তমদ্দুন মজলিস রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি বাস্তবায়নের আন্দোলনের জনক বা সূতিকাগার সংগঠন বললেও ভুল হবে না। জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে মেতে ছিল। বাংলাকে শাসকদের সেই ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করতে যুক্তি প্রদর্শন এবং অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সংগ্রামের সূত্রপাত করে তমদ্দুন মজলিসই। আন্দোলনের চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন পর্যন্ত ইতিবাচক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন মজলিসের সংগঠকরা। নেতাকর্মীদের দীপ্ত পদচারণা ছিল রাজপথের সংগ্রামেও ।
১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তমদ্দুন মজলিস যে প্রতিবাদের আগুন জ্বালিয়েছিল, ১৯৫২ সালে তা-ই বিস্ফোরিত হয়েছে দাবানল হয়ে। আন্দোলনের চূড়ান্ত সাফল্য রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের হাত ধরে আসলেও এ সংগঠনটির যাত্রা তমদ্দুন মজলিসের একটি রাজনৈতিক শাখা হিসেবেই। সাংগঠনিক ভূমিকার কারণেই তমদ্দুন মজলিসকে ভাষা আন্দোলনের অভিভাবক বলা চলে। আর এ সংগঠনের প্রধান উদ্যোক্তা-প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মোহাম্মদ আবুল কাসেম ছিলেন আন্দোলনের প্রাণপুরুষ।
নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি। এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বাপর সময়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, এ নিয়ে নানা ধরনের মত-আলোচনা তৈরি হয়। পাকিস্তানের যাত্রার শুরু থেকেই সরকারিভাবে সব কাজকর্ম, মুদ্রিত ফরম, ডাকটিকিট, স্ট্যাম্প, মানি অর্ডার ফরম, মুদ্রা, সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে শুধু উর্দু ও ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়। বাংলা শুধু সরকারি কাজ থেকেই বাদ দেয়া হয়নি, বরং নানাক্ষেত্রে এর ভাষাভাষীদের উপেক্ষাও করা হয়। অথচ পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্ব থেকেই অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবি জোরালো ছিল। রাজধানীসহ সব প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে জনমনে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়, তা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির সাথে একীভূত হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও সামাজিক-রাজনৈতিক সচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির ১৮ দিনের মাথায় ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় সংগঠনটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম এর সম্পাদক নির্বাচিত হন। শুরুতে এর সদস্য ছিলেন তখনকার এসএম হলের ভিপি সৈয়দ নজরুল ইসলাম (স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি), এসএম হলের সমাজসেবা সম্পাদক শামসুল আলম, ফজলুর রহমান ভূঁইয়া, একেএম আহসান, কবি মোফাখখারুল ইসলাম, আব্দুল খালেক (পরে পুলিশের আইজিপি)। রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক নুরুল হক ভূঁইয়াও এর গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক ছিলেন। ১৯ নম্বর আজিমপুরে আবুল কাসেমের বাসার একটি কক্ষে এর কার্যালয় স্থাপিত হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম অফিস, সূতিকাগার এটিই। পরে এর অফিস রশিদ বিল্ডিংয়ে স্থানান্তর করা হয়। ওই দিনই এক বৈঠকে ১৬ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর ভাষা-আন্দোলন ও মজলিসের আদর্শ-উদ্দেশ্যের পক্ষে জনমত গঠনের লক্ষ্যে সাংগঠনিক পক্ষ পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এ প্রসঙ্গে অলি আহাদ তার ‘জাতীয় রাজনীতি: ১৯৪৫-৭৫ বইয়ে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান এবং রসায়ন বিজ্ঞানের অধ্যাপকদ্বয় আবুল কাসেম ও নুরুল হক ভূঁইয়া ধূমায়িত অসন্তোষকে সাংগঠনিক রূপদানের প্রচেষ্টায় ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস গঠন করেন। নবগঠিত তমদ্দুন মজলিসই ভাষা-আন্দোলনের গোড়াপত্তন করে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন ‘ভাষা-আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস’ বলেন, ‘... তমদ্দুন মজলিস নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। এরপর ঢাকায় এই প্রথম ভাষা-আন্দোলন একটি সাংগঠনিক ভিত্তি অর্জন করে। ইতোপূর্বে ভাষা প্রসঙ্গটি পত্র-পত্রিকায় আলোচনা ও বিবৃতি দানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তমদ্দুন মজলিসের মাধ্যমে ভাষা প্রশ্নটি পত্র-পত্রিকার বাইরে সাধারণ আলোচনা ও অংশগ্রহণের সুযোগ এনে দেয়।’
১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সকালে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা- না উর্দু?’- শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে তমদ্দুন মজলিস। ঘোষণাপত্রটি প্রকাশের পর ভাষা আন্দোলন এগিয়ে যাওয়ার জন্য একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি পায়। এটি আন্দোলনের নীতি নির্ধারণও করে দিয়েছিল। ওই দিন বিকালেই তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে সরকারি ইন্টারমিডিয়েট কলেজের (বর্তমান- ঢাকা কলেজ) ছাত্রাবাস নূপুর ভিলায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও উর্দু করা হোক শীর্ষক এক ঘরোয়া সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। ভাষা আন্দোলনের কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করাই ছিল সেমিনারের মূল লক্ষ্য। এতে ঘোষণাপত্রের উপর বিস্তারিত আলোচনা শেষে কর্মপদ্ধতি নির্ধারণে অংশগ্রহণকারীরা একমত হন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে সেমিনারে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাসেম, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, কবি জসীম উদ্দীন, অধ্যাপক কাজী আকরাম হোসেন, অধ্যাপক শামসুল হক, শাহেদ আলী, সাংবাদিক সানাউল্লাহ নূরী। (সূত্র: আমি যখন সাংবাদিক ছিলাম; সানাউল্লাহ নূরী।)
সেপ্টেম্বরের বাকি দিনগুলোতে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে জনমত গঠন এবং মজলিসের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য প্রচারের উদ্যোগ নেয়া হয়। নেতারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো, ঢাকার বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রচারণা চালান। রাজধানীর বাইরে মজলিসের শাখা গঠন শুরু হয়। অক্টোবরে গণসংযোগের পাশাপাশি আইন-পরিষদ ও মন্ত্রীপরিষদের সদস্যদের সাথে মতবিনিময় করেন মজলিসের নেতারা। প্রচারণায় ঘোষনাপত্র পুস্তিকা ছাড়াও লিফলেট বিতরণ করা হয়। কর্মীদের হাতে লেখা পোস্টার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সাটিয়ে দেয়া হয়। এ সময় মজলিস কর্মীরা বিভিন্নস্থানে বাধারও শিকার হন। প্রচারণায় সাড়া দেননি অনেক শিক্ষিত বাঙালিও। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবুল কাসেম বলেন, ‘পুস্তকটি (ঘোষণাপত্র) কিনিবার মতো ৫ জন লোকও প্রথমে পাওয়া যায় নাই। আমি মজলিসের কয়েকজনকে নিয়া বইটি লইয়া বিভিন্ন জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করিয়াছি। ব্যক্তিগতভাবে বহু লোকের সঙ্গে আলাপ করিয়াছি, কিন্তু ২-১টি ছাড়া তার প্রায় জায়গাতেই নিরাশ হইয়াছি।’