ইসলামের মূলভিত্তি ঈমান। ঈমান মানে বিশ্বাস। এটি আভিধানিক অর্থ। ইসলামের পরিভাষায় ঈমান মানে সাতটি বিষয়ের উপর অকাট্য বিশ্বাস। এর মধ্যে কোনো একটির বিশ্বাসে সামান্য হেরফের হলে মুসলমানিত্ব থাকবে না। ঈমান বলতে যদি একমাত্র আল্লাহর উপর বিশ্বাস মনে করা হয়, তাহলে কাফের মুশরিকরাও বিশ্বাসী। কোরআন মজিদে আছে, তুমি যদি মক্কার কাফের মুশরিকদের জিজ্ঞাসা কর, আসমান জমিন চন্দ্র সূর্য কে সৃষ্টি করেছেন, জবাবে তারা বলবে, অবশ্যই আল্লাহ। আল্লাহই তো সৃষ্টিকর্তা।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধান রচনার সময় শুরুতে বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম লেখার প্রস্তাব উঠেছিল। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আওয়ামী লীগ তা হতে দেয়নি। ’৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর মরহুম জিয়াউর রহমান সংবিধান সংশোধন করে সংবিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম সংযোজন করেন। গেল ১৫ বা ২১ বছরের ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের সময় পুনরায় কথা উঠে সংবিধানে কেন বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম থাকবে। কিন্তু জনরোষের ভয়ে বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম সংবিধান থেকে মুছতে পারেনি। তবে বিসমিল্লাহর আল্লাহ শব্দের এমনভাবে তরজমা করা হয়, যাতে পৌত্তলিকরাও খুশি হয়ে যায়। আগে ছিল মহান আল্লাহর নামে... এখন তা মহান সৃষ্টিকর্তার নামে। আল্লাহ শব্দটি মহান আল্লাহর জাতি বা সত্তাগত নাম। এই নামের অনুবাদ হয় না। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতবাদী সরকার আল্লাহ নামের অনুবাদ করে সৃষ্টিকর্তা। যাতে পৌত্তলিকরাও তুষ্ঠ থাকে।
আসল কথা, শুধু আল্লাহর উপর বিশ্বাসের নাম ঈমান নয়। আল্লাহর উপর বিশ্বাস যথার্থ হওয়ার জন্য আরো সাতটি বিষয়ে বিশ্বাস থাকতেই হবে। আল্লাহর সম্পর্কে ধারণার ক্ষেত্রেও ব্যাপক বিষয় আছে। যেমন তিনি শুধু সৃষ্টিকর্তা নন। তিনি লালন পালনকর্তা, সবকিছুর সার্বক্ষণিক নিয়ন্তাও। এখন যে বিশ্বব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে, চন্দ্রসূর্য আকাশ সৌরজগত পরিক্রমনরত আছে এর নিয়ন্তা কে, অবশ্যই আল্লাহ। পৃথিবীর সবকিছুর লালন পালনকর্তা, জীবন-জীবিকার ব্যবস্থাপকও তিনি। এমন নয় যে, তিনি সৃষ্টিকর্তা আর দেবদেবিরা মানুষের জীবন-জীবিকার নিয়ন্ত্রণকারী। এমন ধারণাই শিরক।
ঈমানের সাতটি শাখা বা ভাগ সম্বন্ধে ছোটবেলায় একটি আরবি বাক্য মুখস্থ করেছিলাম মকতবে। বড় হয়ে ভাবি, এর চেয়ে গুছানো শব্দাবলি দ্বিতীয়টি নেই। ১. আমানতু বিল্লাহি, ‘আমি বিশ্বাস স্থাপন করেছি আল্লাহর ওপর’। ২. ওয়ামালায়িকাতিহী ‘তার ফেরেশতাদের উপর’ ৩. ওয়াকুতুবিহি ‘তার কিতাবসমূহের উপর’ ৪. ওয়া রুসুলিহী ‘তার রাসূলগণের উপর’ ৫. ওয়াল ইয়াউমিল আখের ‘পরকালের উপর’।
যে জগতে বাস করছি তার নাম ইহকাল। মৃত্যুর পরে আরেকটি জীবন শুরু হবে তার নাম পরকাল। মুসলমান মাত্রই পরকালে বিশ্বাসী। কিন্তু বস্তুবাদিরা, কাফেররা বলে, জীবন বলতে এই পৃথিবী। পৃথিবীতে যে কয়দিন আছি সেটিই জীবন, মৃত্যুর পরে ধুলোর সাথে মিশে যাব, যেভাবে অন্যান্য প্রাণি উদ্ভিদ মরার পর মাটিতে মিশে যায়। কিন্তু মুসলমান মাত্রই পরকালীন জীবনে বিশ্বাস করে। ৫. ওয়াল কাদরে খাইরিহি ওয়া শাররিহী মিনাল্লাহি তাআলা ‘তকদির বা নিয়তি কিংবা জীবনের ভালো মন্দ আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত ও সুলিখিত।’ মানুষের জীবন ও জগৎ পরিচালিত হচ্ছে আল্লাহর সুনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী। এ কথায় অকাট্য বিশ্বাস ঈমানের অনিবার্য শর্ত। এক কথায় ‘তাকদিরে ঈমান।’ সর্বশেষ ৭. ওয়াল বা’সে বা‘দাল মউত ‘মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের উপর।’
ইসলাম পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে না। ইসলামের বিশ্বাস পুনরুত্থানে। মৃত্যুর পর কর্মফল অনুযায়ী মানুষ আবার শুকর বিড়াল কুকুর হয়ে জন্ম নেবে বা ভালো মানুষের অবয়ব ধারণ করে পৃথিবীতে আসবে, এই ধারণা পৌত্তলিক অবৈজ্ঞানিক, যারা এমন বিশ্বাস পোষণ করে তারা কাফের. মুশরিক পৌত্তলিক। ইসলামের ধর্মবিশ্বাস পুনরুজ্জীবন, পুনরুত্থান। পুনর্জন্ম এবং পুনরুত্থানের ধারণার মাঝখানে যোজন দূরত্ব বিদ্যমান। মুসলমানরা বিশ্বাস করে, পৃথিবীর সফর শেষ করে মানুষ যখন মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নেবে, তারপর তাকে কবরস্ত করা হবে তখন শুরু হবে কবর জীবন, এই জীবনকে বরজখি জীবনও বলা হয়। ইসরাফিল (আ.) নামক ফেরেশতা আল্লাহর হুকুমে শিঙ্গায় ফুঁক দিলে প্রলয় ঘটে যাবে, চাঁদ সূর্য আকাশ তারা পর্বতমালা ধূনিত তুলার মতো উড়তে থাকবে। সবকিছু লন্ডভন্ড ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। তারপর যতকাল আল্লাহর ইচ্ছা সৃষ্টিজগত নিস্তরঙ্গ অবস্থায় পড়ে থাকব। কোথাও জীবনের স্পন্দন থাকবে না। আবার আল্লাহর হুকুমে ইসরাফিল (আ.) পুনরায় সিঙ্গায় ফুঁক দেবেন, তখন শীতের সন্ধ্যায় মাটির টিবি থেকে উইপোকা বের হওয়ার মতো সবকিছু প্রাণ নিয়ে কবর জীবন ছেড়ে হাজির হবে হাশরের ময়দানে। সেখানে সবকিছুর ভালো-মন্দের বিচার হবে। কর্মফল অনুযায়ী সৎকর্মশীলরা বেহেশতের পরম সুখের নিবাসে চিরস্থায়ী হবে। দুনিয়াতে যারা অসৎ, অসুন্দর ও অন্যায় কথা ও কাজে জীবনকে কলুষিত করেছিল, তাদের জন্য নির্ধারিত হবে জাহান্নামের মর্মন্তুদ শাস্তি, দোজখের আগুন। আল্লাহ মাহে রমজানের উসিলায় আমাদের জান্নাতের অধিকারী এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করুন।