মিয়ানমারের জান্ত সরকারের সেনা সদস্যদের নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের মুখে টিকতে না পেরে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। নতুন করে আরও লক্ষাধিক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এতে দিনে দিনে চাপে পড়ছে বাংলাদেশ।
জানা গেছে, রাখাইন রাজ্যে বিদ্রোহীগোষ্ঠী আরাকান আর্মির নির্মম অত্যাচারে ১ লাখ ১৩ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছেন। ফলে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে নতুন রোহিঙ্গাদের দেখা মিলছে। এসব রোহিঙ্গা উখিয়া ও টেকনাফের স্থল ও নৌপথে সীমান্তের অন্তত ৩০টি পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ২০২৩ সালের নভেম্বরের পর থেকে নতুন করে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে দেড় হাজারের কাছাকাছি রোহিঙ্গা পরিবার এসেছে। এছাড়া আলাদাভাবে এসেছে আরও ৫ হাজার ৯৩০ জন। নতুনভাবে আসা রোহিঙ্গারা ২৯ হাজার ৬০৭ পরিবারের সদস্য। সীমান্তে বাংলাদেশের সতর্কতার মধ্যেও নতুন আসা ১ লাখ ১৩ হাজার রোহিঙ্গার মধ্যে ৫৩.৭৭ শতাংশ নারী এবং বাকি অংশ পুরুষ। এই রোহিঙ্গাদের বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি সংখ্যা ১৮-৫৯ বছর বয়সী নারী এবং পুরুষের।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে, আরাকান আর্মির নির্যাতনের কারণে রাখাইনের মংডু অঞ্চলের বুড়া সিকদারপাড়া গ্রামসহ অন্যান্য গ্রামের বাসিন্দারা কক্সাবাজারের উখিয়া ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। তারা এপ্রিল মাসের শুরুতে পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। তারা বলছেন, মিয়ানমার সরকারের সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আরাকান আর্মি নির্যাতনের কারণে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। বুড়া শিকদারপাড়া গ্রাম থেকে অন্তত ৬০ জনকে নির্যাতন ও গুলিবর্ষণ করে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আরাকান আর্মি দখলে নেওয়ার পর কোথাও কোথাও আগের চেয়ে রোহিঙ্গা নিধন বেড়েছে। গত ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশে প্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের মধ্যে মোহাম্মদ আলী বলেন, গ্রামের সব বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর সারারাত বাইরে পালিয়ে ছিলাম। পরদিন আরাকান আর্মি আমাদের খুঁজে বের করে নির্যাতন শুরু করে।
মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী বলেন, আরাকান আর্মি আমাদের জিম্মি করে ফেলে। পরে বেশকয়েকদিন লুকিয়ে থেকে পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসি। এই পরিবারের মতো হাজার হাজার রোহিঙ্গা আরাকান আর্মির নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের মুখে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন। তারা জানান, রোহিঙ্গা তরুণ-তরুণীদের জিম্মি করছে আরাকান আর্মি। তাদের সাথে দাস-দাসীর মতো ব্যবহার করছে। বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে। কাউকে কাউকে আবার রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন নির্মাণকাজে লাগাচ্ছে। একজন রোহিঙ্গা যুবক বলেন, আরাকান আর্মি আমাকে নির্যাতন করেছে। আমার এক স্বজনকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে। আরেকজন বলেন, কিশোর-তরুণদের আরাকান আর্মি তুলে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের কথামতো কাজ না করলে চরম অত্যাচার করছে।
কক্সবাজারের স্থানীয় তথ্য মতে, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে বাংলাদেশে ১ লাখ ১৩ হাজার রোহিঙ্গা এসেছে। গতবছরের মে ও জুন মাসে সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা আসে। নতুন যারা আসছে তাদেরকে আরেকজনের ঘরে জায়গা দেওয়া। অন্যদিকে রোহিঙ্গা নেতাদের ধারণা, প্রতিদিন পাঁচশতর বেশি রোহিঙ্গা আসছে। এভাবে আসতে থাকলে প্রত্যাবাসন দূরে থাক, তাদের থাকা-খাওয়া কীভাবে হবে তা নিয়ে দেখা দিয়েছে দুশ্চিন্তা।
বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা প্রবেশের বিষয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা নতুন করে বাংলাদেশে প্রবেশ শুরু করেছে। ক্যাম্পগুলোতে প্রতিদিন নতুন রোহিঙ্গার দেখা মিলছে। এতে রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ সহায়তায় সংকট তৈরি হচ্ছে।
২ বিজিবি ব্যাটালিয়ন টেকনাফের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান বলেছেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় অস্থিরতা বাড়ছে। সীমান্তে বিজিবি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।
বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরানোর পরিবর্তনে উল্টো রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার কথা বলছে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে আসা নতুন ১ লাখ ১৩ হাজার রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর। সোমবার সংস্থাটির পক্ষ থেকে এই অনুরোধ জানানো হয়েছে বলে জানান আরআরআরসি’র কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, গত সপ্তাহে ইউএনএইচসিআরের একটি চিঠি পেয়েছি। সেখানে নতুন করে মিয়ানমার থেকে উচ্ছেদ হওয়া প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার রোহিঙ্গাকে আশ্রয়ের অনুরোধ জানানো হয়েছে। নতুন করে আসা এসব রোহিঙ্গা বর্তমানে কক্সবাজারের আশপাশে অস্থায়ীভাবে তাঁবু টানিয়ে, এমনকি স্কুল ও মসজিদে অবস্থান করছেন।
প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা এবং সেখানে থাকা তাদের স্বজনদের বরাতে স্থানীয়রা বলছেন, মংডু শহরের নিয়ন্ত্রণ নিতে তীব্র সংঘাত চালিয়ে যাচ্ছে আরাকান আর্মি। একই সঙ্গে সরকারের সেনাবাহিনী শহরটি ধরে রাখতে প্রতিরোধ অব্যাহত রেখেছে। এর জেরে সড়ক ও আকাশ পথে হামলা চালানো হচ্ছে। তীব্র লড়াইয়ে বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কাঁপছে রাখাইন রাজ্য। সীমান্তের বাসিন্দাদের দেওয়া তথ্য বলছে, টেকনাফের জাদিমোরা (এ এলাকা দিয়েই বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেছে), দমদমিয়া, কেরুনতলি, বরইতলি, নাইট্যংপাড়া, জালিয়াপাড়া, নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, নয়াপাড়া, সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ, জালিয়াপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া, ঘোলারচর, খুরেরমুখ, আলীর ডেইল, মহেষখালীয়াপাড়া, লম্বরী, তুলাতলি, রাজারছড়া, বাহারছড়া উপকূল, উখিয়ার বালুখালী, ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ হচ্ছে। মংডুর উত্তরের প্যারাংপুরু ও দক্ষিণের ফাদংচা এলাকায় জড়ো থাকা রোহিঙ্গারা দালালদের সহায়তায় অনুপ্রেবেশ করেছে।
প্রসঙ্গত, গত ১৮ এপ্রিল ফরেন সার্ভিস দিবস উপলক্ষে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ উভয় সংকটে আছে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের পথে বড় সমস্যা আরাকান আর্মি। বিদ্রোহীগোষ্ঠীটি রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক স্বীকৃত কোনো প্রতিষ্ঠান না হওয়ায় তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় যাওয়া যাচ্ছে না। আবার তাদের এড়িয়েও এ সংকট সমাধান সম্ভব নয়। তবে জাতীয় স্বার্থে অরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনায় বসা যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।