রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের পাশে শত শত মানুষের সামনে নৃশংসভাবে ভাঙারি পণ্যের ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে (৩৯) হত্যার পর নড়েচড়ে বসেছে সরকার। সারাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষা ও নির্বাচনপূর্ব স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে গতকাল রোববার থেকে বিশেষ চিরুনি অভিযানে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক শেষে বিশেষ চিরুনি অভিযানের কথা জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। সাংবাদিকদের সামনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘রাজধানীর মিটফোর্ডে যে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক ও বর্বরোচিত। সভ্যসমাজে এমন ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’
মিটফোর্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ১৯ জন আসামির মধ্যে এখন পর্যন্ত ৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানান তিনি। এই মামলার তদন্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো শিথিলতা ছিল কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘অপরাধী যেই হোক না কেন, রাজনৈতিক পরিচয়ে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আইন সবার জন্য সমান।’তিনি জানান, মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ডের বিচার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। খুলনায় সম্প্রতি আরেকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়ও একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘মিটফোর্ডের ঘটনায় কেউই পুলিশের ‘ট্রিপল নাইন’ নম্বরে ফোন করেনি। এমনকি পাশেই আনসার সদস্যরা থাকলেও তাদের কেউ কিছু জানাননি।’ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, দেশে খুন, চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতন, সন্ত্রাস, মাদক চোরাচালানসহ নানা অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। এ লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি এখন বিশেষ চিরুনি অভিযান পরিচালনা করবে। আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে বলেছে জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। সেই লক্ষ্যে নির্বাচনপূর্ব আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে চিরুনি অভিযান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ : লাল চাঁদ হত্যার বিচার দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা। তারা চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধের দাবি জানান। আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ করেন। গতকাল রোববার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকায় এই বিক্ষোভ হয়। ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীদের একটি দল রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করে। ‘ঢাকা কলেজ’ ব্যানারে এই মিছিল করেন তারা। মিছিলটি সায়েন্স ল্যাব মোড় ঘুরে আবার কলেজের সামনে এসে শেষ হয়। এ সময় ‘চাঁদাবাজের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’; ‘চব্বিশের বাংলায় চাঁদাবাজের ঠাঁই নাই’; ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’ স্লোগান দেন শিক্ষার্থীরা। মিছিল শেষে ঢাকা-কলেজের শিক্ষার্থী নাজমুস সালেকিন বলেন, ‘সারা দেশে চাঁদাবাজি লাগামহীনভাবে বাড়ছে। সব অভিযোগ একটি নির্দিষ্ট দলের বিরুদ্ধে আসছে। কিন্তু দলটি তাদের নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। যার পরিণাম হিসেবে আমরা মিটফোর্ডের সামনে একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটতে দেখলাম।
আমরা এই বর্বর হত্যার সুষ্ঠু বিচার দেখতে চাই।’ বেলা একটার দিকে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি দল। কলেজের সামনে থেকে মিছিল করে তারা সায়েন্স ল্যাব মোড়ে আসেন। সেখানে ১০ মিনিটের মতো অবস্থান করে বিক্ষোভ করার পর তারা মিছিল নিয়ে শাহবাগ মোড় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের দিকে চলে যান। এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘চাঁদা লাগলে চাঁদা নে, আমার ভাইকে ফিরিয়ে দে’, ‘চব্বিশের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’- এমন নানা স্লোগান দেন। আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থী আসাদুল্লাহ আজিম বলেন, ‘বাজার, ফুটপাত, বাসস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজির কারণে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। চাঁদা না দিলে পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলা হচ্ছে। আমরা এসব নৃশংসতার প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’
উল্লেখ্য, গত বুধবার রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ভাঙারি পণ্যের ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে (৩৯)। হত্যার আগে ডেকে নিয়ে তাকে পিটিয়ে এবং ইট-পাথরের টুকরা দিয়ে আঘাত করে মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ থেঁতলে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে তাকে বিবস্ত্র করা হয়। তার শরীরের ওপর উঠে লাফায় কেউ কেউ। এ ঘটনায় যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততার কথা জানা গেছে। গতকাল সন্ধ্যায় এই মামলার দুই আসামিকে বহিষ্কারের কথা জানিয়েছে জাতীয়তাবাদী যুবদল। হত্যা মামলার আরও দুই আসামিকে নিজেদের সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছে ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল।