জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলাকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে রীতিমতো যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। প্রতিবেশী দুই দেশের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের হুমকি-পাল্টা হুমকিতে ক্রমশ উত্তেজনা বাড়ছে। সে উত্তেজনার মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে পাক সেনারা। অপরদিকে পাকিস্তান থেকে সব ধরনের পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করেছে ভারত। এদিকে পাক-ভারত উত্তেজনা নিয়ে শিগগিরই নিরাপত্তা পরিষদে বৈঠক আহ্বান করেছে জাতিসংঘ।
এর আগে পেহেলগামে হামলার জন্য ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানকে দায়ী না করলেও তাৎক্ষণিকভাবে পাকিস্তানিদের ভিসা বাতিল, কূটনীতিক বহিষ্কার ও সিন্ধু নদের পানি বণ্টন চুক্তি স্থগিতের মতো বেশ কয়েকটি কঠোর পদক্ষেপ নেয়। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি লঙ্ঘন করে ভারত যদি সিন্ধু নদের ওপর বাঁধ বা এ জাতীয় কোনো স্থাপনা নির্মাণ করে, তাহলে ইসলামাবাদ হামলা চালাবে। গত শুক্রবার পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম জিও নিউজের ‘নয়া পাকিস্তান’ টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তিনি এই হুঁশিয়ারি দেন। খাজা আসিফ বলেন, ‘শুধু বন্দুকের গুলি বা কামানের গোলা ছুড়লেই আগ্রাসন হয় না। বহুভাবে আগ্রাসন চালানো যায়। যেমন সিন্ধু নদের পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া বা পানিপ্রবাহকে ভিন্নপথে চালিত করাও একপ্রকার আগ্রাসন। এর ফলে ক্ষুধা ও তৃষ্ণার কারণে মৃত্যু হবে লাখ লাখ মানুষের।’ খাজা আসিফ বলেন, ‘সিন্ধু নদের পানিপ্রবাহ আটকাতে যদি তারা (নয়াদিল্লি) বাঁধ বা এই জাতীয় স্থাপনা নির্মাণ করে তাহলে পাকিস্তান সেই স্থাপনা ধ্বংস করবে।’
তিনি বলেন, ‘তবে আপাতত আমরা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে বিষয়টি (সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি) নিয়ে আলোচনা করছি এবং নিবিড়ভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভারত সরকার কর্তৃক সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি একতরফাভাবে স্থগিত করার বিষয়ে ইসলামাবাদ সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে।’ প্রতিরক্ষামন্ত্রী আসন্ন নির্বাচনের পটভূমিতে রাজনৈতিক লাভের জন্য ‘নাটক’র জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তীব্র সমালোচনা করেন। এক প্রশ্নের জবাবে এই মন্ত্রী বলেন, ‘ভারতের ওপর বিশ্বব্যাপী চাপ আগের চেয়েও বেড়েছে। তবে এটি বলব না যে, হুমকি এড়ানো গেছে।’
খাজা আসিফ আরও বলেন, ‘নয়াদিল্লি যে আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রত্যাশা করেছিল তা পেতে ব্যর্থ হয়েছে। মোদি সরকার তাদের মিথ্যা দাবির সমর্থনে প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মোদির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।’ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তব্য এবং অভিযোগের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ভারত ক্রমাগত উস্কানি দিচ্ছে, তবে আমরা কেবল প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নেব।’
ভারত যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে তার কঠোর জবাব দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা। ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলা ঘিরে দুই দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনায় গত শুক্রবার এমন হুঁশিয়ারি দেয়া হয়। পেহেলগামে হামলার পেছনে পাকিস্তানের যোগসাজশ আছে বলে দাবি করেছে নয়াদিল্লি। তবে ওই দাবি নাকচ করেছে ইসলামাবাদ। একই সঙ্গে তারা নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। তখন থেকে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। পাকিস্তান তাদের সেনা তৎপরতা বাড়িয়েছে। আর নিজেদের সশস্ত্র বাহিনীকে ‘অভিযান চালানোর পূর্ণ স্বাধীনতা’ দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এরই মধ্যে গত বুধবার পাকিস্তানের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আগামী ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে ভারত হামলা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা করছে তারা।
গত শুক্রবার পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, এদিন রাওয়ালপিন্ডি শহরে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন কোরের কমান্ডারদের সম্মেলনে (কর্পস কমান্ডারস কনফারেন্স-সিসিসি) বিশেষ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন সেনাপ্রধান জেনারেল অসিম মুনির। এসময় সামরিক বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা বিদ্যমান ভূকৌশলগত পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তৃত পর্যালোচনা করেন। সেখানে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে চলমান অচলাবস্থা এবং বৃহৎ আঞ্চলিক নিরাপত্তার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। আইএসপিআরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সম্মেলনে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির প্রতি পাকিস্তানের প্রতিশ্রুতির কথা পুনর্ব্যক্ত করেন সামরিক বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে তারা স্পষ্ট করে বলেন যে, যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার যে কোনো চেষ্টার জবাব দেওয়া হবে এবং এই জবাব হবে কঠোর। পাশাপাশি পাকিস্তানের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতি যে কোনো মূল্যে সম্মান জানানো হবে।
পাকিস্তানের আইএসপিআর জানায়, সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেছেন, শান্তি ও উন্নয়নের পথে পাকিস্তানের যাত্রাকে কোনো সন্ত্রাসবাদ, জোরজবরদস্তি বা আগ্রাসনের মাধ্যমে থামানো যাবে না। পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে ভারত সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তা দৃঢ় সংকল্পের সঙ্গে মোকাবিলা করা হবে এবং পরাজিত করা হবে। এদিকে চলমান সংকটের মধ্যে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেছেন, সেনাপ্রধান অসিম মুনিরের নেতৃত্বে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী এবং জনগণের মধ্যে উচ্চ মনোবল রয়েছে। পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম জিও নিউজের ‘নয়া পাকিস্তান’ অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন তিনি। শুক্রবারের সিসিসিতে সেনাপ্রধানের ‘দৃঢ় সংকল্পের’ জন্য তার প্রশংসা করেন প্রতিরক্ষমন্ত্রী। খাজা আসিফ বলেন, বিগত পাঁচ দিনে যেভাবে তিনি (সেনাপ্রধান) বিভিন্ন সেনানিবাসে ও নিয়ন্ত্রণরেখায় সেনাসদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, তা সশস্ত্র বাহিনী এবং জনগণের মনোবল বৃদ্ধি করতে সহায়তা করেছে। তিনি বলেন, কাশ্মীর হামলার জন্য পাকিস্তানকে জড়িয়ে ভারত যে অভিযোগ এনেছে, তার কোনো ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ নেই। ভারতীয়রাও নরেন্দ্র মোদির বয়ানের বিরুদ্ধে যাচ্ছেন।
এদিকে উত্তেজনার মাঝেই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে পাকিস্তান।
জম্মু-কাশ্মিরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলা ঘিরে ভারতের সঙ্গে চলমান তীব্র উত্তেজনার মাঝে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে পাকিস্তান। গতকাল শনিবার পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী সাড়ে ৪০০ কিলোমিটার দূরে আঘাত হানতে সক্ষম এই ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালানোর দাবি করেছে। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, গতকাল শনিবার ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে সামরিক বাহিনী। এই ক্ষেপণাস্ত্র ৪৫০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। আবদালি অস্ত্র ব্যবস্থা (এডব্লিউএস) নামের এই ক্ষেপণাস্ত্রটি ‘ইন্দুস’ সামরিক মহড়ার অংশ হিসেবে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে বলে দাবি করেছে ইসলামাবাদ।
পাকিস্তান এমন এক সময়ে আবদালি ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে, যখন জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগামে ভয়াবহ হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চরম উত্তেজনা চলছে। একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবেশী দেশের এমন ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষাকে ‘গুরুতর উসকানি’ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে ভারত। ইসলামাবাদ বলেছে, ‘সামরিক বাহিনীর অপারেশনাল প্রস্তুতি যাচাই এবং ক্ষেপণাস্ত্রের উন্নত নেভিগেশন সিস্টেম ও অন্যান্য কারিগরি সক্ষমতা প্রমাণ করাই ছিল এডব্লিউএস ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের উদ্দেশ্য।’ পাকিস্তানের সরকারের এক বিবৃতিতে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার ঘটনায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ও সামরিক বাহিনীর প্রধানরা জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সব বাহিনীর অপারেশনাল প্রস্তুতি এবং কৌশলগত দক্ষতার বিষয়ে ‘পূর্ণ আস্থা’ প্রকাশ করেছেন বলে জানানো হয়েছে।
এদিকে প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান থেকে সব ধরনের পণ্য আমাদানি নিষিদ্ধ করেছে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জাতীয় নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। শনিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘এখন থেকে আর সরাসরি কিংবা ঘুরপথে পাকিস্তান থেকে কোনো পণ্য আমদানি করার অনুমোদন দেওয়া হবে না। জাতীয় নিরাপত্তাজনিত কারণে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। পরবর্তী আদেশ না আসা পর্যন্ত এই আদেশ কার্যকর থাকবে।’ জম্মু-কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার পেহেলগামে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলাকে ঘিরে সৃষ্ট উত্তেজনার আবহে পাকিস্তানের প্রতি এই বিরূপ পদক্ষেপ নিল ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। গত ২২ এপ্রিল মঙ্গলবার বিকালে পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলা চালায় কাশ্মীরভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-ই তৈয়বার উপশাখা দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট। স্বয়ংক্রিয় রাইফেল নিয়ে হামলাকারীরা অন্তত ২৬ পর্যটককে গুলি করে হত্যা করে, আহত হন আরও বেশ কয়েকজন। নিহতরা সবাই পুরুষ। বস্তুত, ২২ এপ্রিলের হামলা ছিল ২০১৯ সালের পুলোয়ামা হামলার পর জম্মু ও কাশ্মীরে সবচেয়ে বড় প্রাণঘাতী হামলা। ভয়াবহ এই হামলার জন্য সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করে ভারত এবং তাৎক্ষণিকভাবে সিন্ধু নদের পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত, দূতাবাস থেকে কূটনীতিকদের ফিরিয়ে আনা, ভারতে অবস্থানরত পাকিস্তানিদের ভিসা বাতিলসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয় নয়াদিল্লি।
এদিকে পেহেলগামের হামলার সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে ইসলামাবাদ। তবে নয়াদিল্লির শাস্তিমূলক পদক্ষেপের পাল্টা জবাব হিসেবে ভারতের জন্য নিজেদের স্থল ও আকাশসীমা বন্ধ, পাকিস্তানে অবস্থানরত ভারতীয়দের ভিসা বাতিল, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য স্থগিত, সীমান্ত বন্ধসহ একাধিক পদক্ষেপ নেয় পাকিস্তানও। পাকিস্তান থেকে অবশ্য খুব বেশি পণ্য যায় না ভারতে। তবে এতদিন ঘুরপথে দুবাই হয়ে পোশাক, মসলা বা ছোটো যন্ত্রাংশের মতো কিছু পণ্য যেত সেখানে। বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ঘুরপথেও যেন কোনো পাকিস্তানি পণ্য ভারতে প্রবেশ করতে না পরে, সেজন্য এই পদক্ষেপ নিয়েছে ভারতের সরকার।
বস্তুত, ২০১৯ সালে পুলওয়ামায় জঙ্গিহানার পর থেকে ভারত এবং পাকিস্তানের বাণিজ্যিক সম্পর্কে ক্রমশ অবনতি হতে শুরু করেছিল। ওই সময়ে ফল, সিমেন্ট, পেট্রোপণ্য, আকরিকসহ পাকিস্তান থেকে আসা বেশ কিছু পণ্যের উপর আমদানি শুল্ক ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছিল ভারত। বাণিজ্যিকভাবে ভারতের অন্যতম পছন্দের দেশ (মোস্ট ফের্ভাড নেশন)-এর তালিকা থেকেও পাকিস্তানকে সরিয়ে দিয়েছিল ভারত। তার পর থেকে গত কয়েক বছরে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও তলানিতে ঠেকেছে। গত বছরের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের জানুয়ারির মধ্যে পাকিস্তান থেকে মাত্র ৪ লাখ ২০ হাজার ডলারের পণ্য আমদানি করেছে ভারত। এক বছর আগেও যে পরিসংখ্যান ছিল, তার চেয়ে ২০ লাখ ডলারেরও কম মূল্যের আমদানি হয়েছিল ওই সময়ে।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে শিগগিরই বৈঠক হতে পারে বলে জানিয়েছে গ্রিস। বর্তমানে নিরাপত্তা পরিষদের ঘূর্ণায়মান সভাপতির দায়িত্ব পালন করছে দেশটি। জাতিসংঘ সদরদপ্তরে গত শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত আসিম ইফতিখার আহমদ বলেন, ‘সমস্ত বিকল্পই বিবেচনায় রয়েছে। এর মধ্যে নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি তোলা অন্যতম। আমরা উপযুক্ত সময়ে সিদ্ধান্ত নেব।’ পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ডন এ খবর জানিয়েছে। গ্রিসের রাষ্ট্রদূত ইভাঞ্জেলোস সেকেরিস গত বৃহস্পতিবার নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘আমরা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছি এবং এটি সম্ভবত খুব শিগগিরই ঘটতে পারে। আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। আজ আমাদের (নিরাপত্তা পরিষদের) সভাপতিত্বের প্রথম দিন।’ তিনি জানান, এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জমা পড়েনি। তবে এমন একটি আলোচনা মূল্যবান হতে পারে। ‘যদি বৈঠকের জন্য অনুরোধ আসে, তাহলে আমি মনে করি অবশ্যই এটি হওয়া উচিত। কারণ এটি একটি সুযোগ হতে পারে মতামত প্রকাশের এবং এটি কিছুটা উত্তেজনা প্রশমনে সহায়তা করতে পারে।’ রাষ্ট্রদূত আসিম সতর্ক করে বলেন, চলমান সংকট দ্রুত উত্তেজনায় রূপ নিতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ‘ভারতের দায়িত্বজ্ঞানহীন ও অস্থিতিশীল আচরণের ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও উত্তেজনাপূর্ণ এই পরিবেশে... আমাদের কাছে নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে যে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের সামরিক অভিযানের আশঙ্কা রয়েছে।’ তিনি জানান, ইসলামাবাদ এরইমধ্যে আন্তর্জাতিক মহলকে অবহিত করেছে যে, ‘আমরা জাতিসংঘ মহাসচিব, সাধারণ পরিষদের ও নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতিদের, নিউ ইয়র্কে ওআইসি গ্রুপ এবং নিরাপত্তা পরিষদের অন্যান্য সদস্যদের এ বিষয়ে অবহিত করেছি। আমরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গেও আমাদের অবস্থান ও উদ্বেগ শেয়ার করেছি।’
তিনি বলেন, ভারত যদি আগ্রাসন শুরু করে, তবে পাকিস্তান জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী তার অন্তর্নিহিত এবং বৈধ আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করবে। একই সময়ে রাষ্ট্রদূত আসিম সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান জানান। বলেন, পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের সব ধরনের রূপ ও প্রকাশকে ঘৃণাভরে নিন্দা জানায়। নিরীহ বেসামরিকদের লক্ষ্য করে হামলার কোনো ন্যায্যতা নেই। পেহেলগামে প্রাণহানির ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন এবং শোক প্রকাশ করেছি। তিনি ভারতের পানি চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্তকেও অবৈধ ও একতরফা বলে অভিহিত করেন। তিনি জানান, ‘চুক্তি স্থগিত করার কোনো বিধান নেই। ভারতের একতরফা ও অবৈধ পদক্ষেপ দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করবে।’
রাষ্ট্রদূত সেকেরিস বিষয়টির গুরুত্ব স্বীকার করে বলেন, ‘ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা নিয়ে আমরাও গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরাও অন্যান্যদের সঙ্গে একমত যে, উত্তেজনা প্রশমন ও সংলাপ জরুরি যাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে না চলে যায়।’ পেহেলগাম হামলার বিষয়ে সেকেরিস বলেন, ‘এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। আমরা নীতিগতভাবে সন্ত্রাসবাদের যে কোনো কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানাই এবং এটিই আমরা করেছি। নিরীহ বেসামরিকদের ওপর এই জঘন্য হামলা অবশ্যই নিন্দনীয়।’
তিনি বলেন, ‘ভারত ও পাকিস্তান- উভয়ই গ্রিসের তুলনায় অনেক বড় রাষ্ট্র। তাই বিষয়টির মাত্রাও ভিন্ন। আমরা সংলাপ ও উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বানে অন্যদের সঙ্গে একমত।’
এদিকে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় আতঙ্কে দিন কাটছে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখার দুই পাশের বাসিন্দাদের। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পাহাড়ঘেরা চুরান্দা গ্রামের শিক্ষকরা ভোরবেলা স্কুলশিক্ষার্থীদের প্রার্থনা পরিচালনা করেন। প্রার্থনায় বলা হয়, বাতাসে দোল খাওয়া আখরোটগাছ আর পাখির ডাকের শব্দ যেন কামানের গর্জনে ঢেকে না যায়। ছাত্রছাত্রীরা যদিও প্রতিদিনের মতোই ক্লাসে অংশ নিচ্ছে, শিক্ষক ফারুক আহমদ বলেন, ‘অভিভাবকদের মধ্যে ভয় অনেক বেশি। কারণ, সম্প্রতি পর্যটকদের ওপর প্রাণঘাতী হামলার পর নিয়ন্ত্রণরেখার (এলওসি) দুই পাশের অনেকেই আশঙ্কা করছেন, এটি (ভারত-পাকিস্তান) সংঘর্ষের দিকে গড়াতে পারে।’
কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তান দুইবার যুদ্ধ করেছে এবং গত কয়েক দশকে সীমান্তে অনেকবার সংঘর্ষে জড়িয়েছে। ফলে যখন প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ে, তখন কীভাবে আতঙ্ক নিয়ে সবকিছু দেখতে ও অপেক্ষা করতে হয়, তা এখানকার (নিয়ন্ত্রণরেখার দুই পারের) বাসিন্দারা জানেন। গত সপ্তাহে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পাহাড়ি পর্যটনকেন্দ্র পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় অন্তত ২৬ পর্যটক নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় পাকিস্তানকে দায়ী করেছে ভারত। ইসলামাবাদ তা অস্বীকার করেছে। ইসলামাবাদ বলেছে, তাদের কাছে ‘বিশ্বস্ত গোয়েন্দা তথ্য’ রয়েছে যে ভারত শিগগিরই পাকিস্তানে সামরিক অভিযান চালাতে পারে।
পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফফরাবাদের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা ১০০ কোটি পাকিস্তানি রুপি জরুরি তহবিল প্রস্তুত রেখেছে এবং নিয়ন্ত্রণরেখার কাছাকাছি গ্রামগুলোতে দুই মাস চলার মতো খাদ্য, পানি ও চিকিৎসাসামগ্রী পাঠানো হয়েছে। ২৫ বছর বয়সি আবদুল আজিজ বলেন, ‘গ্রামে দেড় হাজার মানুষের জন্য ছয়টি বাংকার আছে। দুই পক্ষই একে অপরকে হুমকি দিচ্ছে। সীমান্তে যদি উত্তেজনা বাড়ে, আমরা কোথায় যাব? ভয়-আতঙ্ক তো আছেই। কারণ, এই গ্রাম সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।’
অন্যদিকে পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের চকোথি গ্রামের বাসিন্দারা তাদের বাড়ির কাছে পাহাড়ি এলাকায় সুরক্ষিত আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করছেন। ‘লোকজন তাদের বাড়িতে বাংকার তৈরি করেছেন। গুলি চললে তারা বাংকারে ঢুকে পড়েন’, বলেন ২২ বছর বয়সি ফাইজান আনায়েত। রাওয়ালপিন্ডি শহর থেকে কাশ্মীরে পরিবারের সদস্যদের দেখতে এসেছেন তিনি। ফাইজান রাওয়ালপিন্ডিতে এসি মেরামতের কাজ করেন।
৭৩ বছর বয়সি মোহাম্মদ নাজির ফাইজানের প্রতিবেশী। বাংকার প্রস্তুত করার কাজ থেকে বিরতি নিয়ে গতকাল শুক্রবার নামাজ আদায় করতে মসজিদে যাচ্ছিলেন তিনি। তার পরিবারের শিশুরা তখন বাংকারের সামনে ক্রিকেট খেলছিল। নাজির বলেন, ‘আমরা কিছুতেই ভয় পাই না। আমাদের প্রতিটি সন্তান প্রস্তুত।’
পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফফরাবাদের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) পাকিস্তানি রুপি (৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার) জরুরি তহবিল প্রস্তুত রেখেছে এবং নিয়ন্ত্রণরেখার কাছাকাছি গ্রামগুলোতে দুই মাস চলার মতো খাদ্য, পানি ও চিকিৎসাসামগ্রী পাঠানো হয়েছে। কর্তৃপক্ষ গত বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, ভারতের হামলার আশঙ্কায় ওই অঞ্চলের সব মাদ্রাসা ১০ দিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর জানিয়েছে, (ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে) সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা মেরামতের জন্য সীমান্তের কাছে যন্ত্রপাতি স্থানান্তর করা হয়েছে এবং উদ্ধারকারী ও সিভিল ডিফেন্স কর্মীদের উচ্চ সতর্কতায় রাখা হয়েছে। পাকিস্তান রেড ক্রিসেন্টের কাশ্মীর শাখার প্রধান গুলজার ফাতিমা বলেন, ত্রাণকর্মীদের দল যখনই উত্তেজনা বাড়তে দেখে, তখনই প্রাথমিক চিকিৎসাকর্মীসহ ত্রাণসামগ্রী ও অন্য কর্মীদের মোতায়েনের কাজ শুরু করে তারা। গুলজার ফাতিমা বলেন, ভারত সামরিক অভিযান শুরু করলে নিয়ন্ত্রণরেখার কাছাকাছি এলাকা থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষের স্থানান্তর ঘটবে বলে তারা আশঙ্কা করছেন। তাই অন্তত ৫০০ পরিবারের জন্য তাঁবু, স্বাস্থ্য সরঞ্জাম, রান্নার সামগ্রীসহ ত্রাণশিবির প্রস্তুত করছেন তারা।