ঢাকা বুধবার, ২১ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

গাফিলতিতে খানাখন্দের ঢাকা

* আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সড়ক সংস্কার ও পাইপলাইন বসানোর কাজ পেয়েছিল, তাদের অধিকাংশ ঠিকাদার পলাতক। ফলে সড়কে কাজের ধীরগতি দেখা দিয়েছে। খানাখন্দে বৃষ্টির পানি জমলে মানুষের ভোগান্তি চরমে ওঠে * ‘সিটি কর্পোরেশন নিয়মিত সড়ক সংস্কার ও ড্রেনেজ উন্নয়নের কাজ করবে। এখন ঢাকার বহু এলাকায় সড়কের বেহাল দশার কারণে মানুষ ক্ষুব্ধ। সড়ক মেরামতে সিটি কর্পোরেশনের অগ্রাধিকারে থাকা উচিত।’
গাফিলতিতে খানাখন্দের ঢাকা

ঢাকার ব্যস্ততম এলাকা শিল্পনগরী তেজগাঁও, আর সেই এলাকার মসৃণ সড়ক কেটে নালা নির্মাণের জন্য কংক্রিটের পাইপ বসাচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। নালা নির্মাণে সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ আছে। তেজগাঁওয়ের মতোই মালিবাগের মূল সড়কের প্রায় পুরোটাই উঁচু-নিচু। কোথাও বড় গর্ত, কোথাও পিচ উঠে গেছে, কোথাও দেবে গেছে। মূল সড়কের পাশাপাশি অলিগলির সড়কের অবস্থা আরও বেহাল। এতে খানাখন্দে মানুষের ভোগান্তি কয়েক গুণ বেড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করা হয়। বর্তমানে অস্থায়ী প্রশাসক দিয়ে চলছে কাউন্সিলর অফিস। দক্ষিণ সিটিতে ওয়ার্ড আছে ৭৫টি, উত্তর সিটিতে ওয়ার্ড আছে ৫৪টি। জনপ্রতিনিধির অভাবে সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন এলাকার সড়ক সংস্কার ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়নে নাগরিক সেবা বিলম্বিত হচ্ছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন এলাকা সাত রাস্তা মোড় থেকে মাত্র একশ’ গজ দূরে সড়ক কেটে পাইলাইন বসানোর পরে কোনো রকম সংস্কার করা হয়েছে। এতো গেল ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের তেজগাঁও ও সাত রাস্তা এলাকার সড়কের বেহাল দশা। সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা উত্তরা কামারপাড়া, উত্তরখান, দক্ষিণ খান ও পীরেরবাগ এলাকায়। কিছু দূর পরপর ছোট-বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। কোনো কোনো অংশে সড়ক দেবে গেছে। সাতরাস্তার মোড় থেকে মহাখালী এবং মহাখালী থেকে তিব্বত পর্যন্ত কিছু অংশ উঁচু-নিচু হয়ে আছে। অনেক দিন ধরেই সড়কের এ অবস্থা। উত্তর সিটির মতোই ঢাকা দক্ষিণ সিটির আওতাধীন কমলাপুর, মালিবাগ, যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া এবং মাতুয়াইল এলাকার সড়কের বেহাল দশা। মূল সড়কের অবস্থার চেয়েও অলিগলি সড়কের অবস্থা আরও বেশি বেহাল। অনেক এলাকার সড়ক ও অলিগলি খোঁড়াখুঁড়ি-কাটাকাটি কিংবা খানাখন্দের যানবাহন ও পথচারী চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। কোথাও সিটি কর্পোরেশন, আবার কোথাও ঢাকা ওয়াসা এবং বিদ্যুতের লাইন সরবরাহের সংযোগ স্থাপনে সড়ক কেটে রাখা হয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সড়কের পিচ উঠে প্রতিদিন খানাখন্দে পরিণত হচ্ছে। অপরদিকে, কমলাপুর স্টেডিয়াম থেকে টিটিপাড়া হয়ে গোলাপবাগ মোড় পর্যন্ত একই চিত্র। কমলাপুর স্টেডিয়াম সংলগ্ন প্রধান সড়কে ছোট যানবাহন উল্টে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সড়ক প্রায় ১ হাজার ৩৪০ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রধান সড়ক ১৯০ কিলোমিটার, সংযোগ সড়ক (সেকেন্ডারি রোড) প্রায় ৩৪৫ কিলোমিটার ও অলিগলির সড়ক প্রায় ৮০৫ কিলোমিটার। এসব সড়কের প্রায় ১৫০ কিলোমিটার মেরামতের প্রয়োজন বলে মনে করছে সিটি কর্পোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কিছু সড়ক সংস্কার করা হচ্ছে। সড়কে খানাখন্দের বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মঈন উদ্দিনের মোবাইল নম্বরে কয়েকবার কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রায় ১ হাজার ৬৫৬ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। প্রকৌশল বিভাগের তথ্য মতে, গত বৃষ্টির মৌসুমে ২১৪ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে মেরামতের কাজ শুরু করেছে দক্ষিণ সিটি। তবে কিছু সড়ক মেরামতের কিছুদিন পর পরই ঢাকা ওয়াসা, বিদ্যুৎ কিংবা ইন্টারনেটের লাইন সংযোগের নামে বারবার সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি চলছে।

জানা গেছে, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শুরু হয় এ বছরের শুরুতে। বিভিন্ন সড়কের নিচ দিয়ে নালা নির্মাণের জন্য পাইপ বসাচ্ছে সিটি কর্পোরেশন। আবার কিছু সড়কে ঢাকা ওয়াসা, বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপনে লাইন বসাচ্ছে। তেজগাঁও এলাকার বাসিন্দা কাজল সরকার বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের আগে ড্রেনেজের কাজ শুরু হয়। কিন্তু সরকার পতনের পর কাজে ধীরগতি দেখা দেয়। মাসের পর মাস ড্রেনেজ নির্মাণ ও কংক্রিটের পাইপ বসানোর কাজ চলছে। এতে মানুষের চলাচলে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। প্রতিদিন হাজারো মানুষকে ভোগান্তি নিয়ে এ সড়ক পার হতে হয়। মাতুয়াইল এলাকার বাসিন্দা ফরিদ প্রধান বলেন, মাতুয়াইলের মাতৃসদন হাসপাতালের মোড়, জিরোপয়েন্ট পর্যন্ত সড়কে ছোট ছোট গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি এলে এসব গর্তে পানি জমে, ফলে যানবাহন নির্ধারিত গতিতে চলতে পারছে না। আবার সড়ক শুষ্ক থাকলে ধুলাবালুর জন্য হাঁটাচলা করা যায় না।

ভুক্তভোগীরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে কমলাপুর, যাত্রাবাড়ী ও আশপাশের এলাকায় সড়কগুলো ভাঙাচোরা ও এবড়োখেবড়ো থাকায় চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন চলাচলকারীরা। রাস্তায় অতিরিক্ত ভাঙাচোরা থাকায় ধীরগতিতে গাড়ি চালাতে হয়, এতে ৩০ মিনিটের রাস্তা যেতে এক ঘণ্টা লাগে।

ঢাকা উত্তর সিটির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সড়ক সংস্কার ও পাইপলাইন বসানোর কাজ পেয়েছিল, তাদের অধিকাংশ ঠিকাদার পলাতক। ফলে সড়কে কাজের ধীরগতিও দেখা দিয়েছে। খানাখন্দে বৃষ্টির পানি জমলে মানুষের ভোগান্তি সবচেয়ে বেশি বাড়ে। রিকশা, অটোরিকশা এবং মোটরসাইকেল চলাচল করতে গিয়ে সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় থাকেন, কখন দুর্ঘটনার কবলে পড়েন চালক-যাত্রীরা।

নগর পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম বিষয় ছিল মানুষ বিভিন্ন ভোগান্তির হাত থেকে রেহাই পাবেন। এখান রাষ্ট্র বড় ধরনের সংস্কারে ব্যস্ত থাকায় নগরজীবনের সড়ক সংস্কারে জনভোগান্তির দিকে নজর কম রাখছে। আবার সিটি কর্পোরেশনের সড়ক সংস্কারসহ বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কাজে, আগের মতোই কিছু শ্রেণির লোকজন প্রভাব বিস্তার করছে, নিয়মের বাইরে কাজ ভাগিয়ে নিচ্ছেন। এজন্য সবার আগে সংস্থাগুলোর সব কর্মকাণ্ড নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। তিনি আরও বলেন, সিটি কর্পোরেশন নিয়মিত সড়ক সংস্কার ও ড্রেনেজ উন্নয়নের কাজ করবে। এখন ঢাকার বহু এলাকায় সড়কের বেহাল দশার কারণে মানুষ ক্ষুব্ধ। সড়ক মেরামত সিটি কর্পোরেশনের অগ্রাধিকারে থাকা উচিত বলে মনে করেন এই নগর পরিকল্পনাবিদ।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান প্রকৌশলী মো. আমিনুল ইসলাম আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, সড়কে খানাখন্দের ব্যাপারে তিনি কোনো বক্তব্য দিতে চান না। এ ব্যাপারে ডিএসসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. বোরহান উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর মোবাইল নম্বরে কয়েকবার ফোন দেয়া হলে তিনি রিসিভ করেননি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত