ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের পর্যটক ও ডাবল এন্ট্রি ভিসা বন্ধ করে দেয় ভারত। এরপর বাংলাদেশি পণ্য তৃতীয় দেশে রপ্তানিতে কলকাতা ও দিল্লির বন্দর ব্যবহারের ট্রান্সশিপমেন্ট ব্যবস্থাও বাতিল করে দেশটি। হঠাৎ করে ভারতের এসব সিদ্ধান্তে কিছুটা সমস্যায় পড়েন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। সেই সমস্যা সমাধানে দ্রুতই ব্যবস্থা নিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। এতে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে বছরে ৪৬২ মিলিয়ন ডলার হারাবে ভারত।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিমানবন্দরগুলোর সক্ষমতা বাড়িয়ে রপ্তানিকারকদের বাড়তি খরচ কমাতে অফসেট করা হতে পারে। ক্ষতিপূরণমূলক বাণিজ্য চুক্তি, পারস্পরিক বাণিজ্য চুক্তি, একটি রপ্তানিকারী বিদেশি সংস্থার মধ্যে, অথবা সম্ভবত একটি সরকার মধ্যস্থতাকারী হিসাবে কাজ করবে। অফসেট প্রায়শই পণ্য এবং পরিষেবাগুলোতে বাণিজ্য জড়িত থাকে এবং বিকল্পভাবে বলা হয়, শিল্প ক্ষতিপূরণ এবং শিল্প সহযোগিতার মাধ্যমে রপ্তানিকারকদের ব্যয় কমবে। এজন্য বিমানবন্দরে অটোমেশন সিস্টেম চালু করে কনটেইনার জট, ভাড়া এবং কনটেইনার হ্যান্ডেলিং চার্জ কমানো হবে। এখানে সরকারি সহায়তায় রপ্তানিকারকদের বাড়তি খরচ গুণতে হবে না। এটা অসম্ভবের কিছু নয়।
এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রপ্তানি) মো. আবদুর রহিম খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বাংলাদেশের বিমানবন্দর থেকে পণ্য না পাঠিয়ে ভারত থেকে তৃতীয় দেশে ট্রান্সশিপমেন্টের পেছনে ব্যবসায়ীদের নিশ্চতই কোনো সুবিধা আছে, সুবিধা না থাকলে ভারতের বিমানবন্দর ব্যবহার করবেন কেন? আমাদের বিমানবন্দরগুলোয় রপ্তানির সক্ষমতা যদি ১০০ টন হয়, সেখানে রপ্তানি পণ্য ১৫০ টন। বাকি ৫০ টন পণ্য রপ্তানিতে ভারতের বিমানবন্দর ব্যবহার করতে হয়। সুতরাং আমাদের বিমানবন্দরগুলার সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
তিনি আরও বলেন, দেশের উৎপাদিত পণ্যের শতকরা প্রায় ২০ ভাগ ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে তৃতীয় দেশে রপ্তানি করা হয়। বিমানবন্দরগুলোর সক্ষমতা বাড়লে রপ্তানিকারকদের জন্য ট্রান্সশিপমেন্টের প্রয়োজন হবে না। কার্গো বিমান রপ্তানির খরচের প্রসঙ্গে অতিরিক্ত সচিব বলেন, ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধ করায় যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে তা সমাধানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বেবিচক ও রপ্তানিকারদের মধ্যে নিয়মিত বৈঠক হচ্ছে। পণ্য রপ্তানির সমস্যা দ্রুত সমাধানের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা যিনি, তিনি আবার বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। পণ্য বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে দুই মন্ত্রণালয়ের গুরুত্ব রয়েছে। বিমানবন্দরগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো এবং কার্গো বিমানের সমস্যা দূরীকরণে বাণিজ্যের পাশাপাশি বিমানের দিকে সহজে নজর দিতে পারবেন উপদেষ্টা। বাণিজ্য সংক্রান্ত দুই মন্ত্রণালয়ের কাজের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সমন্বয়হীনতা থাকবে না।
জানা গেছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, কাঁকড়া, ফল, সবজিসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কার্গো বিমান সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে, ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট ব্যবস্থা বাতিলের পর দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোয় কার্গো বিমানের সক্ষমতা বাড়ানোর তোড়জোড় চলছে। এরইমধ্যে নতুন করে সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বিশেষায়িত কার্গো সার্ভিস শুরু করেছে। যা দেশের দ্বিতীয় মালবাহী ফ্লাইট পরিচালনাকারী বিমানবন্দর। কিছুদিনের মধ্যেই চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বড় পরিসরে কার্গো বিমান কার্যক্রম শুরু হবে।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত ভারতের বিমানবন্দর ব্যবহার করে ৩৬টি দেশে ৩৪ হাজার ৯০০ টনের বেশি পোশাক রপ্তানি করা হয়, যার মূল্য ৪৬২.৩৪ মিলিয়ন ডলার। দেশের বিমানবন্দরগুলোয় কার্গো বিমান পর্যাপ্ত চালু থাকলে দেশের টাকা দেশে থাকবে।
বেবিচকের সংশ্লিষ্টরা জানান, ভারত হঠাৎ করে গত ৮ এপ্রিল ট্রান্সশিপমেন্ট ব্যবস্থা বাতিল করে। এতে কিছুটা বিপাকে পড়েন রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীরা। বাধ্য হয়ে, আকাশপথে রপ্তানির পরিধি বাড়ানোর দিকে নজর দিয়েছে বাংলাদেশ। তারই অংশ হিসেবে গত রোববার গালিস্টেয়ার এভিয়েশনের একটি চার্টার্ড এয়ারবাস এ৩৩০-৩০০ ফ্রেইটার সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রায় ৬০ টন তৈরি পোশাক নিয়ে স্পেনের উদ্দেশে আকাশপথে রওনা হয়।
দেশের বিমানবন্দরগুলোতে কার্গো বিমান কার্যক্রমে রপ্তানি খাতে কেমন প্রভাব ফেলবে এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ফ্রেট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফএ) সভাপতি কবির আহমেদ আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, দেশের বিমানবন্দরগুলোয় বড় পরিসরে কার্গো বিমান চালুর উদ্যোগ নিঃসন্দেহে রপ্তানিকারকদের জন্য ভালো। তবে, স্ক্রিনিং ও স্ক্যানিং যন্ত্রপাতিসহ সব সুবিধা বিমানবন্দরে থাকতে হবে, যাতে রপ্তানিকারকরা বিমানবন্দর ব্যবহারে উৎসাহিত হন।
তিনি আরও বলেন, কার্গো বিমানের সাফল্য নির্ভর করবে খরচের ওপর। ইউরোপে নিয়মিত ফ্লাইটে কেজিপ্রতি ২.৬ ডলার এবং চার্টার্ড ফ্লাইটে কেজিপ্রতি প্রায় ৩.৫ ডলার ভাড়া হলেও রপ্তানিকারকরা আগ্রহী হবেন। আর সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বিশেষায়িত কার্গো বিমানে যে পোশাক রপ্তানি হয়েছে, সেটি বাণিজ্যিক আকারে হয়নি, একটি স্পেনের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের তৈরি পোশাক নিয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রপ্তানি শাখার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দেশের কার্গো বিমানে রপ্তানি খরচ বেশি থাকায় ভারতের বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানি করে আসছিলেন রপ্তানিকারকরা। ভারত বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের জন্য যে ট্রান্সশিপমেন্টের সুবিধা দিয়েছে তা বন্ধ করে দেওয়ায়, বাধ্য হয়ে দেশের কার্গো বিমান ব্যবহার করবেন রপ্তানিকারকরা। এতে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় করবে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ভারত বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে।
দেশের বিমানবন্দরের কঠোর নিরাপত্তাবলয় ও জনবলের বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কার্গো বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক শাকিল মেরাজ আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিরাপত্তার মান বজায় রেখে কার্গো বিমান সার্ভিস দেয়া হচ্ছে। কার্গো বিমান সার্ভিসের জন্য বিমানবন্দরে কঠোর নিরাপত্তাবলয় এবং জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান। কার্গো বিমান সার্ভিসে এখন ১০০ জন কাজ করছেন, আরও ৩০০ জন দুই-তিন মাসের মধ্যে যোগ দেবেন। কার্গো সার্ভিসের জন্য প্রায় ৪০০ যন্ত্রাংশের কার্যাদেশ দিয়েছি। আগামী জুন-জুলাইয়ে মধ্যে এসব যন্ত্রাংশ কার্গো বিমান বহরে যোগ হবে।
তিনি আরও বলেন, একটি দেশের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি পরিবহন খাত। দেশের উৎপাদিত পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে সড়ক ও সমুদ্র পথের পাশাপাশি আকাশপথ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কার্গো বিমান কার্যক্রম দ্রুত চালু করতে কাজ শুরু করে দিয়েছি। এই বিমানবন্দর থেকে বিভিন্ন দেশে কার্গো বিমানে করে পণ্য রপ্তানি করা যাবে। আকাশপথে পণ্য রপ্তানিতে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম কয়েক মাসের মধ্যে সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছাবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নৌপথে এবং বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা পোশাক নিয়ে যেতেন ভারতের দিল্লি ও কলকাতা বিমানবন্দরে। সেখান থেকে কার্গো বিমানে তৃতীয় দেশে পোশাক রপ্তানি করেন। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে নিউ জার্সি পর্যন্ত এয়ারফ্রেইটের খরচ কেজিতে ৬ ডলার, আর দিল্লি ও কলকাতা বিমানবন্দর থেকে কেজিতে খরচ ৪ ডলার। বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিমানবন্দরের কার্গো বিমানে পণ্য রপ্তানিতে যে ব্যয়, এর সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশ বিমান সার্ভিস চার্জ ঠিক রাখতে হবে। কার্গো বিমানে ব্যয় বাড়লে রপ্তানিকারকরা বিকল্প পথ খুঁজবেন। প্রয়োজনে শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের বিমানবন্দরগুলো ব্যবহার করবেন রপ্তানিকারকরা।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, দেশের বিমানবন্দরগুলোয় কার্গো বিমান সার্ভসের বিলম্ব দূরীকরণ, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কার্গো হ্যান্ডলিং মসৃণ ও আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়ানো দাবি করে আসছেন ব্যবসায়ীরা। মেয়াদোত্তীর্ণ যন্ত্রপাতির কারণে তীব্র যানজট দেখা দেয়। চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না। এসব সমস্যা সমাধান করলে ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট প্রয়োজন হবে না।
তারা আরও বলেন, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১০০ টনের কার্গো ফ্লাইটে ২০ থেকে ২৫ হাজার ডলার খরচ হয়। অথচ ভারতের বিমানবন্দরগুলোয় ১০০ টনের জন্য প্রায় ২ হাজার ডলার খরচ হয়। দামের এই পার্থক্য এবং অপর্যাপ্ত গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কারণে দেশের বিমানবন্দরগুলোয় রপ্তানিকারক এবং এয়ারলাইন্সগুলোর কাছে বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধিতে বিমান ভাড়া, কার্গো প্রাপ্তি, কাস্টমসসহ সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। বিমানবন্দরে নির্ভুল তথ্যভাণ্ডার, এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন স্ক্যানার (ইডিএস) মেশিনসহ কারিগরি সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পণ্য রপ্তানির প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বিমানের ভাড়া বা ফ্রেইট কস্ট যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে হবে।