
জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপির ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচি ঘিরে সংঘর্ষ ও সহিংসতায় নিহতের ঘটনায় আরও চারটি মামলা হয়েছে। গত শনিবার রাতে পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাত ৫ হাজার ৪০০ জনকে আসামি করে গোপালগঞ্জ সদর থানায় পৃথক চারটি হত্যা মামলা করে।
সংঘর্ষ ও সহিংসতায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ৫ জন নিহত হন। নিহতরা হলেন- শহরের উদয়ন রোডের দীপ্ত সাহা (২৫), টুঙ্গিপাড়ার সোহেল রানা মোল্লা (৩০), বিসিক এলাকার রমজান কাজী (১৭) ও সদর উপজেলার ভেড়ার বাজার বেপারীপাড়ার ইমন তালুকদার (১৭)। এছাড়া ১৮ জুলাই (শুক্রবার) রাতে সহিংসতার ঘটনায় গুলিবিদ্ধ শহরের থানাপাড়ার রমজান মুন্সি (৩৫) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
জানা যায়, নিহত দীপ্ত সাহার পক্ষে গোপালগঞ্জ সদর থানার এসআই শামীম হোসেন, সোহেল রানার পক্ষে এসআই আবুল কালাম আজাদ, রমজান কাজীর পক্ষে এসআই আইয়ুব আলী ও ইমন তালুকদারের পক্ষে এসআই শেখ মিজানুর রহমান বাদী হয়ে পৃথক চারটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ চারটি মামলার মধ্যে তিনটি মামলায় প্রত্যেকটিতে অজ্ঞাত ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ জন এবং আরেকটি মামলায় অজ্ঞাত ৮শ-৯শ জনকে আসামি করা হয়েছে। চারটি হত্যা মামলায় মোট আসামির সংখ্যা হলো ৫ হাজার ৪০০ জন। গোপালগঞ্জ সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আব্দুল্লাহ আল মামুন মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এদিকে গত শনিবার রাতে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন মামলায় গোপালগঞ্জ সদর থানা পুলিশ ৯ জন ও কোটালীপাড়ায় ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল রোববার আদালতের মাধ্যমে গ্রেপ্তারদের জেলহাজতে পাঠানো হয়।
গোপালগঞ্জ সদর থানার ওসি মির মোহাম্মদ সাজেদুর রহমান ও কোটালীপাড়া থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এ পর্যন্ত জেলায় মোট গ্রেফতারের সংখ্যা ৩২১।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচিকে ঘিরে সংঘর্ষ ও সহিংসতায় গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ, গাছ ফেলে সড়ক অবরোধ ও চারজন নিহতের ঘটনায় এ পর্যন্ত ৮টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় মোট আসামি ৮ হাজার ৪০৮ জন। এর মধ্যে এজাহারনামীয় আসামি ৩৫৮ জন। গতকাল রোববার সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। জরুরি অবস্থার মধ্যে গোপালগঞ্জ থেকে দূরপাল্লা ও অভ্যন্তরীণ রুটে পরিবহণ চলাচল স্বাভাবিক ছিল। শহরের মধ্যে বিভিন্ন সড়ক ও অলিগলিতে রিকশা, ভ্যান ও অটোরিকশা চলাচল করে। তবে যাত্রী সংখ্যা ছিল কম। জেলায় কোথায় সভা, সমাবেশ ও জরুরি অবস্থা ভঙ্গের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
জরুরি অবস্থার আওতামুক্ত থাকায় শিক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে এইচএসসি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত অনার্স পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। কাঁচাবাজার ফার্মেসি, মুদি মাল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান খোলা থাকলেও অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল।
এদিকে, কারফিউ শেষে গোপালগঞ্জে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। গতকাল রোববার সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই বিধিনিষেধ বলবৎ থাকে। গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসন জানায়, এই সময়ের মধ্যে যেকোনো ধরনের সভা, মিছিল ও জনসমাবেশ নিষিদ্ধ থাকবে। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী, সরকারি অফিসসহ জরুরি পরিষেবাসমূহ ১৪৪ ধারার আওতামুক্ত থাকবে। এছাড়াও শহরজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বর্তমানে জেলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক। গত বুধবারের সহিংসতার পর জেলায় কারফিউ জারি করা হয়। গত শনিবার কিছু সময়ের জন্য কারফিউ শিথিল করা হয়। আজ কারফিউ তুলে নিয়ে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।
গণগ্রেপ্তার নয়, গোপালগঞ্জে প্রকৃত অপরাধী ধরা হচ্ছে -স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা : গোপালগঞ্জে গণগ্রেপ্তার চলছে না। যারা প্রকৃত অপরাধী, তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। গতকাল রোববার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা ও কোর কমিটির মিটিং শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।
গোপালগঞ্জের ঘটনায় রাজনৈতিক প্রভাব ছিল উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আগের ও বর্তমান পরিস্থিতি জেনেছি। বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের তুলনায় অনেক ভালো। গোপালগঞ্জের ঘটনায় রাজনৈতিক প্রভাব ছিল, তবে এখন সেখানে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরছে। কারফিউ তুলে নেওয়া হয়েছে, ১৪৪ ধারাও তুলে নেওয়া হবে।
আওয়ামী লীগের হরতাল প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অন্য সময়ের তুলনায় এবারের হরতালগুলোতে নাশকতার মাত্রা অনেকটাই কম। আমরা সহনশীলতা ও শৃঙ্খলার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছি। আমরা চাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য বজায় থাকুক। সবাই মত প্রকাশ করবেন, তবে যেন কেউ অশালীন ভাষা বা আক্রমণাত্মক আচরণ না করেন। তিনি আরও বলেন, মিথ্যা বলে গণতন্ত্র হয় না, সত্যি কথা বলতে হবে। কেউ অন্যায় করলে গ্রেপ্তার হবে। কিন্তু যারা নির্দোষ তাদের যেন হয়রানি না হয়। গোপালগঞ্জে শিশু গ্রেপ্তারের কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। আগের মতো গণগ্রেপ্তার নয়, এখন শুধু প্রকৃত অপরাধীদের ধরা হচ্ছে।
নির্বাচন প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বাচন সুষ্ঠু করতে পারবে না, এমন কথা ঠিক নয়। আমাদের হাতে এখনও সময় আছে। প্রস্তুতি চলছে, প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে কোনো অসুবিধা হবে না।
সেনাবাহিনী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যে সময় যে পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, সেনাবাহিনী সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ধরে রাখতে প্রতিটি সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, গত বুধবার সমাবেশ শেষে ফেরার পথে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)র নেতাদের গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় গোপালগঞ্জের পৌরপার্ক এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পরে জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করে জেলা প্রশাসন। এরপর জেলাটিতে প্রথমে ২২ ঘণ্টার কারফিউ জারি করা হয়। এরপর থেকে পর্যায়ক্রমে কারফিউর সময় বাড়ানো হচ্ছিল।