সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডির একটি বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। খায়রুল হককে গ্রেফতারের খবর নিশ্চিত করেছেন গোয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মো. নাসিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, সাবেক প্রধান বিচারপতিকে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে আনা হয়েছে। খায়রুল হকের বিরুদ্ধে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও নারায়ণগঞ্জে মোট তিনটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে যেকোনো মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে বলে জানান নাসিরুল ইসলাম। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল মামলার মূল রায়দানকারী হিসেবে রাজনৈতিকভাবে সমালোচিত খায়রুল হক। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা মডেল থানায় খায়রুল হকের বিরুদ্ধে জালজালিয়াতি করে রায় দেওয়া এবং রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা রয়েছে। গত বছরের ২৫ আগস্ট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও ফতুল্লা থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুল বারী ভূঁইয়া বাদী হয়ে মামলাটি করেন। এ ছাড়া ঢাকাতেও মামলা রয়েছে।
দেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে ২০১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর নিয়োগ পান খায়রুল হক। একই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে তার নিয়োগ কার্যকর হয়। পরের বছরের ১৭ মে তিনি অবসরে যান। ২০১৩ সালের ২৩ জুলাই খায়রুল হককে তিন বছরের জন্য আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই মেয়াদ শেষে কয়েক দফা কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তাকে পুনর্নিয়োগ দেওয়া হয়। গত বছরের ১৩ আগস্ট তিনি কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
আপিল বিভাগে থাকাকালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল এবং ফতোয়া অবৈধ ঘোষণার রায় দেন খায়রুল হক। হাইকোর্ট বিভাগে থাকাকালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ও সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায় দিয়েছিলেন খায়রুল হক। এ ছাড়া তিনি ঢাকার চার নদী রক্ষা, স্বাধীনতার ঘোষকসহ বিভিন্ন মামলায় রায় দেন।
দেশে গণতন্ত্র হত্যার মূল কারিগর ছিলেন খায়রুল হক- কায়সার কামাল : বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেছেন, দেশে গণতন্ত্র হত্যা এবং হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট বানানোর মেইন আর্কিটেক্ট হলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি খায়রুল হক। তার এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত যাতে ভবিষ্যতে নতুন কোনো খায়রুল হক বিচারাঙ্গনে জন্ম না হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি। এর আগে, সকালে সাবেক এই প্রধান বিচারপতিকে রাজধানীর ধানমন্ডির নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। গত বছর এবিএম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে বিচারক হিসেবে ‘দুর্নীতি ও বিদ্বেষমূলক’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে বেআইনি রায় প্রদান ও জাল রায় তৈরির অভিযোগে দণ্ডবিধির ২১৯ ও ৪৬৬ ধারায় শাহবাগ থানায় মামলা করা হয়।
সম্প্রতি সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হককে গ্রেপ্তার ও বিচার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম। ‘দেশের বিচার বিভাগ ও গণতন্ত্র ধ্বংসের মূল কারিগর’ উল্লেখ করে তাকে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানায় সংগঠনটি। বিচারাঙ্গনে তুমুলভাবে আলোচিত-সমালোচিত এ বিচারপতির বেশ কয়েকটি রায় চরম বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। তিনি সরকারের পক্ষে রায় দিয়ে আওয়ামী আমলে নানাভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছেন।
খায়রুল হকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান মির্জা ফখরুল : সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে দেশের ‘সবচেয়ে বড় শত্রু’ আখ্যা দিয়ে আইন অনুযায়ী তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে তার দেওয়া রায় রাষ্ট্রবিরোধী। বিলম্ব হলেও তার বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেওয়ায় ধন্যবাদ জানান মির্জা ফখরুল।
জাতি এখন তার ন্যায্য শাস্তি দেখতে চায়- জামায়াত আমীর : সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে গ্রেফতারের পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। গতকাল বেলা ১২টার দিকে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্টে জামায়াত আমির বলেন, এবিএম খাইরুল হক ফ্যাসিস্ট আমলে প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে ছিলেন। নাহ, কোনোমতেই তিনি তার দায়িত্বের মর্যাদা উপলব্ধি করেননি এবং আমানত রক্ষা করেননি।
ডা. শফিকুর রহমানের ফেসবুক পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো- ‘অপেক্ষায় রইলাম... এবিএম খাইরুল হক ফ্যাসিস্ট আমলে প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে ছিলেন। নাহ, কোনোমতেই তিনি তার দায়িত্বের মর্যাদা উপলব্ধি করেননি এবং আমানত রক্ষা করেননি। এই মর্যাদাপূর্ণ চেয়ারে বসে ইতিপূর্বে কেউ দেশ ও জাতির এত বড় ক্ষতি করেনি। তার হঠকারী রায়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক মাফিয়াদের হাতে গুম, খুন, লুণ্ঠনসহ সকল অপকর্মের লাইসেন্স ও হাতিয়ার তুলে দেওয়া হয়েছিল। তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেরিতে হলেও পাকড়াও করেছে। জাতি এখন তার সুষ্ঠু বিচার এবং ন্যায্য শাস্তি দেখতে চায়। তার ক্ষেত্রে আমরা শুধু ন্যায়বিচারই প্রত্যাশা করি। ন্যায়বিচারেই তিনি ইতিহাসের শিক্ষণীয় শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত হবেন -এই আশাই রাখি।’