হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন এবং কোরআন-সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিলসহ ১৩ দফা দাবিতে রাজধানীর শাপলা চত্বরে শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ করছিল। ওই দিন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নেতাকর্মীরা দলে দলে মহাসমাবেশে যোগদান করেন, এতে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে মহাসমাবেশস্থল। দলীয় শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যে উচ্ছ্বাসিত ছিলেন নেতাকর্মীরা। কিন্তু হঠাৎ বিদ্যুৎ বন্ধের পর মতিঝিল এলাকায় ঘুটঘুটে অন্ধকার করে পরিকল্পিতভাবে শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশে রাতের আঁধারে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি যৌথ অভিযানের নামে শাপলা চত্বরের চারিদিক ঘিরে ফেলে। ঘুমন্ত হেফাজতের নেতাকর্মীদের ওপর টিয়ারশেল গুলি বর্ষণ করা হয়। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। মতিঝিলের শাপলা চত্বর, গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া, পল্টন, দৈনিক বাংলা, বিজয়নগর, জিরোপয়েন্ট পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। প্রায় ৫ ঘণ্টা ধরে থেমে থেমে চলা সংঘর্ষে হেফাজতে ইসলামের অর্ধশত কর্মী নিহত এবং শতাধিকের বেশি আহত হন। পরে হেফাজতের নেতাদের অনেকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। হেফাজতের নেতাকর্মীদের ওপর আওয়ামী লীগ সরকারের এমন নৃশংস হামলায় ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল বিশ্ব মানবতা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হেফাজতে ইসলামের শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে রাতের আঁধারে শটগানের গুলি, হ্যান্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেলের শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি একত্রে হেফাজতের কর্মীদের ওপর হামলা চালায়। ত্রিমুখী সংঘর্ষ চলাকালে ১০ সহস্রাধিক রাউন্ড রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেছিল পুলিশ। সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ হয়েছিল দুই সহস্রাধিক। শাপলা চত্বরে নৃশংসতা, আওয়ামী লীগ শাসনামলে গুম-খুনের বিচারের দাবিতে সরব রয়েছে হেফাজতে ইসলাম। এরইমধ্যে শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশে ৯৩ জন শহিদের তথ্য প্রকাশ করেছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। একে প্রাথমিক খসড়া তালিকা দাবি করে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি।
হেফাজতে ইসলামের জনসংযোগ বিভাগের দায়িত্বে থাকা কেফায়েতুল্লাহ আজহারী জানান, এই ৯৩ জনের তালিকা প্রাথমিক তথ্য। কাজ চলছে, এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এর আগে বেসরকারিভাবে কাজ করা প্রতিষ্ঠান অধিকার ২০২৪ সালের ১৯ আগস্ট তাদের ফেসবুকে ৬১ জনের নামণ্ডপরিচয় প্রকাশ করে। এ তথ্য প্রকাশ করায় মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান শুভ্র ও সংগঠনটির পরিচালক এএসএম নাসির উদ্দিন এলানকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাদের দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বর্তমানে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আছেন আদিলুর রহমান খান।
শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলাম সারা দিন নানা ঘটনার পর রাতেও অবস্থান নেন তারা। পরে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি তাদের সরাতে অভিযানে নামে। রাত ৩টার দিকে চারিদিক থেকে শুরু হওয়া মুহুর্মুহু গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেলে ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয় এলাকাজুড়ে। অভিযোগ রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীও হেফাজতের নেতাকর্মীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালান। ওই রাতের অভিযানে হেফাজতের অনেক কর্মী হতাহত হন। হেফাজতের খসড়া রিপোর্টে শাপলা চত্বরে গুলিতে ৯৩ শহিদের নাম প্রকাশ পেয়েছে। তালিকায় নিহতদের নামণ্ডপরিচয়, পরিবারের সদস্যদের নামসহ প্রকাশ করা হয়েছে। খসড়া রিপোর্ট যাচাই করে দেখা যায়, শহিদ হওয়া দুই-তৃতীয়াংশই ছিলেন যুবক।
হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ দমাতে নিরস্ত্র মানুষের ওপর লাইট নিভিয়ে দিয়ে রাতের অন্ধকারে গুলি চালায় স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এই হত্যাকাণ্ডে কতজন মারা গেছেন তা নিয়ে এখনও জনমনে প্রশ্ন আছে। এবার আলোচিত সেই হত্যাকাণ্ড নিয়েই চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার। হেফাজতের শাপলা চত্বরের সমাবেশে চালানো হত্যাকাণ্ড নিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জন্য নিজের করা একটি অনুসন্ধানের কথা তুলে ধরেছেন আজাদ মজুমদার। যেখানে তার প্রতিবেদনে হত্যাকাণ্ডে নিহতের সংখ্যার কথাও জানানো হয়েছে। উপ-প্রেস সচিব তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘যখনই আমি হেফাজতে ইসলামকে কোনো বড় বিক্ষোভ করতে দেখি, তখনই আমার মনে পড়ে যায় শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ডের ওপর হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জন্য আমার অনুসন্ধানের কথা। যখন গোটা বিশ্ব এই গণহত্যার সংখ্যা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, তখন আমি ঢাকায় বিবিসির প্রাক্তন সংবাদদাতা মার্ক ডামেটের সঙ্গে চ্যালেঞ্জিং কাজটি গ্রহণ করি।’ অনুসন্ধানের রিপোর্ট নিয়ে আজাদ মজুমদার বলেন, ‘আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, দুই দিনের সহিংসতায় নিরাপত্তা বাহিনীর সাত সদস্যসহ কমপক্ষে ৫৮ জন নিহত হয়েছেন।’
শাপলা চত্বর নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে কতটা ঝুঁকি নিতে হয়েছিল সেই কথা তুলে ধরে আজাদ মজুমদার লেখেন, ‘আপনারা যারা এখন সাংবাদিকতার জগতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, মানবাধিকার রক্ষা করছেন, তারা হয়তো কল্পনাও করতে পারবেন না যে, কাজটি কতটা কঠিন ছিল। দুই সপ্তাহ ধরে চলা তদন্তের সময়, রাস্তাঘাট, হাসপাতালের লগবুক খুঁজে, নিহতদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে, প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে এবং কবরস্থানের প্রমাণ সংগ্রহ করে, মানুষকে খোলাখুলিভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে, আমি সবসময় নিরাপত্তা বাহিনীর নজরে পড়ে যাওয়ার এবং নিখোঁজ হওয়ার ভয়ে থাকতাম।’ তিনি তার পোস্টের শেষাংশে লিখেন, ‘নিরাপত্তার কারণে, আমি আগে কখনও আমার কাজের কৃতিত্ব দাবি করতে পারতাম না, কিন্তু যখনই আমি দেখি যে, কোনো সহকর্মী সাংবাদিক আমার কাজকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করছেন, তখন তা আমাকে সত্যিই আনন্দ দেয়।’
২০১৩ সালের ৫ মে রাত সোয়া একটায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পাশাপাশি তিন স্তরে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির শত শত সদস্য সমাবেশে ছত্রভঙ্গ করতে অভিযান চালায়। রাত পৌনে তিনটায় বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ সমাবেশে গুলি আর কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে থাকেন। থেমে থেমে সাউন্ড গ্রেনেডও ব্যবহার করা হয়। শত শত ফাঁকা গুলি, সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে অন্ধকার এলাকায় আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। মঞ্চের মাইক বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিরতিহীন ফাঁকা গুলি, কাঁদানে গ্যাস আর সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে পুরো এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। হেফাজতের শতশত কর্মী-সমর্থক মাথার ওপর দুই হাত তুলে লাইন ধরে পুলিশের কর্ডনের মধ্য দিয়ে ওই এলাকায় বিভিন্ন ভবন থেকে বেরিয়ে আসছিলেন। তাদের বেশিরভাগ ছিল মাদ্রাসার ছাত্র ও কিশোর। তাদের চোখে-মুখে ছিল অজানা আতঙ্ক ও ভয়। ভোর চারটার সময়ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা থেমে থেমে ফাঁকা গুলি ছুড়তে দেখা যায়। তারা তল্লাশি চালান আশপাশের ভবনগুলোতে। রাতের অভিযানে নিহতের সংখ্যা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল।