ঢাকা সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

৫০০০ বহিষ্কার, তবুও লাগামহীন নেতাকর্মীরা

৫০০০ বহিষ্কার, তবুও লাগামহীন নেতাকর্মীরা

গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর থেকে দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে এ পর্যন্ত সারা দেশে দল এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের প্রায় ৭ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি। এর মধ্যে প্রায় ৫ হাজার নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কারও পদ স্থগিত হয়েছে। অনেককে শোকজ করা হয়েছে। অনিয়ম ও সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপ সংঘটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাংগঠনিক ব্যবস্থাও নিচ্ছে দলটি। তৃণমূল কর্মী থেকে কেন্দ্রের সিনিয়র নেতারাও এই শাস্তির আওতা থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। দলের নাম ভাঙিয়ে কেউ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করলেই সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং কাউকে রেহাই দেওয়া হবে না বলে কেন্দ্র থেকে কঠোর বার্তাও দেওয়া হয়েছে। একাধিকবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতারা অপরাধে জড়ালে ছাড় দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত কিংবা অন্যায়কারীদের যারা দলে নেবে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবুও লাগামহীন বিএনপির নেতাকর্মীরা। এমন পরিস্থিতিতে সারা দেশে দখল, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করে সামনের দিকে এগোচ্ছে দলটি।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি দেওয়া নির্দেশনায় বলেছেন, সন্ত্রাসী-অপরাধীদের কোনো দল নেই। এদের কাউকেই কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। এরা যে দলেরই হোক তাদের ধরে আইনের হাতে তুলে দিতে হবে। পাশাপাশি দল ও অঙ্গসংগঠনের সর্বস্তরের ইউনিট-কমিটির নেতাদের কঠোরতার সঙ্গে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। সবাইকে মনে রাখতে হবে, বিএনপি শতভাগ একটি গণতান্ত্রিক দল। আওয়ামী লীগের মতো ফ্যাসিজমে বিশ্বাস করে না। এ ক্ষেত্রে দল ও অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন স্তরের কমিটির নেতা-কর্মীদের কর্মকাণ্ডের দায় সংশ্লিষ্ট কমিটির নেতাদের নিতে হবে।

প্রশ্ন উঠেছে- এতো বহিষ্কার, কড়া বার্তার পরও কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বিএনপি নেতাকর্মীদের? দলের নেতাকর্মীরা বলছেন, দখল, টেন্ডার, চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করেই মূলত নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ হচ্ছে। এসব কাজে মাঠ পর্যায়ের পদহীন লোকজন বেশি জড়িত। অনেক জায়গায় স্থানীয় এসব কর্মীকে নেতারা প্রশ্রয় দেওয়ায় তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। কোথাও কোথাও নিজেদের বলয় শক্তিশালী করতে স্থানীয় নেতারা আওয়ামী লীগের তুলনামূলক কম পরিচিত নেতাকর্মীদের দলে ভেড়াচ্ছেন বলেও অভিযোগ আছে। এছাড়া ত্যাগীদের বাদ দিয়ে ৫ আগস্টের পরে যারা বিএনপিতে সক্রিয় হয়েছেন তাদের সামনে আনার কারণে অপরাধে জড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে।

সূত্রমতে, আজীবন বহিষ্কারসহ কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার পরও লাগাম টানা যাচ্ছে না, বিএনপির একশ্রেণির নেতাকর্মীদের। এই নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজি, দখল এমনকি খুনের মতো গুরুতর অভিযোগে বিব্রত দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। আগামী নির্বাচনে এসব ঘটনার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা নেতাদের। এ অবস্থায় দলের তৃণমূল থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে শুদ্ধি অভিযান শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। শুদ্ধি অভিযানে পাঁচ অগাস্টের পর দলে আসা সুবিধাভোগী নেতাকর্মীদের চিহ্নিত করা হবে। পাশাপাশি যারা দলের সর্বোচ্চ সতর্কতা উপেক্ষা করে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন, তাদের বিষয়ে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিশেষ করে শিল্পাঞ্চলখ্যাত জেলাগুলোতে এই সাংগঠনিক অভিযানে গুরুত্ব দেওয়া হবে।

বিএনপির এক নেতা বলেন, বিএনপি একটি বড় দল, অনেক সুযোগ সন্ধানীরা এখন দলে ঢোকার চেষ্টা করছে। দলের পক্ষ থেকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। কেউ এদের দলে নিলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এটা চলমান থাকবে।

সবশেষ পুরান ঢাকায় নৃশংসভাবে ভাঙারি ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যার ঘটনায় অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার ঘটনায় সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলো বিএনপির বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে। এই ঘটনায় যাদের নাম এসেছে তাদের সংগঠন থেকে আজীবন বহিষ্কারের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের বার্তা দিয়েছে বিএনপি। এরপরও জামায়াতসহ অন্যান্য দলগুলো পুরো দায় বিএনপির ওপর চাপাচ্ছে। এমনকি হত্যার প্রতিবাদে ডাকা কর্মসূচিতে বিএনপির সর্বোচ্চ নেতাদের বিরুদ্ধেও স্লোগান তোলা হচ্ছে। বিএনপিকে চাঁদাবাজ সংগঠন হিসেবে পরিচিতি করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

সোহাগ হত্যাকাণ্ডের পর দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হলেও একযোগে সব রাজনৈতিক দলের এমন বিরোধিতার পেছনে ষড়যন্ত্র দেখছে বিএনপি। বিশেষ করে এমন প্রতিবাদের পেছনে বিএনপিকে বিতর্কিত করা এবং আগামী নির্বাচনকে পিছিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা মনে করছেন বিএনপি নেতারা। উদ্ভুত পরিস্থিতি সামাল দিতে দলটিকে বেশ ধকল পোহাতে হচ্ছে।

বিএনপির নেতারা বলছেন, অন্যায়-অপকর্মে জড়ানো নেতাকর্মীদের ব্যাপারে আমাদের কোনো অনুকম্পা নেই। সরকারকে বলব, দ্রুত অপরাধী যেই হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। দুঃখজনক বিষয় বারবার বলার পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হতে দেখছি না। তারা বলেন, ‘সার্বিক পরিস্থিতি দেখলে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, নানাভাবে ষড়যন্ত্রের জাল বিছানো হচ্ছে। একেক সময় একেক ইস্যু নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। কিন্তু বিএনপি কারও ফাঁদে পা দেবে না।’

অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতাকে দায়ী করে বিএনপি নেতারা বলেছেন, তারা (সরকার) অপরাধীদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। কেন মিটফোর্ডের সামনের খুনের ঘটনায় হত্যাকারীদের এখনও গ্রেপ্তার করেনি। কেন মামলার এজাহার থেকে তিনজন মূল আসামিকে বাদ দেওয়া হয়েছে? কারা মব সৃষ্টি করছে, যুবদলের নেতার হাত ও পায়ের রগ কেটে নিয়ে হত্যা করেছে? এদের বিরুদ্ধে এখনও কেন প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি? কারা দেশের সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট করছে? কারা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরোধী ছিল? কাদের অবস্থান দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের পক্ষে ছিল এবং আছে। আজ এসব কিছুই বিবেচনা করার সময় এসেছে।

এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে অপরাধে জড়ানো নেতাকর্মীদের লাগাম টানতে বিএনপিকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। বিশেষ করে অপরাধীদের প্রশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছেন। পাশাপাশি একদল অন্য দলকে ঘায়েল করার যে চেষ্টা চলছে তা অব্যাহত রাখলে সার্বিক পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ‘বিএনপিকে অভিযোগের বিষয়গুলো আরও গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। শুধু যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে তাদের বহিষ্কার করেই কাজ শেষ করা যাবে না। এদের যারা প্রশ্রয় দেন তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে শৃঙ্খলা ফিরতে পারে।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘বিএনপি সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার পর আইনিব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলছে। এখন সরকারে যারা আছেন তাদের তৎপর হতে হবে। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যিনি আছেন তিনি সহজসুলভ কথা বললেও শক্ত ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। এটা তো স্বীকার করতে হবে। আর এক ঘটনার পর যেভাবে সবাইকে বিএনপিকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছেন এটাও অন্যায়।’

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, বিভিন্ন অপশক্তি অনুপ্রবেশ করে বিএনপির নাম ভাঙিয়ে এসব অপকর্ম করছে। বিএনপির যদি কেউ জড়িত থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেছেন, আমরা বলতে চাই, আমরা শহীদ জিয়ার আদর্শের সৈনিক, আমরা খালেদা জিয়ার সৈনিক, তারেক রহমানের নেতৃত্বে আজকে বাংলাদেশে মানুষ গণতন্ত্রের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। আমরা কোনো ষড়যন্ত্রে পা দিতে চাই না। অন্যায়কে বিএনপি কোনোদিন প্রশ্রয় দেয় না, সমর্থন দেয় না। বিএনপি অন্যায়ের বিচার চায়। মব সন্ত্রাস বিএনপি চায় না।’

রুহুল কবির রিজভী বলেন, দলের নামে যারা দুর্বৃত্তপনা করছে, অনৈতিক কর্মকাণ্ড করছে, মানুষকে বিরক্ত করছে, মানুষের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করছে তাদের বিএনপি রেহাই দেয়নি। দেবেও না।

‘শৃঙ্খলার বার্তা’ দিতে ১৫৬ যুবদল নেতার সঙ্গে জরুরি বৈঠক করবে হাইকমান্ড : দেশের সব জেলা ও মহানগর যুবদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবদের ঢাকায় ডেকেছে কেন্দ্রীয় কমিটি। গতকাল মঙ্গলবার বেলা তিনটায় রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে জরুরি বৈঠকে এসব নেতাদের আগামী দিনে সংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। যুবদলের কেন্দ্রীয় সহ-দপ্তর সম্পাদক মিনহাজুল ইসলাম ভুইঁয়া স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে এই জরুরি বৈঠকের কথা জানানো হয়েছে। এতে ঢাকাসহ সব মহানগর, জেলার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদককে বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। একইসঙ্গে অন্য কাউকে সভাস্থলে না যাওয়ার জন্যও কেন্দ্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।

যুবদল সূত্রে জানা গেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত নানা অপরাধে জড়ানো কয়েকশ’ নেতাকর্মীকে বহিষ্কার, শোকজ ও পদ স্থগিত করা হয়েছে। বারবার অন্যায়-অপকর্মে না জড়ানোর বার্তা দেওয়া হচ্ছে। তবুও কেউ কেউ চাঁদাবাজি, দখলের মতো কাজে জড়াচ্ছেন। যে কারণে সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে যুবদলকে। বিশেষ করে মিটফোর্ড হাসপাতালের পাশে নৃশংসভাবে সোহাগ হত্যার ঘটনায় যুবদলের কয়েকজনের নাম আসায় নড়েচড়ে বসেছে হাইকমান্ড। যে কারণে সারাদেশের ইউনিট নেতাদের ডেকে সংগঠন সামনের দিনে আরও কঠোর অবস্থান নিতে পারে এমনটা জানিয়ে দেওয়া হবে। পাশাপাশি প্রয়োজনে অপরাধে জড়ালে সংশ্লিষ্ট ইউনিটের কমিটি বিলুপ্তি কিংবা শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার বার্তা দেওয়া হবে। একইসঙ্গে নতুন কমিটি করার ক্ষেত্রে কিংবা সদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত, অতীত ইতিহাস জেনে স্বচ্ছ লোকজনকে নেওয়ার বিষয়টিও জোর দিয়ে বৈঠকে বার্তা দেওয়া হতে পারে বলেও জানা গেছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত