ঢাকা সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ

মা পিঠা বানিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন, ছেলে আসেনি

মা পিঠা বানিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন, ছেলে আসেনি

ছেলের পছন্দের পিঠাপুলি বানিয়ে সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রাম এসেছিলেন সায়মনের মা রহিমা বেগম। বহদ্দারহাট এলাকায় দোকানের কাজ সেরে ১৮ জুলাই রাতে চট্টগ্রাম নগরীর ফকিরহাট এলাকায় খালার বাসায় যাওয়ার কথা ছিল সায়মনের; সেখানেই অপেক্ষায় ছিলেন মা। তবে শেষ পর্যন্ত মায়ের বানানো পিঠা আর খাওয়া হয়নি সায়মনের।

এর আগেই বুকে-পিঠে গুলি খেয়ে না ফেরার দেশে চলে যেতে হয়েছে ১৬ বছরের সায়মনকে। পিঠা নিয়ে ছেলেকে দেখতে এসে কফিনে বন্দি ছেলের নিথর দেহ নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন মা রহিমা বেগম।

জানা যায়, ১৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে বহদ্দারহাট এলাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিলে সংঘর্ষের আশঙ্কায় দুপুর ২টার দিকে দোকান বন্ধ করে সায়মনকে ছুটি দিয়ে দেন মালিক মিঠু চৌধুরী। দোকান থেকে বের হয়ে বাসায় যওয়ার পথে বহদ্দারহাট এলাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের মধ্যে চলমান সংঘর্ষে মাঝে পড়ে যায় সায়মন; গুলিবিদ্ধ হয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের গলিতে পড়ে থাকে সে।

পরে স্থানীয়রা অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকা সায়মনকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার বুকে ও পিঠে দুটি গুলির চিহ্ন দেখা যায়। সাথে কোনো আইডি কার্ড বা মোবাইল ফোন না থাকায় তার পরিচয় প্রথমে শনাক্ত করা যায়নি।

পরদিন দুপুরে দোকানে না আসায় সায়মনের মোবাইলে ফোন দেন মিঠু চৌধুরী। ফোনে তাকে না পেয়ে তার খালু মোহাম্মদ সুমনকে ফোন দিয়ে জানতে পারেন তার বাসায়ও যায়নি সায়মন। এদিক-সেদিক খুঁজে তার খোঁজ না পেয়ে ২০ জুলাই চমেক হাসপাতালের মর্গে গিয়ে সায়মনের মরদেহ শনাক্ত করেন দোকানের মালিক মিঠু চৌধুরী।

মিঠু বলেন, ‘প্রথমে আহতদের মাঝে তাকে খুঁজে না পেয়ে আমি ফিরে আসছিলাম। পরে হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির মুন্সি শাকিল বড়ুয়া তার মোবাইল ফোনে আমাকে একটি মরদেহের ছবি দেখান। ছবিটি ছিল সায়মনের। পরে মরদেহ শনাক্ত করার পর তার মা, খালা ও খালুকে খবর দিলে তারা এসে মরদেহ বুঝে নিয়ে যান।’

সায়মনের খালু মোহাম্মদ সুমন বলেন, ‘সায়মনের বয়স যখন মাত্র দেড় বছর, তখন ক্যানসারে মারা যায় বাবা আমিন রাসুল। মা রহিমা বেগম বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বড় ছেলে ও সায়মনকে নিয়ে চালিয়ে যান জীবন সংগ্রাম। মাত্র ১০ বছর বয়সে দৈনিক ৩০ টাকা বেতনে একটি চায়ের দোকানে কাজ নিয়ে জীবন সংগ্রামে মায়ের সাথে যোগ দেয় সায়মন। বছর তিনেক আগে গ্রামের বাড়ি সন্দ্বীপের বক্তার হাট এলাকা থেকে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে একটি মুদি দোকানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে যোগ দেয় সে।’

তিনি বলেন, ‘চটপটে স্বভাবের কারণে সবাই তাকে পছন্দ করত। মাস চারেক আগে পুরোনো চাকরি ছেড়ে বহদ্দারহাট মোড়ে হক মার্কেটে জয় এন্টারপ্রাইজ নামে একটি মুদি দোকানে যোগ দেয় মাসে ১৩ হাজার টাকা বেতনে। খতিবের হাট এলাকায় একটা মেসে থাকত সায়মন। মাসে এক দুইবার ছুটি পেলে আমাদের বাসায় আসত। ১৮ জুলাই রাতে তার আমাদের বাসায় আসার কথা ছিল। সকালে সন্দ্বীপ থেকে পিঠাপুলি নিয়ে এসেছিলেন তার মা। তার খালা ফ্রিজ থেকে গরুর মাংস বের করে রেখেছিলেন।’

সুমন বলেন, ‘১৮ জুলাই রাতে না আসায় আমরা ধরে নিয়েছিলাম, বহদ্দারহাট গ-গোলের কারণে সে আসতে পারেনি। তার মোবাইলও বন্ধ ছিল। ১৯ জুলাইও সে না আসায় আমরা খোঁজাখুঁজি শুরু করি। পরে শনিবার বিকেলে চমেক হাসপাতালে তার মৃতদেহ পেয়ে দোকানের মালিক আমাদের খবর দেন।’ সায়মনের মা বলেন, ‘আমার ছেলে পিঠা খুব পছন্দ করত। তাই তার জন্য পিঠা বানিয়ে এনেছিলাম। সে পিঠা এখন কে খাবে?’

তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে ছিল শান্তশিষ্ট। কারো সাথে কোনো ঝামেলায় যেত না। মনোযোগ দিয়ে নিজের কাজ করত। তার বড়ভাই কোনো কাজ করতে পারে না। মাত্র ১৩ বছর বয়সে সংসারের পুরো দায়িত্ব সে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। আমাদের দেখার এখন আর কেউ রইল না।’

তিনি বলেন, ‘আমি জানি না, আমার ছেলেকে কে গুলি করেছে। আমি শুধু বিচার চাই। যারা আমার নির্দোষ ছেলেকে মেরে ফেলেছে, তাদের যেন বিচার হয়।’

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত