খবরে বলা হয়, অধিবেশনে মন্ত্রীরা জোর দিয়ে বলেন, দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের স্বীকৃতি এলেই কেবল সেখানে শান্তি অর্জিত হতে পারে। ফিলিস্তিনিদের সৌদি ভূখণ্ডে স্থানান্তর করা নিয়ে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের পর সৌদি আরবের মন্ত্রিসভার পক্ষ থেকে এই প্রত্যাখ্যানের খবর এলো। এর আগে সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছিল, ইসরায়েল ফিলিস্তিলিদের জাতিগত নির্মূলে যে পদ্ধতিগত অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে, এটি আড়াল করার জন্যই নেতানিয়াহু এমন মন্তব্য করেছেন।

মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি মঙ্গলবার গাজার পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার মার্কিন প্রস্তাব আবার প্রত্যাখ্যান করেছেন। ফিলিস্তিনিদের গ্রহণ না করলে মিসর ও জর্ডানে বিপুল মার্কিন সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া হবে, মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন হুমকির পরও নিজের দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করলেন আল-সিসি। ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেনের সঙ্গে ফোনালাপে গাজা উপত্যকাকে বসবাসযোগ্য করে তোলা, এর পুর্নগঠনের দিকে মনোনিবেশ করা, ফিলিস্তিনিদের অধিকার সংরক্ষণ করা এবং নিজ ভূমিতে তাদের বসবাসের অধিকার নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন মিসরের প্রেসিডেন্ট।

হামাসের শীর্ষ কর্মকর্তা সামি আবু জুহরি বলেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্তির একমাত্র উপায় হলো ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে সম্মান জানানো। মঙ্গলবার রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ট্রাম্পকে মনে রাখতে হবে, এখানে একটি চুক্তি রয়েছে, যা উভয় পক্ষকে সম্মান করতে হবে এবং এটিই বন্দিদের ফিরিয়ে আনার একমাত্র উপায়।’ সোমবার ট্রাম্প বলেছিলেন, শনিবারের মধ্যে হামাস যদি সব ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি না দেয়, তবে যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাতিল করা উচিত। তিনি বলেন, শনিবার দুপুরের মধ্যে যদি সব বন্দি মুক্তি না পান, তাহলে তাদের জন্য নরকের দরজা খুলে যাবে। ট্রাম্প বলেন, ভেঙে-ভেঙে নয়, এক দুই বা তিন-চারজন করে নয়, যদি সব ইসরায়েলি বন্দি এ-সময়ের মধ্যে মুক্তি না পান, তবে আমি বলব, যুদ্ধবিরতি বাতিল করা উচিত। এ-প্রসঙ্গে হামাস নেতা জুহরি বলেন, ‘আমাদের কাছে হুমকির ভাষার কোনো মূল্য নেই। ট্রাম্পের মনে রাখা উচিত, এটি শুধু পরিস্থিতিকে জটিল থেকে জটিলতর করবে।’

ইয়েমেনের হুথি আনসার-আল্লাহ আন্দোলনের নেতা আবদুল মালিক আল-হুথি বলেছেন, গাজা এবং লেবাননের যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে ইসরায়েল যদি সেখানে বর্বরতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তবে ইয়েমেন অবিলম্বে ইসরায়েল-বিরোধী অভিযান আবার শুরু করবে। ২০১৫ সালে রাজধানী সানা থেকে মার্কিন নৌসেনাদের প্রস্থানের বার্ষিকীতে দেওয়া এক বক্তৃতায় তিনি উল্লেখ করেন, ইসরায়েল গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তির দ্বিতীয় ধাপ বাস্তবায়ন নিয়ে গড়িমসি করায় সেখানে আবার যুদ্ধ শুরু হতে পারে। আল-হুথি বলেন, ইসরায়েলিদের বুঝতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র যতই সহযোগিতা করুক, ইসরায়েল যদি আবার আগ্রাসনের পথে পা বাড়ায়, নিশ্চিতভাবে তারা লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হবে। তার স্পষ্ট বক্তব্য, ‘আমাদের আঙুল ট্রিগারেই আছে। শত্রুরা যদি আবার আগ্রাসন শুরু করে, তবে আমরাও হামলা শুরু করব।’ ইয়েমেনি নেতা বলেন, ‘লেবাননের বিরুদ্ধে আগ্রাসন বাড়লে, আমরা সামরিক কিংবা যে-কোনো পর্যায়ে লেবাননের জনগণ এবং তাদের প্রতিরোধ সংগ্রামের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ময়দানে লড়াই করতে প্রস্তুত।’

ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা দখল করা এবং ফিলিস্তিনিদের অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাবকে ‘গলাকাটা ও ডাকাতিসুলভ’ পদক্ষেপ উল্লেখ করে এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে উত্তর কোরিয়া। উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা কোরিয়ান সেন্ট্রাল নিউজ এজেন্সি বা কেসিএনএ বুধবার এক মন্তব্য প্রতিবেদনে বলেছে, নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য ফিলিস্তিনিদের মনে যে ক্ষীণ আশা বেঁচে ছিল, তা ওই নির্মম প্রস্তাবের কারণে ভেঙে যাচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘যুক্তরাষ্ট্রের উত্তাপে বিশ্ব এখন যব সেদ্ধ করার পাত্রের মতো ফুটছে।’ সম্প্রতি ডোনাল্ড বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র গাজার বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে উপত্যকাকে পর্যটন শিল্পে সমৃদ্ধ করতে চায়। গাজার বাসিন্দাদের সেখানে আর ফিরতে না দেওয়ার কথাও বলেন তিনি। ট্রাম্পের এই হতবাক করা ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় কেসিএনএ-তে মন্তব্য প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। ট্রাম্প প্রশাসন পানামা খাল এবং গ্রিনল্যান্ড দখলের যে আহ?ান জানিয়েছে, তা নিয়ে প্রতিবেদনে তীব্র সমালোচনা করা হয়। ‘মেক্সিকো উপসাগর’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘আমেরিকা উপসাগর’ করার জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের নেওয়া সিদ্ধান্তেরও সমালোচনা করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের উচিত তাদের কালানুক্রমিক বিভ্রান্তি থেকে বেরিয়ে আসা এবং অবিলম্বে অন্য দেশ ও জনগণের মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন বন্ধ করা।’ একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকে ‘চাঁদাবাজ’ বলেও অভিহিত করা হয়েছে উত্তর কোরিয়ার বার্তা সংস্থায়। গাজা নিয়ে দেশটির অবস্থান ফিলিস্তিনের পক্ষে। গাজা উপত্যকায় রক্তপাতের জন্য ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে আসছে দেশটি।

আজ এখানেই শেষ করছি। সবাই ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন আর দেখতে থাকুন বিডিভিউজ। চ্যানেলটি ভালো লাগলে সাব¯?াইব করুন। সংযুক্ত থাকুন আমাদের ফেসবুক পেজে। আল্লাহ হাফেজ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত