বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমাতে ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের সামনে শিক্ষার্থীদের ওপর দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে হামলা চালায় ছাত্রলীগ (বর্তমানে নিষিদ্ধ সংগঠন)। ছাত্রলীগের হামলায় ওই দিনে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হোন। ছাত্রলীগ নেতাকর্মী একজোট হয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ধারালো অস্ত্র, রড ও লাঠিসোটা দিয়ে হামলা চালানো হয়। কয়েকজন যুবককের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সন্ধ্যায় ক্যাম্পাস প্রবেশ করে পুলিশ।
ক্যাম্পাসে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করলে অনেক সাধারণ ছাত্রকে হল ছাড়তে দেখা যায়। মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান নেয়। যুবলীগ ক্যাম্পাসে মহড়া দেয়। এ ছাড়া কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ফজলুল হক হল, শহীদুল্লাহ্ হল ও অমর একুশে হলের গেটে অবস্থান নেয়। রাত ১১টার দিকে কবি জসীম উদ্দীন হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হেদায়াতুল ইসলামকে বেদম মারধর করেছেন অমর একুশে হলের শিক্ষার্থীরা। এ সময় স্লোগান দেন ‘ছাত্রলীগ পাইছি, ছাত্রলীগ পাইছি’।
এর আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদে রোববার মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তাদের দেওয়া স্লোগান ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ নিয়ে শুরু হয় তীব্র সমালোচনা। নানা মহল এটাকে ‘ন্যক্কারজনক’ বলে আখ্যা দেয়। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের দাবি, প্রধানমন্ত্রী তাদের ‘রাজাকার’ বলায় তারা এমন স্লোগান দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রশ্নে কোটাবিরোধীরা রাজু ভাস্কর্যে কর্মসূচির ডাক দেন। অন্যদিকে একই স্থানে বিকেল ৩টায় ছাত্রলীগ প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করে। এদিকে রোববার রাতেই জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভের খবর আসে। এ সময় সিলেটসহ কয়েকটি স্থানে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার খবর পাওয়া যায়। এতে ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বিভিন্ন ক্যাম্পাস। সন্ধ্যায় জাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিলে ছাত্রলীগের হামলায় আহত হন অন্তত ২০ শিক্ষার্থী। চট্টগ্রামে ৭ এবং সিলেট ও কুড়িগ্রামে ৬ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। বিকেল ৩টার দিকে ঢাবির ভিসি চত্বরে ছাত্রীরা বাসে আশ্রয় নিলে সেখান থেকে তাদের নামিয়ে হামলা করতে দেখা যায় মহানগর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীকে। হামলার পর ছত্রভঙ্গ হয়ে যান শিক্ষার্থীরা। এর পর দীর্ঘ সময় ক্যাম্পাসে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয় ছাত্রলীগ। রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত চলেছে এ তাণ্ডব।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক বর্তমানে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বলেন, ‘ছাত্রলীগ আমাদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলা চালিয়েছে। ছাত্রীদেরও তারা বেধড়ক পিটিয়েছে। এ হামলায় বহু শিক্ষার্থী আহত হয়েছে।’
এর আগে দুপুর ১২টা থেকে কোটা সংস্কারের এক দফা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার দাবিতে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বিক্ষোভ ও সমাবেশে অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ইডেন কলেজ, নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে যোগ দেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও।
অন্যদিকে বিকেল ৩টার দিকে পূর্বঘোষিত ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অপমানের প্রতিবাদ’ কর্মসূচি পালন করতে দুপুর ১২টা থেকেই মধুর ক্যান্টিনে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ। সেখানে বহিরাগত এবং ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের কর্মীদের উপস্থিতি দেখা যায়। এর আগে কয়েকটি বাসে করে বহিরাগত ও মহানগর ছাত্রলীগ কর্মীরা ক্যাম্পাসে ঢোকেন। ফলে সকাল থেকেই উত্তেজনাকর পরিস্থিতি ছিল ক্যাম্পাসজুড়ে।
ঘটনার সূত্রপাত: ঘটনার সূত্রপাত হয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও ঢাবি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া থেকে। এক পর্যায়ে ঢাবি ছাত্রলীগ এবং সংগঠনের বিভিন্ন ইউনিটের বহিরাগত নেতাকর্মী সংগঠিত হয়ে দফায় দফায় হামলা চালায় আন্দোলনরতদের ওপর। এই দিন দুপুর আড়াইটার দিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীর একটি দল মিছিল নিয়ে প্রতিদিনের মতো ঢাবির হলগুলোতে যায়। কিছুক্ষণ পর খবর আসে, বিজয় একাত্তর হলে শিক্ষার্থীর ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হচ্ছে। খবর পেয়ে রাজু ভাস্কর্য থেকে মিছিল নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে বিজয় একাত্তর হলের দিকে যান আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে ছাত্রীরাও ছিলেন। হলের কাছাকাছি পৌঁছালে আগে থেকেই হেলমেট, লাঠিসোটা, হকিস্টিক নিয়ে হলগেটে অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী। এ সময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা হলগেটে ভাঙচুর চালান।
এক পর্যায়ে কবি জসীম উদ্?দীন হল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল থেকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা লাঠিসোটা নিয়ে এগিয়ে এসে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালান। তাদের সঙ্গে বের হন বিজয় একাত্তর হলের নেতাকর্মীও। সবার হাতে ছিল লাঠিসোটা, স্টাম্প, স্টিলের পাইপ, রড। অনেকে হেলমেট পরিহিত ছিলেন। এ সময় তিন শিক্ষার্থীকে মাটিতে ফেলে মারতে থাকেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। দু’পক্ষের মধ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলেছে।
মলচত্বরে বহিরাগত: হল এলাকায় পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় মূল মিছিলটি মলচত্বরের দিকে চলে আসে। আগে থেকেই মধুর ক্যান্টিনে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে দক্ষিণ মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি রাজিবুল ইসলাম বাপ্পির নেতৃত্বে অবস্থান করছিলেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ও বহিরাগতরা। তারা প্রায় সবাই হেলমেট পরিহিত ছিলেন। শিক্ষার্থীরা মলচত্বরে গেলে তাদের ওপর একযোগে হামলা চালানো হয়।
এ ছাড়াও সূর্য সেন হল, প্রশাসনিক ভবন, ভিসি চত্বর থেকে বিপুলসংখ্যক বহিরাগত আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলে পড়লে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু হয়। এ সময় ভিসি চত্বর হয়ে ফুলার রোডে পালাতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। ওই সময় দৌড়ে হকিস্টিক-লাঠি দিয়ে ছাত্রীদের পেটাতে থাকেন ছাত্রলীগ ও বহিরাগতরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের শিক্ষার্থী সুলতানা আক্তার বলেন, ‘আমরা কখনও ভাবিনি, ছাত্রলীগ এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করবে। ছাত্রলীগের কর্মীরা হেলমেট পরে আমাদের বেধড়ক লাঠিপেটা করেছে।’
ঢামেকের জরুরি বিভাগেও ধাওয়া: আহত শিক্ষার্থীদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া হলে সেখানেও ধাওয়া করা হয়েছে। রাত ৭টা ৪৫ মিনিটের দিকে জসীম উদ্?দীন হলের সৈকতের অনুসারী রাশেদুজ্জামান রনির নেতৃত্বে ৭০-৮০ জন জরুরি বিভাগে ঢুকে এলোপাতাড়ি মারধর করেন। এ সময় সাংবাদিকদেরও মারধর করা হয়। ভাঙচুর করা হয় অ্যাম্বুলেন্সও। সব মিলিয়ে চার দফায় ঢামেকের জরুরি বিভাগে হামলা ও পাল্টা হামলা হয়।