ঢাকা রোববার, ১৮ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

তেলআবিবে ব্যালিস্টিক হামলা, দুই সেনা নিহত

তেলআবিবে ব্যালিস্টিক হামলা, দুই সেনা নিহত

তেলআবিবে ইসরায়েলের প্রধান বিমানবন্দর বেন গুরিয়নে গতকাল রোববার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইয়েমেনের হুথি আনসার-আল্লাহর নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র বাহিনী। এতে অন্তত দুইজন ইসরায়েলি সেনা নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। হামলার পর বিমানবন্দরের সব ফ্লাইট স্থগিত করা হয়েছে। হামলার কথা স্বীকার করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। ইরানি বার্তা সংস্থা মেহের জানিয়েছে, গতকাল সকালে ইসরায়েলের মধ্যাঞ্চলে হঠাৎ করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সাইরেন বেজে ওঠে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জানা যায়, ইয়েমেন থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর মধ্যে একটি তেলআবিবের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরের কাছেই আঘাত হেনেছে। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, বিমানবন্দরের পাশে বিশাল একটি ধোঁয়ার কুণ্ডলী উপরের দিকে উঠছে, যেমনটা ক্ষেপণাস্ত্র বিস্ফোরণের পরই ঘটে থাকে। হামলার পর ইসরায়েলি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে বিমানবন্দরের সব ফ্লাইট স্থগিত করে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলো বাতিল অথবা বিকল্প রুটে পাঠানো হয়। এদিকে, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী নিশ্চিত করেছে যে, তারা বেন গুরিওন বিমানবন্দর এলাকায় আঘাত হানা ইয়েমেনি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রটি প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়েছে। টাইমস অব ইসরায়েলের খবর অনুযায়ী, সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তারা ইয়েমেন থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রটি প্রতিহত করার জন্য বেশ কয়েকবার প্রচেষ্টা চালান, তবে সেটি প্রতিহত করা সম্ভব হয়নি।

আগের দিনও হুথির নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র বাহিনী তেলআবিবে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। বাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইয়াহিয়া সারি গত শনিবার এক বিবৃতিতে জানান, ‘ফিলিস্তিনের নির্যাতিত জনগণের প্রতি সমর্থন এবং গাজায় মার্কিন-সমর্থিত ইসরায়েলি গণহত্যার প্রতিবাদে ইয়েমেনি সশস্ত্র বাহিনী অধিকৃত ইয়াফা এলাকার একটি সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে সফল ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এই অভিযানে ‘প্যালেস্টাইন-টু’ হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়, যা ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেদ করে সফলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে।’ ইয়াহিয়া সারি সতর্ক করে বলেন, ‘সমগ্র মুসলিম উম্মাহ গাজা নিয়ে নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তার পরিণতি ভোগ করবে। গাজায় যা ঘটছে, তার প্রভাব আজ অথবা আগামীকাল অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়বে। শত্রুরা তার আগ্রাসন বিস্তৃত করবেই। তাই সবার উচিত নিরাপত্তার জন্য হুমকি আসার আগেই গাজার সমর্থনে সোচ্চার হওয়া।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘গাজায় আগ্রাসন ও অবরোধের অবসান না হওয়া পর্যন্ত ইসরায়েলি ও মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।’ শনিবার ইসরায়েলি গণমাধ্যমগুলো জানায়, ইয়েমেন থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের পর ইসরায়েলের ১০০টিরও বেশি এলাকায় সাইরেন বেজে ওঠে। জেরুজালেম, তেলআবিব ও নেগেভ অঞ্চলে সতর্কতামূলক সাইরেন বাজানো হয় এবং ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ইয়েমেনি ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবিলায় তৎপর হয়ে ওঠে। ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে ইয়েমেনের সশস্ত্র বাহিনী ২০২৩ সালের শেষের দিক থেকে লোহিত সাগর, বাব আল-মান্দেব, আরব সাগর ও ভারত মহাসাগরে ইসরায়েল সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলোতে হামলা চালিয়ে আসছে। মাঝখানে যুদ্ধবিরতিকে সম্মান জানিয়ে হামলা বন্ধ থাকলেও ইসরায়েল গাজায় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে হামলা অব্যাহত রাখায় গত কয়েক মাস ধরে হামলা আবার শুরু করেছেন ইয়েমেনি যোদ্ধারা। এই হামলা ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী ও ইসরায়েলের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

এখনই নেতানিয়াহুর পদত্যাগ চায় বন্দির পরিবারগুলো : ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রশাসনের অপসারণ দাবিতে যখন সোচ্চার ইসরায়েলি বন্দিদের পরিবার, তখন গাজায় ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে আহত এক ইসরায়েলি বন্দিকে উদ্ধারের ভিডিও প্রকাশ করেছে হামাসের সামরিক শাখা আল-কাসসাম ব্রিগেডস। এই ভিডিও প্রকাশের পর বন্দিদের জীবন নিয়ে শঙ্কা আরও বেড়েছে পরিবারগুলোতে। তারা অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করে বন্দিদের উদ্ধারের দাবি জানান। পরিবারগুলোর দাবি, স্বজনদের মুক্তি পাওয়ার একমাত্র পথ হলো- নেতানিয়াহুর প্রশাসনের পতন এবং নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা করা। তারা বর্তমান সরকারের পতন আন্দোলন ত্বরান্বিত করার জন্য সব ইসরায়েলির প্রতি আহ্বান জানান। শনিবার এক বিবৃতিতে পরিবারগুলো বলেছে, ‘আমরা যদি ইসরায়েলের পুনর্গঠন চাই এবং ৭ অক্টোবরের পুনরাবৃত্তি না চাই, তাহলে আমাদের অবশ্যই নেতানিয়াহুর সরকারকে উৎখাত করতে হবে।’ এতে বলা হয়, নিজের সরকারকে বাঁচাতে আমাদের সন্তানদের বলি দেওয়া হচ্ছে; নেতানিয়াহুর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণের জন্য যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে।’ এদিকে, আল-কাসসাম ব্রিগেডসের মিলিটারি মিডিয়া শনিবার একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, প্রতিরোধ যোদ্ধারা ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে এক ইসরায়েলি বন্দিকে বের করে এনে তাকে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন। ভিডিওতে জানানো হয়, গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় তিনি গুরুতর আহত হন। ওই বন্দি ইসরায়েলি বাহিনীকে সম্বোধন করে বলেন, একটি সক্রিয় যুদ্ধবিরতির পরও তাদের আন্ডারগ্রাউন্ড শেল্টারে বোমা হামলা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ার পরও আমাদের ওপর বোমা হামলা থামেনি।’ তিনি স্পষ্ট করে বলেন, বন্দিদের উদ্ধারের জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার কথা বলে নেতানিয়াহু জঘন্য মিথ্যাচার করছেন। শনিবার তেলআবিবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামনে বন্দিদের মুক্তির দাবিতে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করেছেন। ৬৪ বছর বয়সি আরোনা মাসকিল বলেন, ‘আমরা এখানে এসেছি, কারণ আমরা বন্দিদের ঘরে ফেরাতে চাই। আমরা বিশ্বাস করি না যে বর্তমানে গাজায় যুদ্ধের কোনো ন্যায্যতা আছে।’ বিক্ষোভে অংশ নেওয়া ইসরায়েলিরা বলেছেন, এখন সময় যুদ্ধ বন্ধ করার এবং বন্দিদের ফিরিয়ে আনাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার।

যুদ্ধের জন্য ৬০ হাজার রিজার্ভ সেনা তলব ইসরায়েলের : ইসরায়েলি গণমাধ্যমগুলো শনিবার জানিয়েছে, গাজায় সামরিক অভিযানের পরিসর বাড়ানোর প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ইসরায়েল ৬০ হাজার রিজার্ভ সেনাকে তলব করেছে। এদিকে, যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতাকারী কাতারকে নিয়ে কঠোর মন্তব্য করেছেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ইসরায়েলের চ্যানেল টোয়েলভ জানিয়েছে, সেনাবাহিনী এরইমধ্যে রিজার্ভ বাহিনীকে তলবের আদেশ পাঠাতে শুরু করেছে। মূলত, গাজায় অতিরিক্ত সেনা মোতায়েনের জন্য এই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই তথ্য নিশ্চিত কিংবা অস্বীকার করা হয়নি। ইসরায়েলের সরকারি সম্প্রচারমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী রোববার নিরাপত্তা মন্ত্রিসভার বৈঠকে গাজায় অভিযান বাড়ানোর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা। এদিকে, শনিবার নেতানিয়াহু বলেছেন, কাতার উভয় দিকেই খেলছে। তারা ‘সভ্যতা না বর্বরতার পক্ষে’ তা তাদের নির্ধারণ করা উচিত। এই মন্তব্য সামাজিকমাধ্যম এক্সে পোস্ট করেন তিনি। এর প্রতিক্রিয়ায় কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল-আনসারি নেতানিয়াহুর মন্তব্যকে ‘উসকানিমূলক’ উল্লেখ করে বলেন, ‘এটি রাজনৈতিক ও নৈতিক দায়িত্ববোধের ন্যূনতম মানদ-েরও বাইরে।’

গাজায় খাদ্য ও ওষুধের সংকটে ৫৭ জনের প্রাণহানি : অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলার পাশাপাশি প্রকট আকার ধারণ করছে দুর্ভিক্ষ। খাদ্য ও ওষুধের সংকটে এরইমধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৫৭ ফিলিস্তিনি। গাজা কর্তৃপক্ষের বরাতে রোববার আলজাজিরা জানিয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে দখলদার ইসরায়েলের অবরোধের ফলে অন্তত ৫৭ ফিলিস্তিনি নাগরিক ক্ষুধায় মারা গেছেন। শনিবার গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস এক বিবৃতিতে বলেছে, এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে, কারণ সীমান্ত ক্রসিংগুলো বন্ধ থাকায় খাদ্য, শিশুদের দুধ, পুষ্টিকর উপাদান এবং জরুরি ওষুধ প্রবেশ করতে পারছে না। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২ মার্চ থেকে গাজায় খাদ্য ও ওষুধ ঢুকতে দিচ্ছে না ইসরায়েল, এতে করে গাজায় প্রায় ২৩ লাখ মানুষ অনাহারে রয়েছেন। উপত্যকাটিতে এখন শুধু বোমা হামলা নয়, ক্ষুধায় প্রাণ হারাচ্ছেন শিশুসহ অনেকে। এদের মধ্যে অনেকেই চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছেন। স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন, দ্রুত ত্রাণ সহায়তার ব্যবস্থা না করা হলে অনাহারে মৃতের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।

আরও ৪৫ ফিলিস্তিনি নিহত : শনিবার দিনভর ইসরায়েলি হামলায় শিশুসহ আরও ৪৫ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এদিন রাতে খান ইউনিসের শরণার্থী শিবিরে ভয়াবহ বোমা হামলা চালিয়েছে তেলআবিব। এর মধ্যদিয়ে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা বেড়ে কমপক্ষে ৫২ হাজার ৪৯৫ জনে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, শনিবার ইসরায়েলি হামলায় আহত হয়েছেন আরও ২৭৫ জন। ফলে আহতের সংখ্যা বেড়ে ১ লাখ ১৮ হাজার ৩৬৬ জনে দাঁড়িয়েছে। অনেক মানুষ এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে এবং রাস্তায় পড়ে থাকলেও উদ্ধারকারীরা তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। গাজার মিডিয়া অফিসের আপডেট তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৬১ হাজার ৭০০’রও বেশি হবে। কারণ, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকাপড়া হাজার হাজার মানুষ আর বেঁচে নেই বলেই ধারণা করছেন তারা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত