
ব্যস্ততম ঢাকা শহরে শত শত মানুষের সামনে দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে পাথর মেরে নৃশংসভাবে ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে হত্যা করেছে যুবদলের নেতাকর্মীরা। পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল দেশজুড়ে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন ছাত্র-জনতা ও বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা। তারা সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ করেন।
বিক্ষোভ মিছিলে শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, ‘কণ্ঠে আবার লাগা জোর, চাঁদাবাজের কবর খোঁড়, ‘চাঁদাবাজ চাঁদা তোলে, ইন্টেরিম কী করে?’, ‘চব্বিশের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘কে দিলোরে জানোয়ার, মানুষ মারার অধিকার’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে’, ‘সন্ত্রাসীরা উল্লাস করে, ইন্টেরিম কী করে’, ‘জ্বালো রে জ্বালো, আগুন জ্বালো’, ‘অ্যাকশন টু অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘চাঁদাবাজের বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘চাঁদাবাজের আস্তানা ভেঙে দাও, গুড়িয়ে দাও’ বলে স্লোগান দেন। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় (এনএসইউ), ইডেন কলেজ, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ করেন। এরআগে গত শুক্রবার রাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেন বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করা হয়। হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের দশম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী ফারাবি জিসান বলেন, ‘মিটফোর্ডের সামনে চাঁদাবাজির কারণে একজন মানুষকে পাথর দিয়ে থেঁতলে নৃশংসভাবে মেরে ফেলেছেন যুবদল, ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। অথচ দল দায় না নিয়ে তাদের শুধুই বহিষ্কার করেছে। আমরা বলতে চাই, এখানে অবশ্যই দলীয় পরিচয় ব্যবহার করে মেরে ফেলা হয়েছে। আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি। যেই ছাত্রসংগঠন থেঁতলে মানুষ মারতে পারে, সেই সংগঠন কোনো ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতে পারে না। তাই ছাত্রদল হোক বা শিবির ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো দলের কমিটি থাকতে পারবে না। আজকের মধ্যেই ছাত্রদলের কমিটি প্রত্যাহার করতে হবে।’
গতকাল শনিবার দুপুরে পুরান ঢাকার মিল ব্যারাকে ঢাকা জেলা পুলিশ লাইনস, রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্স (আরআরএফ) ও ট্রাফিক অ্যান্ড ড্রাইভিং স্কুল (টিডিএস) পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘শুধু মিটফোর্ড নয়, সারা দেশে সংঘটিত এ ধরনের ঘটনায় পুলিশ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছে। তবে মিটফোর্ডের ঘটনাটি বড়ই দুঃখজনক। একটা সভ্য দেশে এমন একটি ঘটনা কখনওই আশা করা যায় না।’
গতকাল শনিবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল লিখেছেন, ‘মিটফোর্ডের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচারে সরকার বদ্ধপরিকর। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত পাঁচজনকে এরইমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। এই পাশবিক হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হবে। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন ২০০২’এর ধারা ১০’এর অধীন দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারের ব্যবস্থা করা হবে।’
গতকাল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, চাঁদাবাজি নয়, একটি দোকানে কারা ব্যবসা করবে তা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। হত্যাকাণ্ডের শিকার সোহাগ এবং হত্যাকাণ্ড যারা ঘটিয়েছে তাদের একসঙ্গে ব্যবসাও ছিল। গ্রেপ্তারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে তিনি বলেন, ভাঙারি ব্যবসা এবং দোকানে কারা ব্যবসা করবে সেটা নিয়ে একটা দ্বন্দ্ব চলছিল। হত্যাকাণ্ডের শিকার সোহাগ এবং যারা হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছেন তারা সম্পর্কিত। তারা একসঙ্গে কিছুদিন ব্যবসা করেছেন। যখন ব্যবসার লেনদেন নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয় তখনই তারা বিবাদে লিপ্ত হন। এর ফলে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে লালবাগ বিভাগের ডিসি মোহাম্মদ জসীম বলেন, গত বুধবার বিকাল ৬টার দিকে রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তিন নম্বর গেটের সামনে একদল লোক লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ (৩৯) নামের এক ব্যক্তিকে এলোপাতাড়িভাবে আঘাত করে ও কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ঘটনার সংবাদ পাওয়ার পর কোতোয়ালি থানা পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে যায় এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরবর্তীতে ১০ জুলাই এ ঘটনায় নিহতের বড় বোন বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে পুলিশ নিহতের লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করে এবং ময়নাতদন্তের জন্য তা হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। লালবাগ বিভাগের ডিসি আরও বলেন, এ ঘটনায় পুলিশ অত্যন্ত তৎপর রয়েছে। এই চাঞ্চল্যকর ঘটনায় মূল রহস্য উৎঘাটন, সংশ্লিষ্ট সব অপরাধী গ্রেপ্তার এবং সোহাগ কেন এই ঘটনার শিকার হলো তা উৎঘাটনের জন্য একটি চৌকস টিম গঠন করা হয়েছে। ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তারে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি: প্রশ্রয় না দিয়ে দেশে খুন, মব সন্ত্রাস, ধর্ষণ থামানোর দাবি জানিয়েছে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এ দাবি জানিয়েছে তারা। গতকাল শনিবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির পক্ষে এই বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছেন অধ্যাপক সামিনা লুৎফা। মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে ভাঙারি পণ্যের ব্যবসায়ী লাল চাঁদ সোহাগকে গত বুধবার নৃশংসভাবে হত্যা, চাঁদপুরে মসজিদের খতিব মাওলানা নুরু রহমানকে গতকাল শুক্রবার কুপিয়ে জখম করা এবং খুলনার দৌলতপুর থানা যুবদলের সাবেক নেতা মাহবুবুর রহমান মোল্লাকে গুলি করে ও রগ কেটে হত্যার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কথায় ও কাজে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে বলেছে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি। এসব ঘটনার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে অবিলম্বে পদত্যাগ করা দাবিও জানিয়েছে তারা। গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি বলেছে, এসব কেবল আইনশৃঙ্খলার ব্যর্থতা নয়, বরং একটি সংগঠিত সহিংস রাজনৈতিক সংস্কৃতি। যেখানে ধর্ম, গুজব ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব একত্রে সমাজকে আতঙ্ক, দমন ও নিষ্পেষণের পথে ঠেলে দিচ্ছে। সরকার এগুলো দমনে যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে না। বরং সরকার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রভাবশালীর ব্যক্তির কথায় এগুলো প্রশ্রয় দিচ্ছে। গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি বলেছে, ‘কখনো মসজিদের ভেতর খতিবকে কুপিয়ে ফেলা হচ্ছে, কখনও ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে মারা হচ্ছে, আবার কখনও মানুষের কণ্ঠ থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘শাতিম’ তকমা লাগিয়ে। ঘটনা ভিন্ন, কিন্তু কৌশল এক তকমা দাও, লোক জড়ো করো, তারপর ‘শাস্তি’ দাও। আর রাষ্ট্র কখনও নিষ্ক্রিয়, কখনও উদাসীন, আবার কখনও অপরাধীদের নীরব প্রশ্রয়দাতা। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পরেও এ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেনি।’
আসামির জবানবন্দি রেকর্ড : নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় করা অস্ত্র মামলায় তারেক রহমান রবিন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। হত্যা মামলায় টিটন গাজী নামের এক আসামিকে ৫ দিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত। গতকাল শনিবার তাদের আদালতে হাজির করে পুলিশ। দুই দিনের রিমান্ড শেষে রবিন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মত হওয়ায় তা রেকর্ড করার আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতয়ালী থানার এসআই মো. মনির। টিটন গাজীর সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন আরেক তদন্ত কর্মকর্তা একই থানার ইন্সপেক্টর নাসির উদ্দিন। ঢাকার মহানগর হাকিম হাসিব উল্লাহ গিয়াস তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন। পরে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
যুবদলের বিক্ষোভ : লাল চাঁদকে নির্মমভাবে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপির অঙ্গসংগঠন ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা। শনিবার ঠাকুরগাঁও বালক উচ্চ বিদ্যালয় বড় মাঠ থেকে মিছিলটি শুরু হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে চৌরাস্তায় গিয়ে শেষ হয়। এরপর সেখানে একটি প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
রাঙামাটিতে বিক্ষোভ : লাল চাঁদকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে রাঙামাটির ছাত্র-জনতা। শনিবার বিকালে শহরের বনরূপা জামে মসজিদের সামনে থেকে মিছিল শুরু হয়ে প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে গিয়ে সমাবেশে মিলিত হয়। এতে অংশগ্রহণকারীরা হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন, ‘খুন, চাঁদাবাজি আর নয়!’ ‘সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই!’ ‘বর্বরতার বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ!’ বিক্ষোভে বক্তরা বলেন, যে রাষ্ট্রে খুনের বিচার হয় না, সেই রাষ্ট্রে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা থাকে না। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলনের ঘোষণা দিচ্ছি। আমরা ন্যায়বিচার না পাওয়া পর্যন্ত থামব না।
উল্লেখ্য, গত বুধবার রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ভাঙারি পণ্যের ব্যবসায়ী লাল চাঁদকে (৩৯)। হত্যার আগে ডেকে নিয়ে তাকে পিটিয়ে এবং ইট-পাথরের টুকরা দিয়ে আঘাত করে মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ থেঁতলে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে তাকে বিবস্ত্র করা হয়। তার শরীরের ওপর উঠে লাফায় কেউ কেউ। লাল চাঁদকে হত্যার ঘটনায় যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক ও ছাত্রদলের অভিযুক্ত সদস্যদের আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিএনপি।